ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মন

অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক

[অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের (১৯১৪-১৯৯৯) বর্তমান লেখাটি তাঁর ‘অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক দল’ শীর্ষক অসমাপ্ত পিএইচডি অভিসন্দর্ভ থেকে নেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক রাজ্জাক তাঁর এ গবেষণাকর্ম ১৯৫০-এর গোড়ার দিকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করেন। বর্তমান অধ্যায়টিতে যেমন তেমনি ওই গবেষণাগ্রন্থের অন্তর্গত অন্যান্য অধ্যায় যেমন: ভারতে ক্ষমতার প্রয়োগ এবং প্রয়োগ-পদ্ধতির পরিবর্তন প্রসঙ্গে; বেসরকারি ইউরোপীয় সম্প্রদায়: ভারতের রাজনৈতিক শ্রেণিসমূহ; সংবাদপত্র এবং তার তাত্পর্য; ভারতে সংঘবদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা প্রভৃতি শিরোনামের আলোচনার মধ্যেও ঊনবিংশ শতকের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে অধ্যাপক রাজ্জাকের চিন্তাপূর্ণ বিশ্লেষণের পরিচয় রয়েছে। এটা দুঃখজনক যে অধ্যাপক রাজ্জাকের নিস্পৃহতার কারণেই তাঁর এই মূল্যবান গবেষণাকর্ম পুস্তকাকারে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়নি। অনূদিত বর্তমান প্রবন্ধটির (বক্তব্য, প্রবন্ধ পত্রিকা, শ্রাবণ—আশ্বিন ১৩৮৪, সম্পাদক—মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর) মূল ইংরেজি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল নিউ ভ্যালু সাময়িকীর নবম খণ্ডে, দ্বিতীয় সংখ্যায়, ১৯৫৭ সালে। ইংরেজি এই পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক প্রয়াত খান সারওয়ার মুরশিদ (১৯২৪-২০১২)। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি ঐতিহাসিক অবদান ছিল। বিশেষত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যে সমাজ তৈরি হয়েছিল তার মনোজগতটি আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়েছিলেন তাঁর এই অভিসন্দর্ভ-এর মাধ্যমে। সম্প্রতি পেরিয়ে গেল অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের জন্মশতবর্ষ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তিনি নানা কারণে হয়ে উঠেছিলেন তাঁর সমসাময়িককালে কিংবদন্তি। সংখ্যার বিচারে তাঁর লেখা খুবই কম। তবে পড়াশোনার পরিধি ও প্রজ্ঞা মুখ্যত কাজ করেছিল তাঁর এই কিংবদন্তি ইমেজ গড়ে ওঠার পেছনে।

স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন ভাবুক ও দার্শনিক প্রকৃতির। তিনটি প্রজন্মকে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট তিন প্রজন্মের জ্ঞানচর্চায় তাঁর অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা ছিল তাদের পাথেয়। আমাদের জাতীয় জীবনের উত্থানপর্বের তিনি ছিলেন নিবিড় পর্যবেক্ষক ও ক্ষেত্রবিশেষে অভিভাবকস্থানীয়।

আবদুর রাজ্জাক তাঁর অভিসর্ন্দভ-এ যে দিকটি তুলে ধরতে সচেষ্ট ছিলেন তা হলো প্রথমত: স্বাধীনতা অর্জন সত্ত্বেও ১৯৪৭ সালে ভারত কেন খণ্ডিত হওয়ার ভাগ্য বরণ করল; আর ভারতেই এই বিভক্তি হয়েছিল মুখ্যত ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বে, দ্বিতীয়ত: তিনি ভারত বিভক্তির মূল কারণ খুঁজতে গিয়ে শিক্ষিত ভারতীয়দের চিন্তার আবহাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আর এর অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি দৃষ্টি দিয়েছিলেন চিরন্তন অবদান বিধৃত ভারতের দুটি স্বদেশি সাহিত্যে—বাংলা ও উর্দুতে। এই দুই সাহিত্য ধরে রেখেছে উনিশ শতকের গোড়ায় সূচিত ‘অন্তরের অনুসন্ধান’-এর ফলাফল। আবদুর রাজ্জাকের মতে, ‘ভারত ভাগ হলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের আপসহীন বিরোধের পরিণাম’। তিনি আরও লিখেছেন ‘ভারতে কংগ্রেস বা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বাধীন আন্দোলনগুলোর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য থেকে ফুটে উঠেছে যে এসবের সর্বাত্মক নেতৃত্বে ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি’। আর এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি মুখ্যত ঔপনিবেশিক প্রয়োজনেই সৃষ্টি। সে পরিপ্রেক্ষিতে আবদুর রাজ্জাক জোরালোভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর বৈশিষ্ট্যের ওপর শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাবের দিকটির প্রতি আলোকপাত করেছিলেন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিণতির শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধিত হয়নি। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, ঔপনিবেশিক সরকার ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি পরস্পরের ওপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল ছিল। তাঁর মতে, ‘রাজনৈতিক আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। এই শ্রেণিই ছিল মুখ্য। এদের মাধ্যমেই সরকার তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখত। সরকারের এই শ্রেণির গলা টিপে ধরার প্রশ্নই উঠত না; কারণ তা ছিল সরকারের নিজেরই গলা টিপে ধরার শামিল’। অধ্যাপক রাজ্জাকের এই বিশ্লেষণ, নয়া ঔপনিবেশিক—বিশ্বায়নের এই যুগেও—এই সম্পর্কের চিত্রটি অনেকটা সমমাত্রিক।

এই জ্ঞান সাধক আজীবনই কাটিয়ে গেছেন এক সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন। তাঁর  জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্য করে নতুন প্রজন্ম ও প্রতিচিন্তার পাঠকদের সামনে, তাঁর অভিসন্দর্ভ-এর অনূদিত অংশবিশেষ পুনর্মুদ্রণ করা হলো। আশা করি পাঠক এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাবেন ]

সামাজিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণকারী নিমিত্তসমূহ থেকে আলাদা করে ভারতে রাজনৈতিক আন্দোলন প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি-সম্পর্কিত। ইংরেজি জানা এই শ্রেণির সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব নিরূপণের জন্য এর সামাজিক সম্পর্ক নির্ণয় করা প্রয়োজন। এই শ্রেণির সদস্যরা যে পরিবেশে বসবাস করত তা স্মরণ রাখা এবং তাদের রাজনৈতিক ভূমিকা নির্ণয়ের জন্য তাদের আপ্তশিক্ষার আধেয় বিষয়সমূহের দিকেও লক্ষ করা দরকার। এই শিক্ষার স্বরূপ এবং রাজনৈতিক সম্প্রসারণে—বিশেষ করে রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহের ক্ষেত্রে—তার ভূমিকা এই প্রবন্ধের প্রধান আলোচ্য বিষয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ থেকে ভারতে কোম্পানির এলাকার উন্নত পদমর্যাদার সমস্ত স্তরবিন্যাস সাধিত হয়েছে তার শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে। ভারতীয় সমাজের প্রধান গোষ্ঠী সে সময় বিরাট বণিক এবং ব্যবসায়ীরা নয়। অভিজাত ভূস্বামীরাও নয়। কেননা সে সময় অভিজাত ভূস্বামী হওয়ার প্রধান সম্ভাব্য মাধ্যম ছিলেন কোম্পানির ক্ষমতাশালী কর্মচারীরা। কোম্পানির ভারতীয় কর্মচারীদের যে একটি শ্রেণি গড়ে উঠেছিল, তারা ছিল ভারতীয় সমাজের ‘স্বাভাবিক’ নেতা। সন্দেহ নেই কোম্পানিতে তাদের পদ ছিল সামান্য, তথাপি একটি শ্রেণি হিসেবে তারাই ছিল ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ও অর্থবান। তাদের চাকরিদানের নিয়ম ও পদ্ধতি এবং সেই সঙ্গে তাদের শিক্ষার প্রণালি এবং বিষয়সমূহ আগন্তুক মধ্যবিত্ত শ্রেণির ইনটেলেকচুয়াল পরিবেশ নির্ধারণ করেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় শেষ পর্যন্ত প্রধান ভারতীয় কর্মচারীরা ছিলেন কাজি এবং পণ্ডিতেরা, যাঁদের কাজ ছিল ইউরোপীয় বিচারকদের কাছে ভারতীয়—হিন্দু এবং মুসলিম—আইন ব্যাখ্যা করা।

কলকাতার মোহামেডান কলেজ এবং বেনারসের হিন্দু কলেজ স্পষ্টত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কোম্পানিকে হিন্দু এবং মুসলিম আইনে পারদর্শী কর্মচারী জোগান দেওয়ার জন্য।১ রাজস্ব এবং আইন প্রশাসনের কর্মকাণ্ড ক্রমে হিন্দু ও মুসলিম আইনের বাইরে অধিকতর ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে

এই দুই আইনে অনুশীলনপ্রাপ্ত কর্মচারীদের প্রয়োজন কমে আসতে থাকে। ইংরেজি জ্ঞান—কর্মচারীদের যা প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সম্পাদনে এবং ইউরোপীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় সক্ষম করত—ছোট কিন্তু লাভজনক চাকরিতে যোগদানের যোগ্যতা হিসেবে ধীরে ধীরে বেশি করে স্বীকৃতি পেতে থাকে।

১৭৯৩ সালে মিশনারিরাও এসে যোগ দেয় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করার জন্য। কিন্তু ইংরেজি জ্ঞান সরকারি চাকরির একমাত্র যোগ্যতা নির্ধারিত হওয়ার আগে ১৮৬৪-তে কলকাতার মোহামেডান কলেজ বেনারসের হিন্দু কলেজ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্তরা (যদিও ১৮৩১ থেকে ক্রম হ্রাসপ্রাপ্ত সংখ্যায়) নিরবচ্ছিন্নভাবে চাকরি পেয়ে এসেছে। এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে যে শিক্ষা দেওয়া হতো তার বিষয়সমূহ কী ছিল? মেকলে তাঁর এক প্রায়শ উদ্ধৃত উক্তিতে তখনকার সময়ের সঙ্গে এই শিক্ষার মারাত্মক অসংগতির বর্ণনা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই শিক্ষা ছিল হিন্দু এবং মুসলিম আইন শিক্ষাদানের জন্য পরিকল্পিত একটি পাঠ্যসূচি।২ এই আইন ক্রমেই অপর এক আইন দ্বারা—যা এই দুই আইন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন—অপসৃত হতে থাকে।

হিন্দু এবং মুসলিম আইনের সূক্ষ্ম খুঁটিনাটি জানা এই শ্রেণির মানুষ সামাজিক অবলুপ্তি অতএব অনিবার্য হয়ে পড়ে। ভারতের নবজাত মধ্যবিত্ত শ্রেণির অখণ্ড অংশ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে তারা ব্যর্থ হয়। আকস্মিকভাবে এখন থেকে ইংরেজি শিক্ষা সরকারি পদ লাভে ছাড়পত্র হয়ে দাঁড়ায়। ফলে যারা চিন্তাশূন্যভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে এই শিক্ষা তাদের এবং তাদের সন্তানদের পক্ষে যথেষ্ট মঙ্গলকর নয়, তাদের জন্য সমস্যার উদ্ভব হলো। এদিকে যত দিনে ‘প্রাচ্যবাদী’ ‘প্রতীচ্যবাদী’দের মধ্যে বিরোধ শুরু হয়, তত দিনে প্রাচ্যের ভাষায় প্রদত্ত শিক্ষা তখনকার সমাজের সঙ্গে এতটুকু সংগতির ছিটেফোঁটাও রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ইংরেজির জন্য সংঘবদ্ধ প্রচার অভিযান শুরু হয় ১৭৯৩ সালে মিশনারিদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু অন্তত কলকাতায় ইংরেজি প্রচলন হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। কলকাতায় প্রথম থেকেই, ভারতের অন্যান্য জায়গার মতো কিছু লোক ছিল, যারা মোটামুটি ভালো ইংরেজি জানত এবং তারা ইংরেজ বণিক ও দেশীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থ হিসেবে কাজ করত। ১৭৫৭ থেকে ইংরেজি জ্ঞানের মূল্য, বাণিজ্যিক বিনিময় হিসেবে, হঠাত্ বৃদ্ধি পায়। ১৭৫৭ থেকে ১৮১৬ এই সময়ের মধ্যে কেবল ইংরেজি শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে কলকাতায় বেশ কিছু স্কুলের পত্তনও ঘটে।৩ তারপর ১৮১৩ সালে চার্টার অ্যাক্টের৪ মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শিক্ষা সম্প্রসারণ কোম্পানির জন্য বাধ্যতামূলক করা হলে ইংরেজি জ্ঞানের চাহিদা অসম্ভব বেড়ে যায়। কোম্পানির প্রধান কর্মচারীরা—বিশেষত প্রাচ্যবাদীরা— ইংরেজি শিক্ষা সম্প্রসারণের এই পরিকল্পনাকে বিশেষ সুনজরে দেখেননি। অতএব ইংরেজি শিক্ষা সম্প্রসারণের প্রাথমিক দায়িত্ব এখন থেকে দুটি গোষ্ঠীর ওপর ন্যস্ত হয়, যত দিন না কোম্পানির প্রাচ্যবাদী কর্মচারীরা লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের আমলে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয়। অর্থাত্ ১৭৯৩-১৮৩১ এই সময় পর্যায়ে ইংরেজি শিক্ষার আধেয় আর কোম্পানির নয়, ব্যক্তির ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ১৭৯৩ থেকে ১৮৩১ এই সময়কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে: ১৭৯৩-১৮১৪ এবং ১৮১৪-১৮৩৩।

প্রথমোক্ত সময়কালে ইংরেজি শিক্ষা সম্প্রসারণে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় যতটুকু হয়েছে তা হয়েছে মিশনারিদের দ্বারা। প্রকৃতপক্ষে, প্রথম পর্যায়ে ইংরেজি প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের ‘সত্য ধর্ম’ বা ‘ট্রু ফেইথ’-এ ধর্মান্তরে সহায়তা করা।৫ এই কারণেই কোম্পানির কর্মচারীরা পরিকল্পনাটিকে বিশেষ উত্সাহের সঙ্গে গ্রহণ করেনি। কারণ, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের খ্রিষ্টীয় জীবনযাপন প্রণালির জন্য বিশেষ রকম চিহ্নিত ছিল না। তা ছাড়া স্থানীয় শাসকেরা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করত, কোম্পানির যেকোনো ধর্মান্তরিতকরণ প্রচেষ্টা তাদেরই এত দিনকার লালিত রাজনৈতিক কাঠামোকে মারাত্মকভাবে বিপন্ন করবে। সে যা হোক, মিশনারিদের হয়তো ইংরেজি শিক্ষা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াল। সেটি হচ্ছে, খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার সহায়ক হিসেবে জনগণের নৈতিক পুনর্জাগরণ। শিক্ষার বিষয়সমূহ, যা ইংরেজির মাধ্যমে কিংবা ইংরেজির সহায়তায় প্রচার করা হচ্ছিল, এই অতি-আবশ্যকীয় উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। ইংরেজি প্রবর্তনের প্রথম সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা এভাবে ধর্মান্তরিতকরণের মিশনারি লক্ষ্যের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরু ১৮১৪ সালে, যে বছর রামমোহন রায় কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কলকাতার একটি ক্ষমতাশালী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইংরেজি শিক্ষা সম্প্রসারণের পক্ষ সমর্থন। মিশনারিদের সঙ্গে সঙ্গে রামমোহন রায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত এই গোষ্ঠী ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষা প্রসারের প্রশ্নটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে। বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ছিল ১৮৩১ সালের চার্টার অ্যাক্টে ভারতীয়দের শিক্ষার জন্য সংরক্ষিত বার্ষিক এক লাখ টাকা। কিন্তু যদিও মিশনারিরা এবং রামমোহন গোষ্ঠী উভয়েই ইংরেজি শিক্ষার পক্ষ সমর্থন করে, তথাপি দুই দলের স্থিরীকৃত উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।

মিশনারিরা তাদের অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিণামদর্শী উত্সাহের বশে বস্তুত যা করতে সমর্থ হয় তা তাদের লক্ষ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। ধর্মসংস্কারের দেশি আন্দোলন ছিল মিশনারিদের ধর্মান্তরকরণ পরিকল্পনার সোজাসুজি পাল্টা জবাব। কিন্তু ভারতীয় সমাজের দূরপ্রসারী বিকাশের দিক থেকে এই পাল্টা জবাবের একটি দুঃখজনক পরিণাম ছিল। ইংরেজির প্রবর্তন, যা হতে পারত একটি পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ ব্যাপার, হলো শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে রিভাইভালিজম বা ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদের এক হাতিয়ার। আর এ প্রবণতা শতাব্দীর শেষেও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। রামমোহন রায় ছিলেন ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের একজন নায়ক এবং তিনি সহায়তা করেছিলেন আধুনিক ইউরোপীয়—অন্তত ইংরেজি—জ্ঞান এবং চিন্তা ও ভারতের মধ্যে একটি সূত্র স্থাপনে। কিন্তু তাঁর কর্মতত্পর নিবেদিত জীবনে যেসব বিষয়ে তিনি উত্সর্গীকৃত ছিলেন তার সবই সম্পূর্ণ ধর্মীয়। এবং শুধু রামমোহনের ক্ষেত্রেই নয়। ইংরেজি শিক্ষা, যা গ্রান্ট এবং মিশনারিরা ভেবেছিল খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরকরণে সহায়তা করবে, বরং দেখা গেল যেন একটি পুনরুজ্জীবিত হিন্দুয়ানির জন্ম দিল। ইংরেজির প্রথম প্রবর্তন আর শতাব্দীর প্রায় শেষাশেষি, এই দুইয়ের মধ্যখানে দেশীয় সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো সবাই যেন ধর্মীয় বিষয়াদিতে পুরোপুরি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন।

ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা। বহুদিন এটি ছিল সর্বগুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদসমূহে কর্মচারী গ্রহণের একমাত্র মাধ্যম। অন্তত যেসব সরকারি কর্মচারী ইংরেজি শিক্ষিত ছিল, তাদের সবাই এখান থেকে এসেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংরেজি-শিক্ষিত ব্যক্তিদের তালিকা বস্তুত ছিল প্রায় সম্পূর্ণভাবে এই কলেজ থেকে পাস করা ব্যক্তিদের তালিকা। এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি এবং কারণসমূহ খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনের সঙ্গে মিশনারিদের ধর্মান্তরকরণ উচ্ছ্বাসের দ্বারা সৃষ্ট এবং লালিত ধর্মানুগ মানসিকতার কি যোগাযোগ। ‘১৮১৫ একজন বিশিষ্ট নেটিভ (রামমোহন রায়) তাঁর বাড়িতে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে আপ্যায়ন করেন। কথায় কথায় নেটিভদের নৈতিক অবস্থার সংস্কার বিধানের শ্রেষ্ঠ পন্থা কী, এই নিয়ে আলোচনা ওঠে। রামমোহন রায় বেদান্ত পদ্ধতির অনুসরণে ধর্মীয় মতবাদসমূহ শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে একটি ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। মি. হিউম সংশোধনী প্রস্তাব হিসেবে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন।’৬ অর্থাত্ কলেজটি হলো ব্রাহ্মসভার বিকল্প এবং মিশনারি ধর্মান্তরকরণ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তানদের শিক্ষাদান।৭ এই কলেজ প্রতিষ্ঠার মূলে ছিল ‘নেটিভদের নৈতিক অবস্থা পরিশোধনের’ একটি আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু সেই প্রথম দিকেও ‘নেটিভ’ বলতে হিন্দু ছাড়া আর কোনো সম্প্রদায়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হতো, মনে হয় না। ডিভাইড অ্যান্ড রুলের একটি নীতি উদ্ভাবনের আগ্রহপূর্ণ প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত হলেন এ.ও. হিউম। তখনকার রাজনৈতিক সমতলে হিন্দু এবং মুসলমানদের একত্রে ব্যর্থতার একটি ব্যাখ্যা দেওয়া তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এই প্রচেষ্টার আদৌ দরকার হতো না যদি শিক্ষিত ভারতীয়দের মানসিকতা কার্যত সরকারি উদ্যোগের সহায়তা ব্যতীতই, যেভাবে হিন্দু ও মুসলমান এই আলাদা প্রকোষ্ঠে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছিল, তার প্রতি ইংরেজ লক্ষ রাখত। শতাব্দীর শুরুতে প্রধানত ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় জনগণকে বিভক্ত করার সেই প্রবণতা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেই প্রবণতার পরিণতি এবং শতাব্দীব্যাপী এর প্রবলতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফলে পরিপূর্ণ।

একটিমাত্র ধর্মে উত্সর্গীকৃত কোনো সমাজে এই ধর্মীয় প্রবণতা হয়তোবা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিণতি পেতে পারত। ভারতের পটভূমিতে, একাধিক ধর্মবিশ্বাসী মানুষের সমাজে, এটি অধিকতর এবং ভয়াবহতর জটিলতার কেবল একটি পূর্বাভাসের মতো ছিল আসলে। মিশনারিদের প্রথম আক্রমণ জন্ম দেয় ধর্ম সংস্কারবাদীদের। এরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল ব্রাহ্মসমাজ হিন্দু কলেজ, কিন্তু পরে এদেরই থেকে জন্ম নেয় রিভাইভালিস্টরা পুনরুজ্জীবনপন্থী—হিন্দুয়ানির আরও বেশি গোঁড়া সমর্থক। তবু পরিণতি যা-ই হোক—সংস্কার অথবা পুনরুজ্জীবন; সেই সময়ের প্রধান কৌতূহল, অর্থাত্ চিন্তার বিষয়বস্তু ছিল অবিমিশ্রভাবে ধর্মানুগ। হিন্দু ধর্ম সংস্কার অথবা পুনরুজ্জীবন এবং মুসলিম রিফর্ম অথবা রিভাইভালিজম ভারতের পটভূমিতে সাম্প্রদায়িক হওয়া ছাড়া আর কী হতে পারত সে সময়?

বস্তুত ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোটা ধরেই এই আন্দোলন কোনোখানে মিলিত না হয়ে সমান্তরাল পথে এগিয়েছে। ভারতে মুসলিম রিফর্ম ও রিভাইভালিস্ট আন্দোলন অনুরূপ হিন্দু আন্দোলন থেকে একটু পুরোনো এই মুসলিম আন্দোলন কোনো বিশেষ খ্রিষ্টীয় প্রোভোকেশন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে হয় না। আসলে মিশনারিরা তাদের পরিকল্পনা শুরু করার আগেই এই আন্দোলন সম্পূর্ণ পরিণতি পেয়ে যায়। ভারতীয় হিন্দুয়ানি এবং ইসলাম যে সময় নিজেদের আবিষ্কার করছে—এই দুই ধর্মের নিবেদিত অনুরাগীরা নিজেদের হূদয়ের মধ্যে সমকালীন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইছে তখন—সেই সমগ্র সময়ে তাদের ভেতর তাই বিবাদের একটিও রেকর্ড নেই। তারপর একদিন ভারতের মানুষ সত্যি সত্যি যখন ধর্মোন্মাদ হয়ে উঠল, তখনো তাদের একত্রে বসবাসের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অসুবিধা হয়েছে মনে করার কারণ নেই। প্রকৃত অসুবিধা দেখা দিল যখন রিভাইভালিস্ট উন্মাদনা কেটে গিয়ে আরও বেশি জাগতিক মানবীয় কাঠামো গড়ে উঠল। কেননা ধর্মীয় আলোচনা যখন আলাপের প্রধান বিষয়বস্তু আর থাকল না তখনো এসব আলোচনার বিষয়বস্তু এমন সহজতর স্বীকৃত হয়ে গেল যে সবাই এটাকে মেনে নিল বিনা প্রশ্নে। এক শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ ধরে যে প্রবল আলোচনা চলে এসেছে, তা চিন্তার এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করল, যা ছিল পুরোপুরি হিন্দু অথবা পুরোপুরি মুসলিম। রাজনৈতিক চিন্তা এবং কর্মকাণ্ডের নেতারা যখন এলেন, তাঁরা তখন একটি ভিত্তির কথা বলতে পারলেন না, খ্রিষ্টধর্ম যেমন সমগ্র ইংরেজ সমাজ চালিত করে। দুঃখজনকভাবে তাঁরা কথা বললেন পরস্পর অসহিষ্ণু দুটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে।

যদি হিন্দু রিফর্ম অথবা রিভাইভালিজম এবং অনুরূপ মুসলিম সংস্কার শুধু ভিন্ন হতো তাহলেও ভবিষ্যত্ মানুষের জন্য তা যথেষ্ট বৃহদাকার সমস্যার সৃষ্টি করত। বস্তুত, পরস্পরবিচ্ছিন্ন তো তারা ছিলই, উপরন্তু প্রায়ই তারা বিবাদে অবতীর্ণ হতো। মুসলিম রিফর্মের লক্ষ্য ছিল হিন্দুয়ানির সংস্পর্শে ভারতবর্ষে ইসলাম যেসব আচার এবং চিন্তাভ্যাস সঞ্চয় করেছিল তা থেকে তাকে মুক্ত করা।৮ অপর পক্ষে হিন্দু সংস্কারের লক্ষ্য ছিল ধর্মান্তরিত হিন্দুদের স্বধর্মে ফিরিয়ে আনার পন্থা আবিষ্কার করা এবং যদিও হিন্দু রিফর্ম প্রধানত উদ্ভূত হয়েছিল মিশনারিদের ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে, মিশনারিরা কিন্তু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করত ইংরেজি প্রসারবাদী সেই হিন্দুদের সঙ্গেই।

কোম্পানি নিজস্ব একটি শিক্ষা প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করার আগে পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে প্রধান শক্তি ছিল নিঃসন্দেহে মিশনারিরাই।১০ মিশনারিদের প্রভাব কার্যকর হয়েছিল একটি ছোট গোষ্ঠীর চেষ্টার মাধ্যমে। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কেরি, ওয়ার্ড এবং মার্শম্যান। কেরি ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার অধ্যাপক। ফলে শতাব্দীর প্রথমাংশে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতিতে তাঁর অবদান ছিল প্রবল। সেই সময়ে কোনো লেখকের পক্ষে সাবস্ক্রিপশনের সাহায্য ছাড়া বাংলায় বই প্রকাশ অসম্ভব ছিল। ভবিষ্যত্প্রত্যাশী লেখক ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার অধ্যাপককে উত্সাহিত করতেন, যাতে তাঁর প্রতিষ্ঠান অন্তত ১০০ কপি বই কেনে এই মর্মে তিনি একটি সুপারিশ করেন।১১ ১০০ কপি বই বিক্রয়ের এই আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতি সেই বইটির প্রকাশনাকে সফল করতে পারত। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ২৫ বছর যেসব বাংলা বই প্রকাশিত হয়েছে, তার অধিকাংশই সেসব বই, যা ডক্টর উইলিয়াম কেরি প্রকাশের যোগ্য মনে করেছেন। মার্শম্যান তাঁর প্রভাব কার্যকর করেছেন বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার তিনটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলো হচ্ছে সমাচার দর্পণ (বাংলা এবং ইংরেজি), দ্য ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া ও পরে দ্য গভর্নমেন্ট গেজেট। মার্শম্যানের প্রধান অবদান, বাংলায় পত্রিকা সম্পাদনায় তিনি এমন কিছু ভারতীয় ব্যক্তির সহযোগিতা গ্রহণ করেছিলেন, যাঁরা প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সুর, স্বভাব এবং কাঠামো গড়ে তুলেছিলেন।১২

ফলে শৈশব সময়েই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমাগ্রগতি সারত শ্রীরামপুরের মিশনারিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। আমাদের জানা প্রয়োজন, কী ছিল এই গোষ্ঠীর অবদান, সেই সম্প্রদায়গত মনোভঙ্গির জন্মদানে ও প্রসারে, যা সেই সময়কার লেখকদের রচনায় অনিবার্যভাবে ছায়া ফেলত; মানুষকে কেবল হিন্দু অথবা মুসলিম অথবা খ্রিষ্টান হিসেবে অঙ্কন করার সেই প্রবল অভ্যাস গঠনে? গোষ্ঠীর চাবিকাঠি সমাচার দর্পণ ফারসি অবলুপ্তি আইন ঘোষিত হওয়ার পর বাংলা ভাষা চর্চার প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করতে গিয়ে বলল: প্রথম এবং প্রধান কথা হচ্ছে, যবনদের (মুসলমানদের তখন এই অপরিসীম ঘৃণাব্যঞ্জক শব্দটি দ্বারা চিহ্নিত করা হতো, অনেকটা প্রথম মহাযুদ্ধকালীন ‘হুন’ শব্দের মতো) ঔদ্ধত্য ধূলিসাত্ করার সুযোগ এবার এসেছে, এখন আমাদের সামনে অনেক উজ্জ্বল আশা। বাংলা ভাষার ব্যাপক ব্যবহার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা লুপ্ত হয়ে যাবে, কেননা তারা বাংলা পড়তে বা লিখতে এখনো সক্ষম নয়, কোনো দিন হবেও না।১৩

প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের রূপায়ণে এই গোষ্ঠীর ভূমিকা যে মূল্যবান ছিল তা অনস্বীকার্য। এদের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে এরাই বাংলা রেনেসাঁসকে প্রথম জাগিয়েছিল। তারা নিজেরা বস্তুত যা সম্পাদন করেছিল তা গুরুত্বপূর্ণ বৈকি, কিন্তু অন্যদের অন্য কীর্তি সম্পাদনে উত্সাহদানে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। কেননা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে মিশনারিরা অচিরে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু যাদের তারা কর্মে অনুপ্রাণিত করেছিল, তারা পক্ষান্তরে তাদের বংশধরদের হাতে কর্মের ভার দিয়ে গেল। এভাবে তাদের ফুল ফোটানোর ইতিহাস অবিরাম এগিয়ে চলে। এই সময়ের সাহিত্য খুব মহান কিছু অন্তর্নিহিত মূল্য বহন করে না সত্যি, বাংলা ভাষার প্রকাশনা তুলনায় আরও কম সার মূল্যবাহী। কিন্তু দুই সম্প্রদায়ই মুখ্যত উত্সাহী ছিল মিশনারিদের শুরু করা ধর্মীয় বিতণ্ডায়।

১৮৩২ সালের প্রকাশনার কথা বলতে গেলেই বলতে হয় সে সময়ের ধর্মীয় চিন্তার মূল চাবিকাঠিসমূহের কথা। বাংলায় প্রকাশিত তখনকার চারটি অমিশনারি পত্রিকার পরিচয় এই রকম: ক. দ্য ব্রাহ্মণিকাল ম্যাগাজিন: বদ্ধমূল শত্রুর অপ্রত্যাশিত আক্রমণ থেকে হিন্দুদের জানমাল রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে প্রবল উত্তেজনায় উন্মত্ত। খ. দ্য চন্দ্রিকা: প্রতিমাপূজার বিশ্বস্ত ভক্তদের অভয়াদাত্রী গোলিয়াথ। গ. সংবাদ কৌমুদী: সেই সব হিন্দুর শপথ উচ্চারণকারী মুখপত্র, যারা কৃতবিদ্য ইউরোপীয়দের সঙ্গে প্রায়ই মেলামেশার ফলে মনে মনে প্রতিমাপূজা বর্জনে কুণ্ঠিত নয়, তবে যাদের অনেকেই কার্যত এই ধর্ম ও তার আচার-পদ্ধতির প্রতি বাহ্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে সমপরিমাণে সংকোচহীন। ঘ. দি এনকোয়ারার ও জ্ঞানান্বেষণ: শিক্ষিত হিন্দুদের একটি ক্ষুদ্র গোত্রের মুখপত্রদ্বয়, যাঁরা যুগপত্ বিশ্বাসে ও আচারে হিন্দুয়ানির সম্পূর্ণ ধারণাকেই বর্জন করতে প্রস্তুত। দি এনকোয়ারার দ্য রিফরমার-এর মতো ইংরেজিতে প্রকাশিত হতো এবং এটা ছিল ‘নেটিভ’ দ্বারা পরিচালিত প্রথম ইংরেজি সংবাদ পত্রিকা।১৪

এভাবে সে সময় প্রকাশনব্যবস্থা বিভিন্ন ধর্মমতের প্রকোষ্ঠে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে ধর্মনিরপেক্ষ জাগতিক বিষয়াদিতে তা উত্সাহী ছিল না, তা নয়। দুর্ভাগ্যক্রমে নিরপেক্ষ মানসতাও, যতটুকু তার প্রমাণ পাওয়া গেছে, সমাচার দর্পণ-এর মনোভঙ্গি থেকে ভিন্ন ছিল না, যে সমাচার দর্পণ ছিল মিশনারিদের নিজস্ব পত্রিকা। দ্য রিফরমার লিখেছে: গ্রেট ব্রিটেনের মুসলমান ও হিন্দু প্রজাদের কর্মের পেছনে যে প্রবণতা কাজ করে তার পার্থক্য থেকে আমরা আবিষ্কার করতে পারি প্রথমোক্তদের অবিশ্বস্ততা ও শেষোক্তদের রাজানুগত্য।...সরকারেরও উচিত এ থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যে মুসলমান প্রজাদের ওপরেই তাদের সতর্ক লক্ষ রাখতে হবে, কেননা মুসলমানরাই বিচ্ছিন্নতা ও বিদ্রোহের প্রতি অতিমাত্রায় আসক্ত।১৫

আমি বলছি না যে বাংলার প্রচলন হলেই মুসলমানরা অপসৃত হবে—সমাচার দর্পণ-এর এই যুক্তি নির্ভুল। মুসলমানরা একদিন অপসৃত সত্যি হয়েছে, কিন্তু তা অন্য কারণে। এ কথাও বলছি না যে তত্কালীন সরকার দ্য রিফরমার-এর পরামর্শে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেছিল। এই ঘটনাগুলো আসলে সে সময়ে বুদ্ধিজীবীদের মানসিকতা অনুধাবনে সংগত সহায়, যে মানসিকতা একদিন রাজনৈতিক আন্দোলনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। এক টেবিলে বসে রাজনীতি প্রসঙ্গে একটি সাধারণ পরিকল্পনা গ্রহণে হিন্দু ও মুসলমানদের যে ব্যর্থতা, তা শিক্ষিত হিন্দু এবং শিক্ষিত মুসলমানের ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতার বীজ ছিল বুদ্ধিগত মানসের গোড়াকার গঠনপ্রণালিতে এবং তার ধারা আজও প্রবহমান।

বাংলাকে আধুনিক ভাষা হিসেবে একটি আধুনিক সাহিত্যের বাহন হিসেবে লালনে মিশনারিরা তাদের পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল। অপরিসীম দুর্ভাগ্য এই যে এই অমূল্য কাজটি এমন এক গোষ্ঠীর দ্বারা সাধিত হলো, জনগণের বিভিন্ন সম্প্রদায় সম্পর্কে যাদের এই রকম সব উদ্ভট ধারণা ছিল। বাংলা ভাষার প্রথম পৃষ্ঠপোষকদের এই রকম মনোভঙ্গির সবচেয়ে কম ক্ষতিকর ফল হচ্ছে চেষ্টাকৃতভাবে সংস্কৃতগন্ধি একটি ভাষা। তাদের পক্ষসচেতন মনোভঙ্গির সবচেয়ে স্থায়ী ফলটি উদ্ভূত হয়েছিল যে ঘটনা থেকে তা হলো, ইংরেজি প্রবর্তনে যারা সবচেয়ে বেশি ওকালতি করেছে তাদেরই অনেকে দেশীয় ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নে অংশ নিয়েছিল। বস্তুত দেশীয় ভাষার প্রতি মিশনারি পৃষ্ঠপোষকতার মূলে ছিল সেই লক্ষ্য, যা তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল ইংরেজি শিক্ষার সমর্থনেও। গ্রান্টের বিপরীতে—যিনি ইংল্যান্ডে ইংরেজি শিক্ষার ওপর আলোচনার সূত্রপাত করেছিলেন—বাংলাদেশে কেরি, মার্শম্যান ও অন্যরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বাইবেল ও অন্য ধর্মসংক্রান্ত রচনাদি এদেশীয় ভাষায় প্রকাশ করা গেলে তা খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে সহায়ক হবে। খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের এই প্রচেষ্টা থেকেই বাংলা ভাষায় প্রথম গদ্য রচনার সূত্রপাত। অবশ্যই শুধু তাতেই এটা সীমাবদ্ধ থাকেনি। পাঠ্যবই ও জ্ঞানপ্রিয় রচনাদির মধ্যেও এই মহত্ কর্মপ্রবর্তকদের গোড়াকার পক্ষপাতিত্ব স্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। এভাবেই দেশীয় ভাষা উন্নতি লাভ করতে থাকে। এই ভাষার সাহিত্য দ্রুত অগ্রগতি সাধন করে। কিন্তু সাহিত্যের এই আন্দোলনের ও তার অগ্রগতির জনক যাঁরা, তাঁদের চিন্তাধারা ভিন্নধর্মাবলম্বী জনমানুষের জীবনের জন্য বিষবৃক্ষের বীজ বপন করে গেছে। শিক্ষিত মানুষের বিবেক জাগল, জন্ম হলো ধর্মীয় সংস্কারের, আর এই জাগরিত বিবেক স্থায়ী জায়গা করে নিল ধর্মীয় রচনায়। তবু কোনো দিন এই জাগরণ সব ভারতীয়কে অন্তর্ভুক্ত করার মতো উদার হতে পারেনি। ১৮৩৫ থেকে শুরু করে ১৮৬৫-তে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রথম উপন্যাসসহ আত্মপ্রকাশ করার সময় পর্যন্ত দুটো অত্যন্ত সাহিত্যগুণসম্পন্ন পত্রিকা ও কয়েকজন কবির কিছু রচনা প্রকাশিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় বের হতো সংবাদ প্রভাকর এবং অক্ষয়কুমার সম্পাদনা করতেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। সে সময় আরেকবার ধর্মীয় বিষয়ে আত্মনিমগ্নতা প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দেয়, আর সমাজ পুনর্নির্মাণের কথা উঠলেই ধর্মীয় নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তা করা হয়। অর্থাত্ সেই সময়ের সিরিয়াস লেখাও কেবল একটি জীবনযাত্রাকেই প্রতিফলিত করে। সেই সময়ের শেষে এসে মানুষ যখন নিরপেক্ষভাবে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছে, তখনো একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্বের যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, তা টিকে রইল। বস্তুত, সত্তরের দশকে যখন রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে, তখনো সেই ধর্মকেন্দ্রিকতার পুরোপুরি অবসান হয়নি। ১৮৭০-১৯০০ পর্যন্ত সময় আসলে ছিল বিগত ৭০ বছরের ধর্মোন্মাদনার পূর্ণ বিকাশের সময়। এই সময়ের প্রধান পুরুষেরা রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করার কেউ নন। এঁরা হচ্ছেন কেশব সেন, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ এবং বঙ্কিম, যাঁদের প্রধান ভাবনা ছিল ধর্ম। অবিমিশ্রভাবে ধর্মীয় এবং সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ এই দুই পৃথক আন্দোলনের যোগসূত্র যিনি বেঁধেছিলেন, তিনি হচ্ছেন বঙ্কিম। যে পন্থায় তিনি এই কাজটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা হচ্ছে: তিনি নিজে ধার্মিক হয়ে গেলেন। তাঁর মহান সাহিত্যপ্রতিভা তিনি নিয়োজিত করলেন তাঁর নিজ গোত্রের মানুষদের সহমর্মিতাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এই রকম বিষয়ের খোদকারি করতে। বস্তুত তিনি এর চেয়েও এক ধাপ এগিয়েছিলেন। তাঁর প্রায় সব সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তু হিন্দু-মুসলমানের বিবাদকে কেন্দ্র করে পল্লবিত। অর্থাত্ তখনকার শুষ্ক ইতিহাসের পাঠ্যবইতে যেসব জিনিস কমবেশি ইঙ্গিতে বোঝানো হতো, সাহিত্যের হাটে তারই সরাসরি সওদাগরি চলল।

সেই সময়ের লেখার মহত্ উদ্দেশ্য ও সাহিত্যগুণ অনস্বীকার্য। কিন্তু সব জনগণকে নিয়ে যে সমাজ, তার সচেতনতা তখনকার সাহিত্যে অনুপস্থিত। এই সাহিত্য তাই সব তরুণ বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। শুধু তরুণ হিন্দুদের এই লেখা নাড়া দিয়েছিল। লেখাগুলো অবশ্য মুসলিমবিদ্বেষী ছিল না। সবচেয়ে যা চোখে পড়ে তা হলো একই দেশের এক বিশাল জন-অংশের মানুষ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কৌতূহল এসব লেখায় নেই।

এমনকি যখন লেখক উদারভাবে নিখাদ সামাজিক সমস্যাবলিকে তাঁর বিষয়বস্তু করতেন, তখনো সমস্যাগুলো অবিচ্ছিন্নভাবে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকত। বিধবা বিবাহের সমস্যা আগেকার সহমরণের মতো গভীর সাহিত্যগুণসম্পন্ন লেখার জন্ম দিয়েছে। যেমন রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের লেখায়। কিন্তু অপর সেই মানুষগুলো, যাদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এই তরুণ ও উচ্ছৃঙ্খল জাগরণে প্রতিফলিত হয়নি, তাদের কথা, মনে হয় না, তখনকার চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনে কখনো উদয় হয়েছে। এভাবে স্বয়ম্ভূ এবং সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা এবং অগ্রসরতার গতিধারা ভবিষ্যতের জন্য অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য সমস্যা সৃষ্টি করে গেছে।

কিন্তু সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় মনোভঙ্গির চেয়েও বিপজ্জনক ছিল ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার আধেয়সমূহ, যার দ্বারা তরুণ ভারতবর্ষ তখন লালিত হচ্ছে। ভারতীয় ইতিহাসের অনিষ্টকর পাঠ্যবইসমূহ ইংরেজিতে প্রকাশিত হলেই যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হতো। বইগুলো বাংলায় লেখা হলে এই ক্ষতি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম হলো যখন ইতিহাসের বিকৃত কাহিনি শক্তিশালী সাহিত্যের আখ্যান হয়ে উঠতে লাগল। ইতিহাসের স্মৃতি পাঠ্যবইয়ের চেয়ে আরও বেশি লালিত হয় কল্পনাশ্রয়ী রচনার দ্বারা, বিশেষত সেগুলোর স্রষ্টা যখন প্রতিভাবান লেখক হন। দুর্ভাগ্যক্রমে ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী বাঙালি লেখক বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর প্রায় সব লেখাতে ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু-মুসলমানের উত্তেজনা উসকে দেওয়ার জন্য কলম ধরেছিলেন।

১৮৬৫ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে আজ পর্যন্ত বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বেশি পঠিত লেখক। রামমোহন রায় থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত ধর্মীয় চিন্তা ও আচারাদির সংস্কারে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদিত অন্য মনীষীদের মধ্যে বঙ্কিম ঊনবিংশ শতাব্দীর সৃষ্টিশীল কর্মক্রিয়ায় সবচেয়ে উজ্জ্বল।

তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ গানটি এখন পর্যন্ত ভারতীয়দের চিন্তায় ও মননে তাঁর যে স্থান তারই স্থায়ী স্মৃতিসৌধ। গানটি তাঁর সবচেয়ে বেশি পঠিত উপন্যাস আনন্দমঠে স্থিত। আনন্দমঠ একটি অত্যন্ত আবেগাশ্রিত উপন্যাস। যার বিষয়বস্তু একটি হিন্দু-মুসলিম বিবাদ। বাংলা ভাষায় এটি প্রথম রাজনৈতিক বিষয়বস্তুসংবলিত সাহিত্যকীর্তি। এই মাতৃ-বন্দনা (বন্দে মাতরম) অবিশ্বাসী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গমনোদ্যত হিন্দু ‘সন্তানদের’ সমর-সংগীত। উপন্যাসটি এমন একজন প্রতিভাশালী লেখকের সৃষ্টি, যিনি তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি ঘৃণা-স্তোত্র রচনা করার জন্য। উপন্যাসটি ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বসার তিন বছর আগে।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্মিলিত নেতারা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দ্যসুলভ সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছিলেন। বর্ধমান জাতীয় আন্দোলনের এই কেন্দ্রীয় মুখপাত্রটিতে এরূপ প্রস্তাবের কোনো অভাব নেই, যেখানে এই সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের কামনা প্রকাশিত হয়েছে। এই রকম অবস্থায় এই রকম একটি গানকে জাতীয় আন্দোলন তাদের মূলমন্ত্র হিসেবে বেছে নিল কেমন করে? এই বইটিই বা এত জনপ্রিয় হলো কেন? এটা ভাবা অযৌক্তিক হবে না হয়তো যে গল্পটি এমন এক শ্রোতৃ-শ্রেণির কাছে বলা হয়েছিল, যারা এটিকে একটি স্বাভাবিক থিম হিসেবে নিয়েছিল। (আমেরিকান চলচ্চিত্রে নিগ্রোদের উপস্থাপন এ রকম মানসিকতার পরিচায়ক)। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে ইন্টেলেকচুয়াল উত্তেজনা ও সাধারণ অনুসন্ধিত্সা পাশাপাশি এগিয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে মোগল প্রশাসন প্রণালির কেন্দ্রীয় কাঠামোর অবলুপ্তি এবং সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যের প্রভাব ঊনবিংশ শতাব্দীর নতুন ইন্টেলেকচুয়াল সূত্রসমূহের জন্ম দিয়েছিল।

সমগ্র দেশে সমস্ত জনগণের মধ্যে দুটি সমান্তরাল প্রণালি বহুদিন এগিয়ে চলেছিল পরস্পরের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছাড়া। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে ইন্টেলেকচুয়াল প্রক্রিয়াদির ধর্মীয় ভিত্তি অবশ্যম্ভাবী এবং অনিবার্য একটি পরিণতি সৃষ্টি করেছিল, যার ফলে এই দুই প্রণালি মিলেমিশে না গিয়ে সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। যত দিন অবিমিশ্র ধর্মীয় সমস্যাদি এবং ধর্মীয় আচারসংক্রান্ত সামাজিক সমস্যাদি প্রধান কৌতূহলের বিষয় ছিল তত দিন এই দুই সমান্তরাল স্রোত নির্বিবাদে এগিয়েছে। এই সমান্তরাল সমতা অবশ্য যতটা পূর্ণ উদাসীনতার ফল, ততটা সুবিবেচক সহিষ্ণুতার নয়। বস্তুত, সেই সময়ের জাগতিক শিক্ষায় ঐতিহাসিক সামগ্রীর এমন একটি দূষিত সংমিশ্রণ থাকত, যা জনসমষ্টির এক সম্প্রদায়কে আরেক সম্প্রদায়ের ঘৃণা ও ক্রোধের বস্তু করে তুলত। ফলে দুই সম্প্রদায়ের মাঝখানে ক্রমেই একটি কঠিন দেয়াল তৈরি হতে লাগল।

পাঠ্যবইপ্রণেতাদের পরীক্ষামূলক ও নিদারুণ অশিল্পীসুলভ প্রচেষ্টা বঙ্কিম এবং অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী একদল লেখকের প্রতিভার দ্বারা সাহিত্য মাধুর্য ও সৌকর্যে শোভিত হয়ে উঠেছিল। সমকালীন পুনর্জাগরণের উন্মাদনা তাদের জনপ্রিয়তাকে বর্ধিত করেছে। কিন্তু বঙ্কিম এবং তাঁর সমসাময়িক লেখকেরা সেই শিক্ষিত জন-অংশের স্রষ্টা নয়, যারা এসব বইয়ের প্রতি তাদের চিন্তাহীন ও উচ্ছ্বাসপূর্ণ সাদর অভ্যর্থনা প্রসারিত করত। এই পটভূমি আধা শতাব্দীর সাম্প্রদায়িক চিন্তা ও অগ্রগতির দ্বারা তৈরি হয়েই ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কষ্টসাধ্যভাবে গড়ে তোলা এই ঐতিহ্য সত্তর দশকের পর থেকে, যা রাজনৈতিক চিন্তা ও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলো, তা কেবল ভারতীয় অথবা বাঙালি অথবা মারাঠি কিংবা পাঞ্জাবি নয়, তা হলো হিন্দু নয়তো মুসলিম ঐতিহ্য। একজন বাঙালি লেখক, তিনি প্রতিভাশালী হন বা না হন, তাঁর বিষয়বস্তুর জন্য নায়ক খুঁজে পেতেন একজন রাজপুত অথবা মারাঠির মধ্যে, যদিও তার কাছে মারাঠিদের স্মৃতি জড়িয়ে ছিল বাংলায় তাদের লুটতরাজ ও ধ্বংসসাধনের সঙ্গে। যোগসূত্র ছিল ধর্মে। ভারতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, যা পাকিস্তান প্রশ্নের চেয়ে অনেক পুরোনো, ভারতীয় রাজনীতিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দলসমূহের দ্বারা ওই সাম্প্রদায়িকতার ফল নয়। ঊনবিংশ শতাব্দী ধরে প্রবাহিত ইন্টেলেকচুয়াল প্রবণতার সম্পূর্ণ গতিধারা থেকে—অন্তত শিক্ষিত শ্রেণিসমূহের মধ্যে— অনিবার্যভাবেই এই বোধের বিকাশ ঘটেছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর ইন্টেলেকচুয়াল উত্তেজনার পরপরই যে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার স্বরূপ ও অভ্যন্তরীণ উপাদানসমূহকে বুঝতে হলে অবশ্যম্ভাবীভাবে ভারতের দেশীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে ভারতীয়দের সৃষ্টিশীল ক্রিয়াকাণ্ড পূর্ণ প্রতিফলন পেয়েছে তাদের সাহিত্যের অগ্রগতিতে। দেশীয় সাহিত্য সেই চিন্তার পরিবেশ তৈরি করেছিল, যা শিক্ষিত ভারতীয়দের সচেতন রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহকে রূপায়িত করেছে। কনফারেন্স অথবা কংগ্রেস কিংবা তাদের কার্যবিবরণীতে শুধু আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তসমূহের বিশ্লেষণই রাজনৈতিক আন্দোলনের অভ্যন্তরীণ উপাদানের উপলব্ধির জন্য যথোপযুক্ত পথনির্দেশক নয়। যারা এসব জিনিসের মধ্যে অথবা রাজনৈতিক লেখায় ভারতীয় রাজনীতির গতি ও প্রকৃতিকে বুঝতে চায়, তাদের কাছে সব সময়ই অবোধ্য থাকবে কী অনমনীয় এবং জেদি অধ্যবসায়সহ ভারতের মুসলমানরা তাদের ‘পৃথক রাজনীতি’ নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। যদিও পরের দিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরাটসংখ্যক মানুষ রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, আন্দোলনের চরিত্র বরাবর নির্ধারিত হয়েছে শিক্ষিত পেশাদার মানুষের দ্বারাই।

যে ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে ভারতের শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠেছিল তা একক ছিল না, ছিল দ্বিধাবিভক্ত এবং দুর্ভাগ্য এই যে তারা ছিল পরস্পর নিরপেক্ষ। সে কারণে এমনকি সাধারণ উদ্বেগের প্রশ্নেও যখন তারা আলোচনা করত, তখনো তাদের মানসিক ক্ষেত্র হতো সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশীয় সাহিত্যের মুসলমান-লালিত অংশ স্পষ্টত ইসলামি জীবনের ও গড়পড়তা মুসলমানের অস্থানিক মনোভঙ্গি প্রতিফলিত করে। বিশ দশকের খিলাফত আন্দোলন, গান্ধী যাকে এত সক্ষমভাবে সহায়তা করেছিলেন, একমাত্র এই অস্থানিক মনোভঙ্গির ভাষাতেই বোধগম্য হতে পারে। এই আন্দোলনের লক্ষণসমূহকে উপলব্ধি করতে, যে জীবন ধারণার ওপর রচিত ছিল এর ভিত তাকে বুঝতে, কী শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় গান্ধী দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় এই আন্দোলন থেকে তাঁর প্রত্যাশার পরিমাণ দেখে। তিনি সত্যি বিশ্বাস করেছিলেন মুসলমান ও হিন্দুদের আরও বেশি ধর্মসচেতন করে রাজনৈতিক প্রগতি ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ করা সম্ভব।

এই পর্যন্ত আমি যা বলতে চেয়েছি তা হলো, শিক্ষিত ভারতীয়দের মানসিকতা বিকশিত হচ্ছিল সুনিশ্চিত বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে। বাংলার রেনেসাঁসের ইতিহাস হচ্ছে বাংলার হিন্দু সমাজে আধুনিক ধারণাসমূহের প্রযুক্তির ইতিহাস। সাহিত্যিক নথি থেকে যতটুকু প্রমাণ পাওয়া যায়, সৃষ্টিশীল সাহিত্যের অন্তর্গত চিন্তাধারণা থেকে যতটুকু জানা সম্ভব, বাংলার অহিন্দু জন-অংশের সঙ্গে এর কোনো সংযোগ ছিল না। বাংলার চিন্তার ইতিহাস যদি ভারতের চিন্তার ইতিহাস হতো, তাহলে পরবর্তীকালে যেসব সমস্যা ভারতকে বিচলিত করেছিল, তার একটি সমাধান হয়তো পাওয়া যেত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কেউ ভুলেও ভাবেনি যে ভারতে একটিমাত্র সমাজ কখনো হতে পারে। সে কারণে এটা অস্বাভাবিক নয় যে বাংলায় রামমোহনের হূদয়ান্বেষণের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান সমাজেও অনুরূপ একটি হূদয়ান্বেষণ শুরু হয়েছিল। মুসলিম সমাজ অপর সমাজটি থেকে কত দূরে অবস্থান করছিল তা এই ঘটনা থেকে বোঝা যাবে যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে যখন মুসলিম জাগরণ এমনকি বাংলাতেও প্রসারিত হয়েছে, বাংলার নতুন প্রকাশনা জগতে তা প্রবেশ লাভ করতে পারেনি, কোনো ছায়া ফেলতে পারেনি তখনকার উদ্বিগ্ন নতুন সাহিত্যে।

তবু সেই জাগরণ সত্যি ছিল। সমাজের ফাটল দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল সম্পূর্ণ অষ্টাদশ শতাব্দী ধরেই, এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকাণ্ড ব্যতিরেকেই। সিরিয়াস ব্যক্তিরা সমাজের এই আসন্ন ভাঙনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের হূদয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করতে শুরু করেন এবং অচিরে দিল্লি ও তার আশপাশে এক নতুন জীবনের আলোড়ন শুরু হয়ে যায়। এসব মনীষী পশ্চিমের তাড়নায় এখানে আসেননি। শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আবদুল আজিজ ও সৈয়দ আহমদ ব্রেলভি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিম সমাজে তা-ই ছিলেন, হিন্দু সমাজে রাজা রামমোহন ও তাঁর অব্যবহিত অনুগামীরা যা ছিলেন। ভিন্নতা ছিল অবশ্যই এবং সূক্ষ্মভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভিন্নতাও, কিন্তু সাধারণত এই দুই আন্দোলনের অভ্যন্তরে একটি মিল ছিল দৃষ্টিভঙ্গির। দুই সমাজই চেয়েছিল সমাজকে পুনর্নির্মাণ করতে। যে মূলনীতির দ্বারা সমাজকে চিহ্নিত করা হতো তা ছিল ধর্মীয়। ফলিত চিন্তা, যখন তা এমনকি সামাজিক ও পরে রাজনীতিক প্রশ্নাবলিকেও স্পর্শ করত, ছিল সাম্প্রদায়িক। ভারতের সমস্ত জনগণের জন্য এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। সৈয়দ আহমদ ব্রেলভি ও তাঁর অব্যবহিত অনুগামীদের দ্বারা প্রচারিত ধর্মীয় মতবাদসমূহ মুসলিম সমাজ গ্রহণ করেনি, ঠিক যেমন রামমোহন ও তাঁর অনুগামীদের ব্রাহ্মসমাজের ধর্মীয় মতবাদ হিন্দু সমাজে গৃহীত হয়নি। শিক্ষিত মুসলমানরা সবিশেষ চেষ্টা করত বাংলায় সৈয়দ আহমদ ব্রেলভি ও শরীয়তউল্লাহর কিছু কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক মতবাদ অস্বীকার করতে। কিন্তু শিক্ষিত মুসলমান সমাজ কখনো অস্বীকার করতে পারেনি—চেষ্টাও করেনি অস্বীকার করতে—আন্দোলনের মূল ধারণাসমূহের অভ্যন্তরের সেই উপাদানটিকে, যা তাদের সাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছিল। মুসলিম সমাজ ও মুসলিম চিন্তার পুনর্জাগরণ ও পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টায় নিজেদের উত্সর্গীকৃত করেছিল শিক্ষিত মুসলমানরা। ভারতীয় অমুসলিম জনগণের প্রতি ঠিক সেই উদাসীনতা ছিল তাদের, যে উদাসীনতা শিক্ষিত হিন্দুরা পোষণ করত ভারতের অহিন্দুদের প্রতি। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে উর্দু সাহিত্যের মূল বিষয়বস্তুসমূহের সঙ্গে ভারতীয় অমুসলিম মানুষের কোনো মিল ছিল না।

রাজা রামমোহনের নেতৃত্বে যে আন্দোলনটি গড়ে উঠেছিল তা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক, যেখানে শাসকশ্রেণি তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা ও জৌলুশ ধারণ করে থাকত। এই আন্দোলনটি মূলত ছিল মিশনারিদের আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি আত্মরক্ষামূলক অঙ্গবিন্যাস। ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও দেশীয় ভাষার চর্চা যুক্ত ছিল সম্পূর্ণ আন্দোলনটির সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত শাসকশ্রেণির ভাষার চর্চা দেশীয় সমাজে সেই শ্রেণিটির অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিপুল ফলবতী হয়। সে কারণে মুসলমান সমাজে জনিত আন্দোলনটি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে যুক্ত নয়, এই সত্যটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

এটা স্পষ্ট যে সে সময়ে ইংরেজি শিক্ষার যুগপত্ পরিচর্যা ব্যতিরেকেই গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার কাজ এগিয়েছিল। ইংরেজি না জানলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি পাওয়া যেত বলে মুসলমানরা ইংরেজি ভাষা শেখার ব্যাপারে তখনো উদাসীন। কিন্তু এই মানসিকতার ফল স্পষ্ট হয়ে উঠল মাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, যখন দেশীয় সমাজে অবস্থান প্রায় সম্পূর্ণভাবে ইংরেজি শিক্ষার ওপরই নির্ভর করত।

এই দুই আন্দোলনের ভিন্ন গতির ফলে আরও দুটি জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। রাজা রামমোহনের আন্দোলনটি কখনোই নবউদ্গত ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে দূরে যেতে পারেনি। এই আন্দোলনের বিষয়সমূহ ছিল ধীর কিন্তু স্থিরগতি এবং কখনোই তা গতি পরিবর্তন করেনি। কিছুদিন আগে পর্যন্তও শাসকশ্রেণির সঙ্গে এই আন্দোলনের এবং তার বিভিন্ন প্রশাখার সম্পর্ক ছিল মোটের ওপর সৌহার্দ্যপূর্ণ। মেকলের আমল থেকে শাসকশ্রেণি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে বিপুল গর্ব অনুভব করে এসেছে, কেননা তারা বিশ্বাস করত যে নতুন বুদ্ধিজীবী জাগরণটি ছিল সম্পূর্ণ এই ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফল। শিক্ষিত সমাজ কিন্তু মনে মনে জানত যে সমাজে তার সাফল্য এবং অবস্থান প্রচলিত শাসনপ্রণালির রক্ষণের সঙ্গে যুক্ত। এই সমাজটির সামাজিক দর্শনের মূল ধারণাসমূহ শাসকশ্রেণিকে কখনো অসুবিধায় বা অস্বস্তিতে ফেলতে পারেনি। এমনকি নতুন বাংলা ভাষা, যার উন্নতিসাধন এই আন্দোলনের একটি প্রধান অবদান, শিখতে হতো অত্যন্ত কষ্ট সহ্য করে। সত্তরের দশক ও তার পরবর্তী সময়ে পূর্ববর্তী সময়ের সংস্কৃত পরিবৃদ্ধিকে অপসারণ করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালাতে হয়েছিল। নতুন সাহিত্যের অবদানসমূহ অনেক দিন পর্যন্ত একটি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র শ্রেণির মধ্যে ভীষণভাবে সীমাবদ্ধ ছিল।

সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির আন্দোলনটি অবশ্য অতি শিগগিরই মুসলমানদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।১৬ এর সাহিত্য একটি জ্ঞানোদ্ধত অপভাষায় পরিণত হয়নি। এই আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষণাদি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ছিল এবং তার ফলে শিক্ষিত মুসলমানদেরই একটি গোষ্ঠী একে অভিসম্পাতগ্রস্ত মনে করে। অর্থাত্ ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান সমাজের একটি বাড়তি দায়িত্ব হয়ে পড়ে, যাঁরা তাদের সমাজে চিন্তার জলবায়ু পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তাঁদের কিছু কিছু ধারণাকে অস্বীকার করা। একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্য ছিল চিন্তার প্রচলিত ছাঁচ। এমনকি স্যার সৈয়দ আহমদ, যিনি সৈয়দ আহমদ ব্রেলভির কিছু কিছু মতবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন, তিনিই মূলত ছিলেন ধর্মীয় চিন্তার পুনর্নির্মাণের ব্যাপারে উত্সাহী। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমানরা সেই ঐতিহ্যের কিছু কিছু আইটেম নিয়ে সত্যি সন্ত্রস্ত ছিল। এই শ্রেণিটিকে, যদিও সংখ্যায় এরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, একটি দ্বিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যা অপর মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির হতে হয়নি। মধ্যবিত্ত মুসলমানদের নিজেদেরই এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হয়েছে এবং উপরন্তু এমন এক শ্রোতৃশ্রেণির কাছে তাদের উদ্দেশ্য বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হয়েছে, যারা বিশেষ সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল না সত্তরের দশকের মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তায় যে হতবুদ্ধিতা দেখা গিয়েছিল, তা এই দুই কঠিন সমস্যার সমাধান খোঁজার কঠোর উদ্যমের পরিণতি।

উর্দু সাহিত্যের অগ্রগতি—বাংলা সাহিত্যের মতোই—এমন ছিল যে গড়পড়তা হিন্দু পাঠক তাতে তেমন আনন্দ পায়নি। দুর্ভাগ্যক্রমে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে উত্তর ভারতের নিজস্ব সাহিত্যসমূহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি কৃত্রিম জাতীয়তাবোধ থেকে, যা প্রায় সাম্প্রদায়িকতার নামান্তর। উত্তর ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলে এ রকম হিন্দু গ্র্যাজুয়েট এবং আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পাওয়া অসম্ভব নয়, যা মনে করে হিন্দি ভাষার প্রতি তাদের কর্তব্য হচ্ছে এক বা দুই জেনারেশন আগেও তাদের পূর্বপুরুষেরা যে ভাষায় পারদর্শিতা দেখিয়েছে, সেই ভাষা ও সেই ভাষার সাহিত্যকে তাদের চিন্তা থেকে নির্বাসিত করা।১৭ আসলে উর্দু সাহিত্যের থিম এমনই যে তা শুধু মুসলমানদেরই আকৃষ্ট করে। বাংলায় আনন্দমঠ যে স্থান দখল করেছে, উর্দুতে সেই স্থান দেওয়া হয় ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত হালির একটি কবিতাকে। হালির ‘মুসাদ্দাস’ কবিতাটি ইসলামের উত্থান ও পতনের একটি কাহিনি। সব উঁচু দরের উর্দু গদ্য—স্যার সৈয়দ আহমদ, মোহাম্মদ আজাদ তাকাউল্লাহ অথবা নাজির আহ্মদ—যাঁরই হোক, এমন বিষয় নিয়ে রচিত, যা শুধু মুসলমানদের উত্সাহিত করে। তাঁরা যে সমাজ পুনর্নির্মাণ করতে চান, তা মুসলিম সমাজ এবং তাই উর্দু সাহিত্যের হিন্দু গ্র্যাজুয়েট বা আন্ডারগ্র্যাজুয়েটকে হালির বিলাপ উত্সাহিত করতে সক্ষম নয়।

যে স্থায়ী ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে পরবর্তীকালে রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহ জন্মলাভ করেছিল, প্রধানত তখনকার স্থায়ী সাহিত্যিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে তার সন্ধান পাওয়া যাবে। কারণ, রাজনৈতিক আন্দোলন শিক্ষিত সমাজেরই মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে। সেই মানসিকতার ছবি সেই সমাজেরই সৃষ্ট সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে সংরক্ষিত।

এই সাহিত্যের স্বভাব এবং উপকরণ, তার প্রবণতা, তার বিষয়বস্তু নির্বাচন, অনুপ্রেরণার উত্স, শুধু এসব থেকেই সে সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহের মৌলিক ধারার প্রকৃতি আমরা জানতে পারি। যে ইন্টেলেকচুয়াল ঐতিহ্য রাজনৈতিক আন্দোলনসমূহে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষিত ভারতীয়দের অশিক্ষিত ভারতীয়দের থেকে আলাদা করেছিল তা ছিল একটি খুব অনিশ্চিত সম্পদ।

তথ্য-সংকেত

১. কলকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮০ সালে। তখন দেশের প্রচলিত আইন ছিল প্রধানত মুসলিম আইন এবং এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম আইনে পারদর্শী তৈরি করা।

            (ক) এ সি ল্যানিয়াল: ‘ক্যালকাটা মাদ্রাসা’, ‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’—জুন ১৯১৪।

            (খ) চার্লস লাশিংটন: দ্য হিস্টরি, ডিজাইন অ্যান্ড প্রেজেন্ট স্টেট অব দ্য রিলিজিয়াস বেনিভোলেন্ট ইনস্টিটিউশনস, ফাউন্ডেড বাই দ্য ব্রিটিশ ইন ক্যালকাটা অ্যান্ড ইটস ভিসিনিটি, পৃ. ১৩৫-৪১।

২. কলকাতা মাদ্রাসার পাঠ্যসূচি সম্পর্কে স্যার ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার লিখেছেন, ‘নব্বই বছর ধরে (অর্থাত্, শুরু থেকেই) কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ ছিল মাদ্রাসার সবচেয়ে প্রিয় পাঠ্য বিষয়।’ ইন্ডিয়ান মুসলমানস (১৮৭৬), পৃ. ২০৪।

৩. দ্য ক্যালকাটা রিভিউ, ১২শ খণ্ড, পৃ. ২১৩-৪৬।

৪. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট ১৮১৩, ধারা ৪৩। বাত্সরিক এক লাখ টাকা ‘সংরক্ষিত থাকবে সাহিত্যের পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়ন ও ভারতের শিক্ষিত নেটিভদের উত্সাহদানের জন্য এবং ভারতের ব্রিটিশ রাজ্যসমূহের জনগণের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রবর্তন ও প্রসারের জন্য।’

৫. ১৮১৩ অ্যাক্টের ৪৩ ধারায় ১৮১৪ সালে হাউস অব কমনসের একটি সরকারি প্রস্তাবের মূলনীতিসমূহ ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়। প্রস্তাবটি অ্যাক্টের এই ধারার চেয়ে বেশি খোলাসা এবং তাতে আরও স্পষ্টভাবে ইংরেজি শিক্ষা বা ধর্মান্তরের সম্পর্কটি আলোচিত হয়েছে। প্রস্তাবটি হচ্ছে:

            ‘এই রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে ভারতের ব্রিটিশ রাজ্যসমূহের নেটিভ অধিবাসীদের স্বার্থ-সুখ বর্ধিত করা এবং এ রূপ কর্মপন্থা অবলম্বন করা উচিত, যা তাদের মধ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতি প্রবর্তনে সহায়তা করবে। উপরিউক্ত উদ্দেশ্যগুলির সাধনকল্পে আইন অনুযায়ী তাঁদের যথোপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে, যাঁরা হিতকর উদ্দেশ্যসমূহ সম্পাদনের জন্য ভারতে যাবেন এবং সেখানে অবস্থান করবেন।’

৬. ‘এ স্কেচ অব দি অরিজিন, রাইস অ্যান্ড প্রোগ্রেস অব দ্য হিন্দু কলেজ’, দ্য ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অবজারভার, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১৫।

৭. প্রসপেক্টাস অব দ্য হিন্দু কলেজ ২৭ আগস্ট, ১৮১৬, দ্য ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অবজারভার-এ উদ্ধৃত, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৫-১১৭।

৮. (ক) সমাচার দর্পণ, ১৮ আগস্ট, ১৮১৯।

            (খ) স্যার ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার: ইন্ডিয়ান মুসলমানস (১৮৭৬), পৃ. ৫১-৫৯।

৯. ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’, বি এন বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৪৭৬-৭৯।

১০. ৪ জুলাই ১৮১৭, ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি ও ১৮ সেপ্টেম্বর ১৮১৮ ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটির পত্তন ভারতে ইংরেজি শিক্ষার উত্সাহী কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ কর্তাদের—যদিও তখনো কোম্পানির সরাসরি পক্ষে নয়—প্রথম পদার্পণ সূচিত করে।

১১. কেরি লিখেছেন: ‘কলেজের বেঙ্গলি ফ্লাকচুয়েটিং এস্টাবলিশমেন্টের পণ্ডিত হর প্রসাদ একটি সংস্কৃত বই অনুবাদ করেছেন। এখন ১০০ কপি বইয়ের সাবস্ক্রিপ্ট আশ্বাস পেলে তিনি বইটি ছাপাতে চান।’ হোম মিসেলেনিয়াস, সংখ্যা ৫৬৩। পৃ. ৩৪৩।

১২. এই কাগজটির প্রকাশনে, মার্শম্যান যার নামমাত্র সম্পাদক ছিলেন, পণ্ডিতদের সহযোগিতা এত প্রয়োজনীয় ছিল যে তাঁরা কোনো কারণে শ্রীরামপুরের বাইরে থাকলে পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ রাখতে হতো—সমাচার দর্পণ, ২৬ অক্টোবর, ১৮৩৩।

১৩. সমাচার দর্পণ, ১৩ ডিসেম্বর, ১৮৩১।

১৪. ‘জেনারেল ক্যারেকটেরিস্টক্স অব দ্য নেটিভ নিউজপেপারস’, দ্য ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অবজারভার, প্রথম খণ্ড (১৮৩২) পৃ. ২০৯-১৮।

১৫. দ্য রিফরমার, ১৮ নভেম্বর, ১৮৩১।

১৬. রাম বাবা শাকসেনা: এ হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান লিটারেচার (১৯২৭), পৃ. ২৬৫-৬৬।

১৭. স্যার টি বি সাপরু: আর বি শাকসেনার, এ হিস্টরি অব ইন্ডিয়ান লিটারেচার-এর ভূমিকা।

মাহমুদ রশীদ অনূদিত