সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা রাষ্ট্রের ওপর কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেনি। সুপ্রিম কোর্টে এখনো ব্যাপক ভিত্তিতে ইংরেজি ভাষা ব্যবহূত হচ্ছে। ভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। আর সে কারণেই এটি মানবাধিকারের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো কী এবং চালু করার পক্ষে যুক্তিগুলো কী, তা তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে কেন বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু করা জরুরি। যেসব দেশে ইংরেজি ভাষার পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেসব যুক্তি কেন বাংলাদেশের বেলায় খাটে না, তা-ও বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: সংবিধান, ভাষা, সুপ্রিম কোর্ট, মামলা, উপমহাদেশীয় দৃষ্টান্ত, আইনি বাংলার অতীত, ভাষা-বিতর্কের প্রাসঙ্গিকতা
প্রারম্ভিক কথা
বিশ্বের নানা দেশের আদালত অঙ্গনের কতিপয় উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক।
২০১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। মালয়েশীয় সুপ্রিম কোর্টে আনোয়ার ইব্রাহিমের আইনজীবী কারপাল সিং নিবেদন করেন যে ফেডারেল কোর্ট, কোর্ট অব আপিল, হাইকোর্ট এবং অধস্তন আদালতগুলোতে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় ক্ষেত্রের মামলার রায়সমূহ বাহাসা মালয়েশিয়ায় লেখা বাধ্যতামূলক। অথচ বিচারপতিরা লিখছেন ইংরেজিতে। আর সে কারণেই তা অবৈধ ও অসাংবিধানিক।১
মালয়েশিয়ার ফেডারেল সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ এবং ১৯৬৩ সালের জাতীয় ভাষা আইনের ৮ ধারা বলেছে, আদালতের রায় বাহাসা মালয়েশিয়ায় লেখা হতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদের বিরুদ্ধে আনোয়ার ইব্রাহিমের আনা মানহানির মামলায় শুনানিকালে সুপ্রিম কোর্টে এই যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তার আগে ২০০৯ সালের ১০ অক্টোবর তিন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত কোর্ট অব আপিল ভাষাগত কারণে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আনোয়ারের আপিল খারিজ করে দেন। ওই প্যানেল বলেন, আনোয়ার আপিলের যে স্মারক পেশ করেছেন, তা ইংরেজিতে লেখা। আর সে কারণেই তা অবৈধ। আদালতের নথিপত্র বাহাসা মালয়েশিয়ায় হতে হবে। মাহাথির মোহাম্মদের আইনজীবী যুক্তি দেন যে আদালতের আগাম অনুমতি নিয়েই তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন। মাহাথিরের আইনজীবী ভি. কে. লিঙ্গম অবশ্য বলেন, আদালতের রায় সর্বদাই বাহাসা মালয়েশিয়ায় হতে হবে।২ আনোয়ারের আইনজীবীর কথা থেকে বুঝতে পারি, বিষয়টি মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার পর সুপ্রিম কোর্টে তিনিই প্রথম তুলেছিলেন।
২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গণমাধ্যমে শীর্ষ শিরোনাম হয়েছিল আদালতের কাঠগড়ায় ভাষানীতি। এতে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকার ১১টি সরকারি ভাষার মধ্যে কেবল ইংরেজি ও আফ্রিকান আদালতের ভাষা হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। বাকি নয়টি ভাষাই আদালতের দোভাষীরা অনুবাদ করছেন।৩
দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধান অনুযায়ী, ‘সরকারি ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে একজন ব্যক্তি সরকারের সঙ্গে যেমন, তেমনি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আদালতের সঙ্গে সেই ভাষায় যোগাযোগ করার অধিকার রাখেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার সংবিধানের 35(3)(K) ধারায় বলা আছে: ‘Every accused person has a right to a fair trial, which includes the right to be tried in a language that the accused person understands or, if that is not practicable, to have the proceedings interpreted in that language.’
প্রকৃতপক্ষে ভাষা ব্যবহারের যে অধিকার, সেটা সরাসরি মানবাধিকারের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং ভাষার অধিকার থেকে মানবাধিকারকে আলাদা করা যাবে না। বাংলাদেশের আদালতের ভাষা বাংলা না ইংরেজি হবে, সে বিষয়টি আমরা বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের আলোকে এতকাল বোঝা ও সে অনুযায়ী প্রতিকার লাভের ব্যর্থ চেষ্টা করেছি। কিন্তু আবেগের জায়গা থেকে না দেখে কেবল মানবাধিকারের জায়গা থেকে দেখেও একটা নির্মোহ আলোচনার সূত্রপাত করা সম্ভব।
১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি মামলা হয়েছিল। একজন জুলুভাষী স্কুলশিক্ষক একটি মোটরযান চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হন। তিনি দাবি করেন যে তাঁর বিচার জুলু ভাষায় হতে হবে। জুলু সংবিধানের অন্যতম তালিকাভুক্ত ভাষা। ভাষার প্রশ্নে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর আবেদন নাকচ করলে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্ট তাঁর দণ্ড বহাল রাখেন এই যুক্তিতে যে, যে ব্যক্তি ইংরেজি কিংবা আফ্রিকান ভাষা জানেন, তালিকাভুক্ত অন্য ভাষায় বিচার পাওয়ার অধিকার তাঁর নেই। কিন্তু হাইকোর্ট স্বীকার করেন যে বিচারপ্রার্থী যে ভাষা বোঝেন, সেই ভাষাতেই তিনি বিচার লাভের অধিকার রাখেন। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে তাঁকে অনুবাদ করে দিতে হবে।৪
আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের বিরুদ্ধে যুক্তি দেওয়া হয় যে ইংরেজি তুলে দিলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিপদে পড়বে। বিদেশিরা বুঝবে না। শিক্ষার মান পড়ে যাবে, ইংরেজি তুলে দিয়ে এমনিতেই খেসারত দিচ্ছি ইত্যাদি। এদিকটিই মূল আপত্তি। তাই আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি যে আমাদের সীমান্তের বাইরে বিষয়টিকে কীভাবে দেখা হচ্ছে। আবার কতিপয় নিবন্ধের ইঙ্গিত হচ্ছে, ইংরেজি তুলে কেবল বাংলাই চালু করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বিচারপ্রার্থী, অনুবাদ ও দোভাষীর মাধ্যমে বিচারক-আইনজীবী সব পক্ষের সন্তুষ্টিকে সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা এখন ইংরেজির পক্ষের যুক্তিগুলো দেখব।
আদালতে ইংরেজি ভাষার পক্ষে যুক্তি
১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার হাইকোর্টে আরেকটি মামলা আসে (এস বনাম মাতোমেলা)। এবার আদালতের পুরো রায়সহ গোটা বিচারপ্রক্রিয়াই দেখা গেল ইসিঝোসা ভাষায় লেখা হয়েছে। হাইকোর্ট এই রায় সমুন্নত রাখলেন। এর যুক্তি হচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তি যে ভাষা বোঝেন, সেই ভাষায় তাঁর বিচার হবে। এখানে লক্ষণীয় যে বিচারক বা আইনজীবী যে ভাষায় সাবলীল, সেই ভাষায় তাঁদের বিচার করার অধিকার কিন্তু স্বীকৃত নয়। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার হাইকোর্টের ওই বিচারক বুঝতে পারলেন যে ভবিষ্যতে অন্য আঞ্চলিক ভাষাভাষীরাও একই অধিকার চাইবে। তখন অনুবাদ ইত্যাদির খরচ বাড়বে। তাই তিনি প্রকারান্তরে ইংরেজির পক্ষে একটি অবিটার বা পর্যবেক্ষণ দিলেন। তিনি বললেন, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়কে আদালতব্যবস্থার জন্য একটি মাত্র ভাষা উদ্ভাবন করতে হবে। সে ভাষা যার যেমনই মাতৃভাষা থাকুক না কেন, সেই ভাষা আদালতের সব কর্মকর্তাও বুঝতে পারবেন। যদিও নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তবু বোঝা যায় যে এই বিচারক কার্যত ইংরেজির দিকে ইঙ্গিত করেছেন।৫
২০০৪ সালে আরেকটি মামলা এল কেপ প্রদেশের হাইকোর্টে। বিচারক ১৯৯৮ সালের ওই মামলার (এস বনাম মাতোমেলা) রায়ের সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, ‘আমরা যে মামলাটি নিয়ে বিচার করতে বসেছি, সেটি দীর্ঘকাল পড়ে ছিল। কারণ, ইসিঝোসা থেকে ইংরেজি করার লোক ছিল না।’ বিচারক মন্তব্য করেন, ‘আদালতের একটি মাত্র পরিভাষা প্রচলনের কথা উঠেছে। এটা কেবল অর্থনৈতিকভাবেই লাভজনক নয়, সেটা ন্যায়বিচারের স্বার্থের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি ইংরেজি ইতিমধ্যেই এমন একটি ভাষা, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক লেনদেনে ব্যবহূত হচ্ছে।’
এখন প্রশ্ন হলো, সংবিধানে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত ১১টি ভাষার দেশের বিচারকের এই মন্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশ একাত্ম হতে পারবে কি না। তার দরকার কতটুকু?
পিনার একজন আফ্রিকানভাষী। তিনি ইংরেজি বলতে বা বুঝতে পারেন না। মাদক অপরাধে তিনি দণ্ডিত হয়েছিলেন। সরকার পিনারের জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করেছিল, যিনি শুধু ইংরেজি বলতে ও বুঝতে পারতেন। অভিযুক্ত তাই এই আইনজীবীকে প্রত্যাহার করার অনুরোধ জানালেন। এটা ঘটেছিল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। এই রায়ের রিভিউকালে বিচারক স্বীকার করেন যে অভিযুক্ত ব্যক্তির এমন আইনজীবী নিয়োগের অধিকার আছে, যাঁর সঙ্গে তিনি তাঁর নিজের ভাষায় কথা বলতে পারবেন, সেটা সরাসরি কিংবা দোভাষীর মাধ্যমেও হতে পারে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে তাঁর এই অধিকার পরিষ্কার করা হয়নি। সে কারণে তাঁর ন্যায্য বিচারের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তির বক্তব্য ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট যেহেতু সঠিকভাবে বিবেচনায় নেননি, তাই তাঁকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও তাঁর দণ্ড বাতিল করা হয়।
পিনারের মামলার বরাত দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ফ্রি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচ জি লুবে লিখেছেন, ‘নর্দান কেপের শতকরা ৭২ ভাগ মামলা আফ্রিকান ভাষায় পরিচালিত হয়। সেেছায়ানা ভাষায় ১৪.৮ ভাগ, ইসিঝোসা ভাষায় ৮.৮ ভাগ এবং ইংরেজি শুধু ১.৪ ভাগ ক্ষেত্রে চলে। জনসংখ্যার বিপুল অংশ ইংরেজি বোঝেন না। তাই এই যুক্তি দেওয়া চলবে না যে আফ্রিকান ভাষায় শুনানি বাস্তবসম্মত নয়। ইংরেজিভাষী ম্যাজিস্ট্রেট ও পিপিদের নিয়োগ করার ফলে বিচার মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগ এমন জায়গায় চলে গেছে যে আদালতের প্রক্রিয়া থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।’৬
কানাডার সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি রায় ইংরেজি ও ফরাসিতে অফিশিয়াল রিপোর্টে ছাপানো বাধ্যতামূলক। কানাডীয় আদালতের দেওয়া ১৯৯৯ সালের একটি রায় (R vs Beaulac 1999) বিবেচনায় নেওয়া চলে। জঁ ভিক্তর বুলাক একটি হত্যা মামলার আসামি। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার আদালতে তিনি অনুরোধ করেন যে তিনি এমন একজন বিচারক ও জুরি দেখতে চান, যাঁরা তাঁর মাতৃভাষা ফরাসিতে কথা বলতে পারবেন। এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। কারণ, একজন বিচারক সন্তুষ্ট ছিলেন যে অভিযুক্ত যথাযথভাবে না হলেও ইংরেজি বুঝতে পারেন। এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্ত ব্যক্তির আপিল গ্রহণ করেন। রায় দেন যে ‘ভাষা বেছে নেওয়ার অধিকার অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকার, এটা প্রক্রিয়াগত নয়।’ এটা প্রক্রিয়াগত হলে আদালত হস্তক্ষেপ করতে পারতেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শুনানিতে কানাডীয় সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, ‘ভাষার অধিকার সব মামলার ক্ষেত্রে অবশ্যই “নিষ্ঠার সঙ্গে” ব্যাখ্যা করতে হবে। এটা কানাডার ভাষা কমিউনিটির উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। ভাষা অধিকার নেতিবাচক কিংবা পরোক্ষ অধিকার নয়।’ ১৯৮৬ সালে ‘ম্যাকডোনাল্ড বনাম সিটি অব মন্ট্রিল’ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক আদালতে ভাষার অধিকার একটি রাজনৈতিক আপস এবং তাই তাকে রক্ষণশীলতার সঙ্গে দেখা উচিত বলে মত দিয়েছিলেন। ১৩ বছরের ব্যবধানে তাঁরা মত পাল্টে বলেন, ভাষা একটি নিরঙ্কুশ অধিকার।৭
বুলাকের মামলায় বিচারপতি বাস্তারাক বলেছেন, ‘ভাষা ব্যক্তির অভিব্যক্তির উপায়ের সঙ্গে এতটাই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত যে যদি কাউকে তাঁর নিজের ভাষায় কথা বলতে না দেওয়া হয়, তাহলে সত্যিকার অর্থে বাকস্বাধীনতা মিলতে পারে না।’ বিচারপতি বাস্তারাক কানাডার উচ্চ আদালতে সংখ্যালঘুর মাতৃভাষা অধিকার প্রতিষ্ঠায় একজন পথিকৃত্। তিনি ওই রায়ে বলেন, ভাষার সাহায্যে মানুষ তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ, তার পরিচিতি এবং স্বতন্ত্রবোধেরও প্রতিফলন ঘটিয়ে থাকে।
কানাডায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হতে হলে তাঁকে দোভাষীর সাহায্য ছাড়াই ইংরেজি ও ফরাসি জানার শর্ত পূরণ করতে হয় না। যদিও কানাডার অন্যান্য ফেডারেল বিচারকের সব পদে দুই ভাষায় সমান পারদর্শিতা থাকা পূর্বশর্ত। বাংলাদেশে ঠিক কোন ভাষার দখল যাচাই করা হয়, তা অনুমান করা এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই মুহূর্তে কানাডার সংসদে পাঁচটি বিল বিবেচনাধীন, যাতে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক হতে দুই ভাষাতেই দোভাষী ছাড়া কাজ চালাতে যোগ্যতা অর্জনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে ইংরেজির পক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়, তা অন্য কোনো সমাজে আপাতত পাওয়া যায় না। অকিঞ্চিত্কর অভিজ্ঞতার কারণে আমরা এই তর্কটা একেবারে নাকচ করি না। তবে এর প্রবক্তাদের জবানি থেকে আমরা অন্যান্য দেশের আদালতের ভাষাসংক্রান্ত অভিজ্ঞতার বিষয়টি ভাগাভাগি করে নিতে চাই।
হংকংয়ের আইনে বলা আছে, একজন বিচারক, হাকিম কিংবা অন্য বিচারিক কর্মকর্তা যেমনটা মনে করেন, তেমন বিবেচনায় সরকারি ভাষা নির্দিষ্ট করে নিতে পারেন। তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সম্প্রতি তুরস্কের পার্লামেন্ট আদালতের ভাষা হিসেবে কুর্দি মেনে নিয়েছে। তুরস্কের সংখ্যালঘু কুর্দিরা দীর্ঘদিন ধরে আদালতে কুর্দি ভাষায় বক্তব্য পেশের অধিকার চেয়ে আসছিল। এত দিন পর্যন্ত কুর্দিদের তুর্কি ভাষায় আদালতে কথা বলতে হতো।৮
উপমহাদেশীয় দৃষ্টান্ত
এবার উপমহাদেশের দিকে নজর দেওয়া যাক। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯। বিকেল চারটা। ভারতীয় গণপরিষদের অধিবেশনের সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ বলেন, ভাষা অনুচ্ছেদটি এক মস্ত ব্যতিক্রম। এতে ৩০০-এর বেশি সংশোধনী পড়েছে। ওই দিনের মূল বক্তা এন গোপালস্বামী আয়াঙ্গার বলেন, এই প্রশ্নে মতামত সব সময় সর্বসম্মত হয় না। আমাদের এমন একটি অভিন্ন ভাষা বেছে নিতে হবে, যা হবে সর্বভারতীয়। উচ্চ আদালতের ভাষা ‘আরও বহু বছর’ ইংরেজি থাকবে। হিন্দি যথামর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ইংরেজি চালিয়ে নিতে হবে। হিন্দি আমরা নেব, সেটা কেবল ভারতীয় ভাষা বলে নয়, নেব এ কারণে যে তত দিনে হিন্দি স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হবে, যেমন আজ হয়েছে ইংরেজি।৯
কিছুকাল আগে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একজন ইন্টারভেনর শুনানিকালে হিন্দিতে বক্তব্য দিতে চাইলেন। কিন্তু তাঁর প্রতিপক্ষের আইনজীবী আপত্তি তুললেন। বললেন, হিন্দি বুঝতে তাঁর অসুবিধা হয়। সুপ্রিম কোর্ট তখন ওই ইন্টারভেনরকে তিনটি বিকল্প দেন। ১. ইংরেজিতে কথা বলা ২. আইনজীবী নিয়োগ ৩. কিংবা ইংরেজিতে লিখিত বক্তব্য প্রদান। কিন্তু এর কোনোটাই তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। এরপর সুপ্রিম কোর্ট আদালতের ভাষা ইংরেজি হওয়ার যুক্তিতে তাঁর ইন্টারভেনশন বাতিল করেন। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ব্রজ বি কাছেরু ও অধ্যাপক যমুনা কাছেরু এবং নিউইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এস এম শ্রীধর ল্যাঙ্গুয়েজ ইন সাউথ এশিয়া (কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮) শীর্ষক বইয়ের ৩৬৮ পৃষ্ঠায় এ ঘটনাটি উল্লেখ করে বলেন, এটা একটা কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় যে মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর জোরালো সমর্থন সত্ত্বেও হিন্দি সরকারি ভাষা হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি পায়নি।
পাকিস্তানের যে মহানায়ক (জিন্নাহ) বারুদে অগ্নিসংযোগ করে বলেছিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, সেই দেশটির উচ্চ আদালতের ভাষা আজও কিন্তু রয়ে গেছে ইংরেজি। উর্দু সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। সামরিক শাসন থেকে শুরু করে নানা ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ধারা আমরা পাকিস্তানের কাছ থেকে পেয়েছি। অর্থাত্ তুলনাটা বেশ ভালোভাবেই করতে পারি। অনেক মন্দ কিছুর সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যায়। এবার অবাক হয়ে দেখলাম, এখানেও কী অদ্ভুত মিল! আমাদের আদালতেও বাংলা ভাষায় আরজি লেখার দরখাস্ত খারিজ হয়। পাকিস্তানের আদালতেও উর্দুকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণার দরখাস্ত বাতিল হয়। সানাউল্লাহ নামের এক ব্যক্তি লাহোর হাইকোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করেছিলেন। তাঁর নিবেদন ছিল: ‘জাতির জনক কায়েদ-ই-আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকায় এক ছাত্র সমাবেশে ঘোষণা করেছিলেন, উর্দু হবে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা। ৬৪ বছর কেটে গেল, সেটা করা হলো না। বরং ইংরেজিকে করা হলো সরকারি ভাষা।’ ২০০১ সালের অক্টোবরে ওই মামলাটি যখন কার্যতালিকায় এল, তখন আবেদনকারী বা তাঁর আইনজীবীকে আদালত দেখতে পাননি। সে কারণে লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি খাজা মুহাম্মদ শরিফ আবেদনটি খারিজ করেন।
২০০৩ সালের ১৮ নভেম্বর সিন্ধু হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারকে ইংরেজির পরিবর্তে উর্দু প্রতিস্থাপনের সাংবিধানিক ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানানোর নির্দেশ দেন। আবেদনকারী আদালতে বলেন, উর্দু পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা। ১৯৭৩ সালের ১৪ আগস্ট থেকে ১৫ বছরের মধ্যে আদালতের ভাষা উর্দু করতে সংবিধানে ঘোষণা ছিল। ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট এই সময় উত্তীর্ণ হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী সৈয়দ তারিক আলী আদালতে বলেন, অন্তত তিনটি প্রদেশে সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দু ব্যবহূত হচ্ছে। এই অঞ্চলের আদালতগুলোতেও উর্দুতে আবেদন-নিবেদন করা যাচ্ছে। জাতীয় ভাষা কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সংগঠন কাজ করছে। সরকার সম্প্রতি একটি উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং উর্দুর উন্নয়নে কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।১০
আদালত চাইলে এ রকম বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো আদেশ দিতে পারেন। কারণ, প্রশ্নটির সঙ্গে জনস্বার্থ ও জনগণের মৌলিক অধিকারের নাড়ির সম্পর্ক বিদ্যমান। কিন্তু তাঁরা তা দেননি। যেমন বাংলাদেশে আদালত জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বহু বিষয়ে সুয়োমোটো রুল দিচ্ছেন। কিন্তু এরশাদের আমলে করা ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনের প্রয়োগহীনতা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের জন্য জারি করা পরিপত্রে বলা হয়েছিল, সব সরকারি অফিসে বাংলা চলবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু আদালত ছিলেন এর বাইরে। কারণ, তাঁরা সরকারি অফিস নন। কিন্তু অন্য বহু ক্ষেত্রে দেখি, আদালত প্রশাসন ‘সরকারি’ শব্দের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করেন না। তথ্য অধিকার আইনে বর্ণিত ‘সাংবিধানিক সংস্থা’র মধ্যে তাঁরা পড়েন কি পড়েন না, এ নিয়ে তাঁরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন বলেই প্রতীয়মান হয়। অবশ্য ১৯৮৭ সালের আইনে আদালত শব্দটি আছে। কিন্তু ‘উচ্চ আদালত’ বলা নেই।
মাননীয় বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি কে এম ফজলুর রহমান প্রমুখ বাংলায় রায় লিখে মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু তাঁরা এখনো ভীষণ সংখ্যালঘু। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায় বাংলায় লিখতে গিয়ে তাঁর সময় একটু বেশি লেগেছিল। কিন্তু তবু তিনি সেটা করেছেন, কারণ চায়ের দোকানে, চুলার পাশে বসেও সাধারণ মানুষ যাতে এই রায়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। বুঝতে পারেন। তিনি বাংলায় রায় লেখার কারণ সম্পর্কে জন মার্শালকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘the judicial department comes home in its effects to every man’s fireside: বাক্যটি পুরো তিনি দেননি। এরপর লেখা: passes on his property, his reputation, his life, his all.
ইংরেজিতে রায় লেখার কারণে বিচারপ্রার্থী জনগণ বুঝতেই পারেন না যে একটি রায় কীভাবে তাঁর জীবন ও পরিমণ্ডলের সবকিছুকে স্পর্শ করেছে। কিন্তু আমাদের কজন ফাঁসির আসামি রায় পড়ে বা বুঝে মরতে পারছেন, এর উত্তর উচ্চ আদালতকেই দিতে হবে। আবেগের জায়গা থেকে নয়, বরং বিচারপ্রার্থী জনগণের বোধগম্য একটি ভাষা হিসেবে বিবেচনায় নিয়েও এটা করতে হবে। বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের আলোকে এটা বলা কি অতিরঞ্জিত হবে যে আমাদের উচ্চ আদালতের রায় বা কার্যক্রম এখনো পর্যন্ত প্রধানত বিচারক ও আইনজীবীর চেম্বারকেন্দ্রিক রয়ে গেছে? এটা এখনো ফায়ারসাইড বা চুলার পাশে পৌঁছায়নি। আমাদের ভাবতে ভালো লাগত, যদি দেখা যেত যে, কেবল আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখেই ইংরেজিতে রায় লেখা হচ্ছে। বরং মনে হচ্ছে, বাংলাকে যেন প্রবেশই করতে দেওয়া হবে না এমন একটি মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। সে কারণেই কি বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলছেন যে সংসদ না চাইলে উচ্চ আদালতে বাংলা ঢুকবে না?
ভারত ও পাকিস্তানের মতো নয় কিন্তু আমাদের সংবিধান। বাংলাদেশ সংবিধানের সাধারণ ঘোষণা: প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ব্যস এটুকুই। পৃথিবীর বুকে আমরা নিজেদের গর্ব করে বলি: ১৯৭১ সালে আমরা রক্তস্নান করে স্বাধীনতার যে সূর্য ছিনিয়ে এনেছি, সেটার ভ্রূণ নিহিত ছিল বায়ান্নর গর্ভে। ভাষা থেকে স্বাধীনতা। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ঘোষণাকালে ইউনেসকোর ঢাকার আবাসিক প্রতিনিধি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনাদের এই দাবি ঠিক নয় যে মাতৃভাষার জন্য কেবল আপনারাই রক্ত দিয়েছেন। নজির আরও আছে।’ কিন্তু ভাষার প্রশ্ন থেকে জাতিসত্তার বিকাশ এবং সেখান থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের ইতিহাস এই ধরিত্রীতে আর কারও দ্বারা সাধিত হয়েছে বলে জানা নেই।
ভারতের অভিজ্ঞতা হতে পারে আমাদের মূল আকর্ষণ। কারণ, কেন্দ্রীয় ভারতের কোনো একক রাষ্ট্রভাষা নেই। সেটা না থাকা সত্ত্বেও সেখানে ভেতরে ভেতরে কী ঘটছে, সেটা আমাদের জানা দরকার।
২০১০ সালের ২৫ জানুয়ারি টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটি খবর ছিল এ রকম: ‘ভারতের কি কোনো জাতীয় ভাষা রয়েছে?’ গুজরাট হাইকোর্ট উত্তর দিয়েছেন, না। আদালত অবশ্য বলেছেন, ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ হিন্দিকে তাদের ভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছে। অনেকেই হিন্দিতে কথা বলে, দেবনাগরিতে লেখে। কিন্তু হিন্দি তাই বলে ভারতের জাতীয় ভাষা নয়।
প্রধান বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ এ রকম নির্দেশনা দিতে বেঁকে বসেন যে ভারতীয় সব পণ্যের মোড়কে হিন্দি লেখা থাকতেই হবে। ২০০৯ সালে সুরেশ কাচাদিয়া জনস্বার্থে একটি মামলা করেছিলেন। তিনি নির্দেশনা চেয়েছিলেন যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার যেন এ রকম নির্দেশ দেন, যাতে রাজ্য সরকারগুলো এটা নিশ্চিত করে যে যেখানে যত পণ্য উত্পাদিত হচ্ছে, তার মোড়কে দরকারি তথ্যাদি হিন্দিতে লেখা থাকতে হবে। তাঁর যুক্তি ছিল ভোক্তারা এটা জানতে অধিকারপ্রাপ্ত যে তাঁরা কী বস্তু ভোগ করছেন। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল হিন্দি যেহেতু জাতীয় ভাষা এবং অধিকাংশ মানুষ সে ভাষাটা বুঝতে পারেন, সুতরাং বিস্তারিত লেখার বাধ্যবাধকতা হিন্দিতেই আরোপ করা হোক। আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পক্ষই অবশ্য এটা দেখাতে পারেনি যে ভারতের ইতিহাসে হিন্দিকে কখনো জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ভারতের সংবিধানে হিন্দিকে ‘সরকারি’ ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ‘জাতীয়’ ভাষার নয়। আদালত তাঁর উপসংহারে বলেন যে বিদ্যমান বিধিতে উত্পাদনকারীদের বলা হয়েছে যে তাঁরা পণ্য সম্পর্কে প্যাকেটে হিন্দি অথবা ইংরেজিতে লিখবেন। সুতরাং যাঁরা ইংরেজিতে লিখছেন, সেটা তাঁদের অধিকার। সে কারণে তাঁদের ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যায় না।১১
২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল দ্য হিন্দু পত্রিকায় একটি খবরের শিরোনাম ছিল তামিলকে হাইকোর্টের ভাষায় পরিণত করার দাবির ব্যাপারে। চেন্নাইয়ে মুখ্যমন্ত্রী এম করুণানিধি সুপ্রিম কোর্ট এবং মাদ্রাজ হাইকোর্টকে আহ্বান জানান যে তামিলকে যাতে উচ্চ আদালতের ভাষায় পরিণত করা হয়। তাঁর কথায়, আমরা সুপ্রিম কোর্টেও তামিল ভাষা শুনতে চাই। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মাদ্রাজ হাইকোর্টের ভাষা হোক তামিল। এবং এই উদ্দেশ্য অর্জনে বিচারকেরা যেন উদ্যোগ নেন। ভারতের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা বি আর আম্বেদকারের ভাস্কর্য উন্মোচন উপলক্ষে অনুষ্ঠান হয়। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পি সত্যশিবম, মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এইচ এল গোখলে এবং বিচারপতি এফ এম ইব্রাহিম কলিফুল্লাহ তামিল ভাষায় সেখানে বক্তব্য দেন। অবশ্য তামিলনাড়ুতে তামিল ভাষা আদালতে চালুর জন্য প্রবল আন্দোলন গড়ে উঠেছে। আদালতে তামিল ভাষার জন্য গণ-অনশনও হয়ে গেছে। জয়ললিতাসহ সব বড় নেতাই রাষ্ট্রপতির কাছে এ জন্য ধরনা দিয়েছেন। ২০১০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর চেন্নাইয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সালমান খুরশিদ আদালতের ভাষা হিসেবে তামিল চালুর বিষয়টি সমর্থন করেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতে তামিল চালুর আগে নিম্ন আদালতে প্রথমে রায়ের মূল বিষয়বস্তু তামিল ভাষায় লেখা বাধ্যতামূলক করা হোক। তিনি এ জন্য তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে অনুবাদক নিয়োগেরও পরামর্শ দেন।১২
আদালতে আঞ্চলিক ভাষা, মানে মাতৃভাষা চালুর দাবিতে সারা ভারতে যে মনোভাব দিন দিন প্রকাশ পাচ্ছে এবং সাফল্যও আসছে, তাতে একদিন কলকাতা হাইকোর্টেও বাংলা আসবে। সেদিনও ঢাকার হাইকোর্ট ভবিষ্যতের কলকাতাকে অনুসরণ করতে পারার সক্ষমতা অর্জন করবে কি না, সেটা হলফ করে বলা যায় না। কারণ তেমন কোনো প্রস্তুতি নেই। ভারতের আদালতে মাতৃভাষায় তৃষ্ণা মেটানোর প্রবণতা বাড়ছেই। যদিও কেন্দ্রীয় ভারত সরকার ও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এখনো ইংরেজিতে অটল।
২০১০ সালের ২৩ জুন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয় যে হাইকোর্টগুলোতে আঞ্চলিক ভাষা চালু করতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্দেশনা চেয়ে ওই আবেদন করা হয়। অল ইন্ডিয়া জুনিয়র অ্যাডভোকেট অ্যাসোসিয়েশন হলো এই মামলার আবেদনকারী। সমিতি বলেছে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোতে উচ্চ আদালতে আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন ঘটাতে হবে। আর একই সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষা থেকে একযোগে ইংরেজি ভাষায় তা অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে।
ওই সমিতির সভাপতি এন রাজা রমন বলেছেন, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশের হাইকোর্টে ইতিমধ্যেই হিন্দি ভাষার প্রচলন ঘটেছে। এখন যদি একই ধরনের সুবিধা অন্য রাজ্যগুলোর হাইকোর্টের জন্য নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে তা হবে বৈষম্যমূলক। মৌলিক অধিকার ভোগের সমতা এবং বাকস্বাধীনতার সমতার যে নীতি, তার লঙ্ঘন ঘটবে। পিটিশনে আরও উল্লেখ করা হয়, আঞ্চলিক ভাষায় যদি আদালতে সওয়াল-জবাব ও শুনানি করতে না দেওয়া হয়, তাহলে ওই চারটি রাজ্যের তুলনায় তারা আইনের সমতার নীতি থেকেও বিচ্যুত হবে।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট ২০১১ সালে তাঁর আদালতে অনুবাদকাজের জন্য আটজন অনুবাদককে নিয়োগ দিয়েছেন। সবাই মুসলমান। তবে রাজ্যে পরিবর্তনের হাওয়া বইলেও আমরা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এখনো ইংরেজি প্রশ্নে আপসহীন অবস্থা দেখি। ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি বালাকৃষ্ণাণের যুক্তি: এখনো সময় আসেনি। হিন্দিকে আরও সমৃদ্ধ ও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে হবে। সুপ্রিম কোর্টে একটি অভিন্ন ভাষা থাকতে হবে। একাধিক আঞ্চলিক ভাষা চালুর সুযোগ এখানে নেই।
লক্ষণীয় যে এই সাবেক প্রধান বিচারপতি কিন্তু যুক্তি দেননি যে ইংরেজি ছাড়লে ভারত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে। তিনি হিন্দি পরিভাষার ওপর জোর দিয়েছেন। আবার এটাও সত্য যে ভিন্নমত সত্ত্বেও ভারতের চারটি অঙ্গরাজ্যের উচ্চ আদালতের ভাষা হিসেবে ইংরেজির পরিবর্তে মাতৃভাষা ঠাঁই করে নিয়েছে।১৩
আইনি বাংলার অতীত
আইনি বাংলা গদ্যরীতির পথিকৃত্ জনাথন ডানকান। আদালতের ভাষা ও তাঁর রায় আদেশ ডিক্রি ইত্যাদির সঙ্গে সুশাসনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রায় ২৫০ বছর আগে ইংরেজরা এই সহজ জিনিসটা বুঝেছিলেন। কিন্তু বাঙালি হিসেবে আমরা আজও তা বুঝতে চাই না। সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশরা বিচারকার্যে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে শুরু করে। কিন্তু ১৭৬৫ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জন্য সরকারিভাবে মোগলদের দেওয়ানি পদ গ্রহণের পরেই কেবল তাঁরা আনুষ্ঠানিক বিচারকার্যে মনোনিবেশ করেন। ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর হিসেবে দায়িত্বভার নিয়েই বিচারব্যবস্থা ও কোন আইন কীভাবে প্রয়োগ করা হবে, সে বিষয়ে মনোযোগ দেন। এখানেও দেখা যায়, আইন কোথায়, কীভাবে ব্যবহূত হবে, তা নির্ধারণে স্থানীয় জনসাধারণের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্যতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হেস্টিংস ও তাঁর সতীর্থদের মূলমন্ত্র ছিল, তাঁরা ব্রিটিশ কমন ল ভারতীয় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবেন না।১৪
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক মিনা ড্যান তাঁর এক নিবন্ধে১৫ দেখান যে আজকের যে পরিশীলিত বাংলা গদ্যরীতি, তা ডানকান উদ্ভাবিত আইনি গদ্যরীতির কাছে ঋণী। কারণ, তিনি যখন বাংলায় আইন রচনায় হাত দেন, তখন তাঁর সামনে অনুসরণ করার মতো কিছুই ছিল না। পরে সাধারণের জন্য গদ্য রচয়িতারা তাই তাঁকেই অনুসরণ করেন।
১৭৯৫ সালে বোম্বের গভর্নর হয়েছিলেন ডানকান। ১৭৮৫ সালে তিনি প্রথম বাংলায় আইনি গ্রন্থের সূচনা করেন। একই সময়ে আইনি বাংলার আরেক দিকপাল ছিলেন প্রাচ্যবাদী হেনরি পিটস ফস্টার। ১৭৮৩ সালের ৭ আগস্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা সার্ভিসে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তিনি চব্বিশ পরগনার দেওয়ানি আদালতের রেজিস্ট্রার হয়েছিলেন ১৭৯৪ সালে। তাঁকে বাংলা ভাষায় প্রথম অভিধান রচয়িতার সম্মান দেওয়া হয়। তাঁর বইয়ের প্রথম অংশ ‘ইংলিশ অ্যান্ড বেঙ্গলি ভোকাবুলারি’ ১৭৯৯ সালে কলকাতায় প্রকাশ পায়। এই বইয়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে, এই কাজ রাজনৈতিক ও সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ ছাড়াও নানাবিধ বাস্তব কারণে গৃহীত হয়েছে।১৬
সেই সময় সরকারিভাবে বাংলা একটি অপ্রচলিত ও অননুমোদিত মাতৃভাষা ছিল। তখন আদালতের ভাষা ছিল ফারসি এবং সেটা ক্রমাগতভাবে বাংলাভাষীদের জন্য ছিল দুর্বোধ্য। তখন ফস্টার তাঁর ইউরোপীয় বন্ধু কেরি, মার্শম্যান এবং শ্রীরামপুরের অন্যান্য মিশনারি এবং আইনজীবী রামমোহন রায় ও তাঁর বন্ধুদের সহযোগিতায় বাংলা প্রসারে সচেষ্ট হন। তাঁদেরই উদ্যোগে প্রেসিডেন্সির সরকারি ভাষা হয়েছিল বাংলা। ১৮০২ সালের ২৬ আগস্ট কলকাতা গেজেটে ‘বেঙ্গলি ভোকাবুলারি’ বিষয়ে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল।
১৮৮১ সালে বঙ্গদর্শনে বাংলা ভাষার ওপর প্রকাশিত এক নিবন্ধে মানবতাবাদী পণ্ডিত ও লেখক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিন ধরনের বাংলা গদ্যের উল্লেখ করেছিলেন। ফারসি-ঘেঁষা বাংলা, সংস্কৃতজাত বাংলা ও ইংরেজি-ঘেঁষা বাংলা। এটা দেখার বিষয় যে বাংলা যখন একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা হিসেবেই বিকশিত হয়নি, তখন আইনি বাংলা জনগণের মনে স্থান পেয়েছে। আর এখন বলা হচ্ছে, আইনি বাংলা অধিকতর জটিল। অনুবাদক পাওয়া যায় না।
১৭৪৩ সালে পর্তুগিজ মিশনারি ম্যানুয়েল দি আসুম্পশাঁও তাঁর বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থে লিখেছিলেন, বাংলা একটি শুদ্ধ ভাষা নয়। এটি হিন্দুস্তানি ও সংস্কৃতের মিশ্রণ। ১৭৭৮ সালে নেথানিয়েল হ্যালহেড প্রথম প্রকাশ করেন তাঁর গ্রামার অব দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ। এর ভূমিকায় হ্যালহেড বলেন, ‘বাংলা ভূখণ্ড বহু রকমের রাজনৈতিক বিপ্লব প্রত্যক্ষ করেছে। এর ফলে তার ভাষার সারল্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’১৭
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনা ড্যান লিখেছেন, ‘১৭৮৫ সাল থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত আইনের অসংখ্য বাংলা বই বেরিয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগের আগে ভারতীয় আইনের সূত্র ছিল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, ইসলামি ধর্মগ্রন্থ এবং স্বৈরশাসকদের খেয়াল-খুশি।’ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা ফৌজদার, দারোগা, কোতোয়াল, দেওয়ান, কানুনগো, কাজি, নাজির ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত ছিলেন। সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। ১৬৬১ সাল থেকে ক্রমাগতভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিরোধ ভারতের মাটিতে ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী নিষ্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে থাকে। তারা দেওয়ানি আদালত, ফৌজদারি আদালত, কালেক্টর অফিস কিংবা কাছারি, মেয়রের আদালত ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭৫ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সুপ্রিম কোর্ট।
গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস আইন কোষ সংকলনের জন্য সংস্কৃত ভাষার ২০টি শাখায় দক্ষ ১১ জন বাঙালি পণ্ডিত নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। এতে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত হিন্দু ও মুসলিম আইনগুলো সংকলন করা হয়েছিল। পণ্ডিতেরা বাংলা মাধ্যম থেকে ফারসিতে অনুবাদ করেন। এরপর ফারসি থেকে ১৭৭৬ সালে এই আইনকোষ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড। এটা ইতিহাসে জেন্টু (হিন্দু) কোড হিসেবে পরিচিত। এই সংস্করণে ফারসি ও বাংলা প্রতিশব্দের সারণি তৈরি করা হয়েছিল। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মারকো ওয়েন লিখেছেন, ওই আইনকোষে ভুলত্রুটি ছিল। কিন্তু সেটা ছিল বাস্তবসম্মত একটি ডাইজেস্ট। সে কারণেই ঊনবিংশ শতাব্দীজুড়ে এটা চলেছে। মন্দ অনুবাদ বলে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কারণ, তা মানুষের দরকার মিটিয়েছে।১৮ এখানে দেখার বিষয় হলো, বাঙালির কাছে পৌঁছাতে বিদেশি শাসকেরা সংস্কৃত থেকে ফারসিতে অনুবাদ করার মাধ্যমে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, যাতে করে স্থানীয় আইনকানুন ও জনগণের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু আড়াই শ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকেরা ব্রিটিশদের করে যাওয়া সেই আইনি বাংলার সমৃদ্ধির যুগেও অনুবাদ করতে নারাজ। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট পরিভাষার ঘাটতির যুক্তি দেন। কিন্তু তাঁরা কি কখনো ব্রিটিশদের মূল বাংলা পাণ্ডুলিপি খতিয়ে দেখেছেন?
এরপরের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনূদিত গ্রন্থের মধ্যে সবার আগে, ১৭৮৫ সালে প্রকাশিত হয় জনাথন ডানকানের রেগুলেশনস ফর দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিস ইন দ্য কোর্স অব দেওয়ানি আদালত, এরপর ১৭৯১ সালে নেইল বেঞ্জামিন অ্যাডমান্ডস্টোন বের করেন বেঙ্গল ট্রান্সলেশন অব রেগুলেশন ফর দি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিস। এটা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার ফৌজদারি আদালত পরিচালনার জন্য প্রস্তুত করা হয়। ১৭৯৩ সালে হেনরি পিটস ফস্টার গভর্নর রেগুলেশন ফর ১৭৯৩ প্রকাশ করেন। ইংরেজ কর্মকর্তারা বাংলা শিখে তাঁরা জনগণের শাসনের ভাষা বাংলায় বের করেছিলেন। মিনা ড্যানের বর্ণনায় কাজটি করতে গিয়ে জনাথন ডানকান অন্তত তিন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছিলেন। প্রথমত, ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদে তিনি কোনো সহায়তা পাননি। কারণ, তিনিই ছিলেন এর স্রষ্টা। দ্বিতীয়ত, তাঁকে বাংলা গদ্যরীতি সৃষ্টি করতে হয়েছিল। তৃতীয়ত, আইনি ভাষা এমনিতেই জটিল ছিল। ফলে এটাকে জনগণের কাছে বোধগম্য করে তোলাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। প্রথম তিনটি গ্রন্থ অনুবাদের মধ্যে প্রথম এবং তৃতীয়টি দ্বিতীয়টির তুলনায় অনেক বেশি সাফল্য বয়ে এনেছিল। দ্বিতীয় অনুবাদ গ্রন্থ বাংলা গদ্যরীতিতে সাবলীল হতে না পারায় অনুবাদক ফারসির ওপর যথেষ্ট নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। ফারসি ছিল তখন প্রদেশের ভাষা। আর এই অনুবাদ গ্রন্থ বর্তমানেও উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। আইনের পরিভাষায় ফারসি ও আরবির ছড়াছড়ি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভাষা-বিতর্কের প্রাসঙ্গিকতা
বাংলাদেশে আইনের পরিভাষা তৈরির সরকারি উদ্যোগ কোথায়? ১৯৯৮ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে গঠিত ‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ কখনো আইন আদালত প্রসঙ্গ মুখে তুলেছে বলে জানা যায় না। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সরকারি ভাষা নামে একটি বিভাগ আছে। ১৯৭৬ সালে ভারতীয় সংসদে প্রথম সরকারি ভাষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়। ১৯৬৩ সালে পাস হয়েছিল সরকারি ভাষা আইন। ওই আইনের ৪(১) ধারার আওতায় গঠিত সংসদীয় কমিটি তার এক প্রতিবেদনে আইনের ক্ষেত্রে হিন্দি প্রচলনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এরপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে মতামত নেওয়া হয়। সংসদীয় কমিটি সংবিধানের ৩৪৮ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করে। যুক্তি দেওয়া হয় যে ওই অনুচ্ছেদ সংশোধন হলে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগ প্রতিটি আইনের মূল খসড়া হিন্দিতে করতে পারবে। এ ছাড়া ৩৪৮ অনুচ্ছেদ সংশোধনের পর সুপ্রিম কোর্টকে বলতে হবে, যাতে তাঁরা তাঁদের রায়, আদেশ, ডিক্রি ইত্যাদি হিন্দিতে দেওয়া শুরু করেন। তাহলে সরকারি বিভিন্ন বিভাগ, যাঁরা বিচারিক বা আধা বিচারিক কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা হিন্দিতে আদেশ দিতে পারবেন। বর্তমানে এসব সরকারি বিভাগ হিন্দিতে আদেশ দিতে অক্ষম। কারণ, তাঁদের আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট/ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে হলে তা ইংরেজিতে করা বাধ্যতামূলক। ভারতীয় রাষ্ট্রপতি এই সুপারিশ পেয়ে এ বিষয়ে আইন কমিশনের মতামত নেন। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ বিভাগে পাঠান।
আইন কমিশন সংসদীয় কমিটির সুপারিশ সম্পর্কে মতামত জানতে চেয়ে বিশিষ্ট আইনবিদ, বিশেষ করে কয়েকজন সাবেক বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর কাছে তা পাঠায়। ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি ওয়াই ভি চন্দ্রচুড বলেন, ‘আমি আদালতে হিন্দি প্রচলনের বিরোধী। সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের রায় হিন্দিতে চলবে না। কারণ, এসব আদালতের বিচারকেরা সারা ভারত থেকে আসেন। তাঁরা হিন্দির সঙ্গে পরিচিত নন। নতুন প্রজন্মকে ইংরেজির সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়।’১৯ বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের জন্য এ ধরনের যুক্তি গ্রহণযোগ্য বা প্রাসঙ্গিক নয়।
বিচারপতি এস নটরাজন অবশ্য বলেন, ‘যতই সদিচ্ছা থাক বাস্তবতা হলো, দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের মানুষ আইনের ভাষা হিন্দি হওয়া পছন্দ করবেন না। বহু আইনজীবী হিন্দিই জানেন না। তাঁদের ইংরেজি অনুবাদের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। বিশ্ব চলে ইংরেজিতে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদালতও ভারতের আদালতের রায় উদ্ধৃত করে। উপরন্তু ভাষাগত উগ্র স্বদেশিদের জন্য ভারতের ঐক্য ও অখণ্ডতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।’২০
বিচারপতি ডি টি টমাস যুক্তি দেন, ইংরেজি ভারতীয় বিচারব্যবস্থার জন্য এক ঐতিহাসিক অর্জন। কারণ, বিশ্বব্যাপী বিচার বিভাগের ভাষা হলো ইংরেজি। তা ছাড়া বাস্তব কারণ, দক্ষিণ ভারতের হাইকোর্টগুলোর ৯০ শতাংশ আইনজীবী হিন্দি জানেন না। হিন্দি জানা একজন স্টেনোগ্রাফারও সেখানে পাওয়া যাবে না। সব আইনি সাময়িকী ও বইপুস্তক ইংরেজিতে লেখা। অনুবাদ করতে কোটি কোটি টাকা খরচ হবে। সারা ভারতে রাজনৈতিক ও আইনি অস্থিরতা তৈরি হবে, যা এড়ানো যাবে না।২১
বিচারপতি কে জগন্নাথ শেঠি শুধু ইংরেজিতেই ভবিষ্যত্ দেখেন। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে প্রশাসন আঞ্চলিক ভাষায় আদেশ দেয়। আদালত চলে ইংরেজিতে। আজ ইংরেজি কোনো বিদেশি ভাষা নয়।’২২ কিন্তু আমাদের জন্য এসব কথা এতটা জোরালোভাবে কি খাটে? আমাদের সব আইনজীবী ও বিচারক যাঁরা ইংরেজিতে অনলবর্ষী, তাঁরাও বাংলা বলতে ও বুঝতে পারেন।
২০০৮ সালে ভারতের আইন কমিশনের রিপোর্টে আমরা দেখি, অধিকাংশই ইংরেজির পক্ষে। তবে শতভাগ নন। বিচারপতি বিপি জীবন রেড্ডি কোনো মত না দিয়ে বিষয়টি সরকারের ওপর ছেড়ে দেন। বিচারপতি এম এন ভেঙ্কটাচারিয়া বলেন, ‘উচ্চ আদালত ব্যতিক্রম হতে পারে না। সংসদীয় কমিটির সুপারিশের গুরুত্ব দেওয়া যথার্থ। তাড়াহুড়ো না করে শুরুটা করা উচিত।’২৩ ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি এ এম আহমেদি বলেন, ‘কোনো হাইকোর্ট হিন্দি চালু করবে কি না, তা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের গভর্নরের ওপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত।’২৪ উল্লেখ্য, ভারতের আইনে হাইকোর্টে মাতৃভাষা চালুর এখতিয়ার গভর্নরকে দেওয়া আছে।
ভারতের বিখ্যাত বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণা আয়ার মনে করেন, ‘ভারতের জনগণের বিচার লাভের অধিকারের ওপর ভাষাগত, শব্দার্থতাত্ত্বিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাপ্তি রয়েছে। কারণ, ভারতে ১৬ বা তার বেশি ভাষা রয়েছে। বহু রাজ্যে হিন্দির ঠাঁই নেই, যেখানে ইংরেজিই ভরসা।’ ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল শ্রী সি রাজাগোপালচারী দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে ভারতীয় জনগণের ওপর হিন্দি চাপানোর বিরোধিতা করেন। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘হিন্দি কখনোই নয়, ইংরেজি সর্বকালের।’২৫
আয়ার আরও বলেন, তামিলনাড়ু কখনো আদালতে হিন্দি মেনে নেবে না। আমাদের বিচারকেরা অন্যান্য দেশের ইংরেজি রায়ের ওপর নির্ভরশীল। আমি ব্যক্তিগতভাবে হিন্দি পছন্দ করি। কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে নয়। তবে লক্ষণীয় হলো, বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ার তাঁর কথায় যত টাকাই লাগুক ‘ত্রিভাষা সূত্র’ বাস্তবায়নে জোরালো মত দেন। তিনি আরও বলেন, ‘উচ্চ আদালতে সবাই যে ভাষায় বলে বলুক, তার তাত্ক্ষণিক অনুবাদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।’২৬ আমরা দেখি, তিনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে যেকোনো ভাষায় কথা বলার সুযোগের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারেননি। অথচ আমাদের দেশটা একান্ত বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও কয়েক বছর আগে নিম্ন আদালতে বাংলায় আরজি পেশের প্রস্তাব পর্যন্ত নাকচ করা হয়।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানও আমাদের সকল স্তরের আদালতে বিশ্বের যেকোনো ভাষায় কথা বলার অধিকার সমর্থন করেন। কিন্তু রায়টা হতে হবে মাতৃভাষায়। যেকোনো বিদেশি ভাষায় তার অনুবাদে মানা নেই।২৭ আমরা বলতে পারি, যাঁরা একান্তভাবে চাইবেন তাঁরা আপাতত ইংরেজিতে লিখবেন, তবে তার বাংলা তরজমা হতে হবে।
ভারতীয় বিচারপতি বি এন শ্রীকৃষ্ণ আদালতে হিন্দি প্রচলনের আগে অন্তত দুই প্রজন্ম হিন্দি পরিভাষা রপ্ত করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ইংরেজি তুলে নিলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।
কিন্তু আমাদের তো সেই ভয় নেই। এমনকি ইংরেজি একেবারে তুলে নিলেও। যদিও তার কোনো দরকার নেই, উচিতও নয়, তাহলেও কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু কারও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে না। বিদেশি আদালতে বাংলাদেশের রায়ের উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা নয়। এখনো বিরল ঘটনা। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন যে ওয়েবসাইটে রায় প্রকাশে খুবই আন্তরিক, তাও বলা যাবে না। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সরকারি ওয়েবসাইটে বর্তমানে আপিল বিভাগের মাত্র ২৬টি এবং হাইকোর্টের ৩৪৮টি রায় দেখতে পাওয়া যায়।২৮
আমরা জানি, আমাদের আদালত ব্যাপকভাবে ভারতীয় রায়ের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু আমাদের রায় পড়তে ‘বিশ্ব জেগে’ নেই। কোনো বিচারেই ভারতের মতো অবস্থায় আমরা নেই। ভারতের সংবিধানে হাইকোর্টের এক বিচারককে অন্য হাইকোর্টে বদলি করা যায়। তাই ভারতের আইন কমিশন বলতে পেরেছে যে বিচারকের যদি ভাষার ওপর দখল না থাকে, তাহলে তিনি রায় লিখবেন কী করে?
ভারতের আইন কমিশন যে যুক্তি দিয়েছে, সে যুক্তিতে আমরাও কি ইংরেজির বিরোধিতা না করে বলতে পারি যে ‘কোনো ভাষাই বিচারকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তাঁরা যে ভাষায় সাবলীল বোধ করেন, সেটাই তাঁদের বেছে নিতে দেওয়া উচিত। সর্বোচ্চ আদালতের তৈরি করা আইনের ভাষা বোঝার অধিকার প্রত্যেকের রয়েছে। এবং এই মুহূর্তে সে ভাষার নাম ইংরেজি?’ এর আলোকে আমরা কি বলতে পারি যে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে যাঁরা যেভাবে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাঁরা সেভাবে লিখবেন কিন্তু ইংরেজি হলে তার একটি বাংলা অনুবাদ দ্রুত সহজলভ্য করতে হবে? এ ছাড়া প্রতিটি সংক্ষিপ্ত বা অন্তর্বর্তীকালীন আদেশেরও একটি বাংলা পাঠ থাকবে?
ভারতের প্রথিতযশা সাংবিধানিক পণ্ডিত এইচ এম সিরভাইর কথায়, ‘যদি প্রতিটি হাইকোর্টের ভাষা ভিন্নতর হয়, তাহলে সারা ভারতে প্র্যাকটিস করার যে অধিকার আইনজীবীদের স্বীকৃত, সেটা বাস্তবে থাকবে না। অলীক ধারণায় পরিণত হবে।’ এই বাধা কিন্তু আমাদের নেই। বাংলায় অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ লেখা হলে কারও প্র্যাকটিস নষ্ট হবে না। তদুপরি ভারতের আইন কমিশন কিন্তু বলেছে, প্রতিটি আইনের একটি অনুমোদিত হিন্দি ভাষ্যও থাকতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী আদেশগুলোর জন্যও সেটা চলতে পারে।’২৯
ভারতের সংবিধানে স্টেট ল্যাংগুয়েজ বা রাষ্ট্রভাষা কথাটি ছিল না। অফিশিয়াল ল্যাংগুয়েজ হলো সরকার তার শাসনকার্যে কোন ভাষা ব্যবহার করবে সেটি। ন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ হলো সেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা। যেমন ভারতের সংবিধানে হিন্দিকে বলা হয়েছে জাতীয় ভাষা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ফলে ১৯৫৬-র নতুন সংবিধানের ২১৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হলো, ‘দ্য স্টেট ল্যাংগুয়েজেজ অব পাকিস্তান শ্যাল বি উর্দু অ্যান্ড বেঙ্গলি।’ তবে এর শর্তাংশে যা বলা হলো তাতে মনে হয়, রাষ্ট্রভাষা কথাটার মানে করা হয়েছিল জাতীয় ভাষা। দেশের দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষার স্বীকৃতিমাত্র, শাসনকার্যের ভাষার স্বীকৃতি নয়। কারণ, শর্তাংশে লেখা হয়েছিল, ‘আগামী ২০ বছরের জন্য সব সরকারি উদ্দেশ্যে ইংরেজি অব্যাহত থাকবে। এরপর সংসদ আইন করে ঠিক করবে কোন কোন ক্ষেত্রে ইংরেজি ব্যবহার করা হবে। ১০ বছর পর রাষ্ট্রপতি ইংরেজি প্রতিস্থাপনের সুপারিশ দিতে একটি কমিশন গঠন করবেন। তবে প্রাদেশিক সরকার চাইলে এই ২০ বছরের আগে যেকোনো রাষ্ট্রভাষা দিয়ে ইংরেজি প্রতিস্থাপন করতে পারবেন।’
এরপর ১৯৬২-এর সংবিধানের ২১৫ অনুচ্ছেদে উর্দু ও বাংলা রাষ্ট্রভাষা নয়, পেল জাতীয় ভাষার মর্যাদা। তার মানে, শাসনগত ভাষার মর্যাদা তারা কেউ পেল না। অফিস-আদালতে-সংসদে ইংরেজি ব্যবহারে যাতে বিঘ্ন না হয়, সে কথা স্পষ্ট বলা হলো। ইংরেজি সরাতে রাষ্ট্রপতির কমিশন গঠনের কথাটা প্রতিশ্রুতি হিসেবে ঝুলে থাকল।
একাত্তরে আমরা স্বাধীন হলাম। সংবিধানপ্রণেতাদের সামনে তখন পাকিস্তান ও ভারতের অভিজ্ঞতা। বহুভাষী ভারতের সংবিধানে সরকারি ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা ও সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের ভাষা নিয়ে প্রায় ১০টি অনুচ্ছেদ আছে। তারা সরকারি ভাষা হিসেবে দেবনাগরি লিপিতে হিন্দিকে নির্দিষ্ট করেছে। ইংরেজি পায় কার্যত দ্বিতীয় সরকারি ভাষার মর্যাদা।৩০ হিন্দির ব্যবহার বাড়াতে ১৫ বছর পরে রাষ্ট্রপতির কমিশনের ধারণা আমরা এখানে পাই। কিন্তু হিন্দি যাতে একচ্ছত্র সরকারি ভাষা না হতে পারে, সে জন্য ভারতেও ভাষা আন্দোলন হলো। তাই ১৯৬৩ সালে পাস হলো সরকারি ভাষা আইন। এর লক্ষ্য ১৯৬৫-এর পরেও ইংরেজি চালিয়ে নেওয়া। সরকারি ভাষা হিসেবে হিন্দি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হলে তামিলনাড়ু, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক ও অন্ধ্র প্রদেশের মতো রাজ্যগুলো প্রতিবাদে সরব হয়। এর পরিণতিতে ১৯৬৭ সালে ওই আইনে সংশোধনী আনা হয়। এতে বলা হয়, অ-হিন্দি রাজ্যগুলোর বিধানসভায় প্রস্তাব পাস ছাড়া ইংরেজি বিলোপ করা যাবে না। ওপরের এই আলোচনা থেকে পরিষ্কার যে রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষা এক জিনিস। আর সরকারি ভাষা একেবারেই অন্য।
এবার আমরা নজর দেব বাংলাদেশ সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের দিকে, যেখানে শুধু লেখা—প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এর অর্থ দাঁড়ায়, দেশটির অধিকাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। এটুকুর বহিঃপ্রকাশ ছাড়া এর আর কি কোনো আইনি তাত্পর্য হতে পারে? যেমন ২ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তার মানে হতে পারে, দেশটির অধিকাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। অবশ্যই সরকারি কার্যে সেই ধর্মের কোনো অনুশাসন মেনে চলার বিষয় বোঝানো হয় না। তাহলে কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের কি কোনো সংবিধানস্বীকৃত সরকারি ভাষা আছে? বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখায় আমরা রাষ্ট্রভাষা ও সরকারি ভাষার তফাত আলোচিত হতে দেখিনি। এমনকি তাঁর ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, এ কথার অর্থ কী?’ শীর্ষক নিবন্ধেও তিনি তা সযত্নে কিংবা অলক্ষ্যে এড়িয়ে যান বলে প্রতীয়মান হয়। উপরন্তু তিনি নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন,
‘আমাদের সংবিধানের প্রথমভাগে যে-দেশপরিচয় দেওয়া আছে, সেখানে ৩ অনুচ্ছেদে বর্তমানকালবাচক একটা বিধান আছে: প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এ বিধান কি কেবলই পোশাকি? এর অর্থ কী? এর মর্ম কী? এর বাধ্যবাধকতা কী? সে সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে তেমন আলোচনা হয়নি। সিদ্ধান্তও দেওয়া হয়নি।’৩১
অবশ্য অন্যত্র তিনি ৩ অনুচ্ছেদের উল্লেখ করে আমাদের দেশে ইংরেজির প্রতি বিদ্যমান আইনের সুরক্ষাকে সুনজরে দেখেননি। আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন এই বলে যে আপিল বিভাগে যাওয়ামাত্রই ইংরেজিবান্ধব বিধিবিধান কচুকাটা হবে!
আইনজীবী না হওয়ার সুবিধা নিচ্ছি। তাই আমার প্রাথমিক মত দিচ্ছি। আর তা হলো, জেনে বা না জেনে আমরা দৃশ্যত সংবিধান, সমাজ ও কালের বিচারে ভাষার প্রশ্নে মস্ত বড় একটা ফাঁক আর সীমাবদ্ধতার মধ্যে বসবাস করছি। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা কথাটি নেহাত পোশাকি প্রতীয়মান হয়। ভাষা প্রশ্নে এত কম কথা উল্লেখ করার সংবিধান বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথায় মিলবে, তা হয়তো বলা দুরূহ। তবে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক মনে করেন, সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা কথাটির উল্লেখ যথেষ্ট। তাঁর কথায়, এই বিধানই বাংলায় রায় লিখতে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে।’৩২
হাশমতউল্লা বনাম আজমিরি বিবি মামলায় বিচারপতি এ আর এম আমিরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ এম মাহমুদুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ১৯৯১ সালের ২৮ নভেম্বর প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষাবিরোধী একটি রায় দিয়েছেন। এতে রাষ্ট্রভাষা থেকে ‘আদালতের ভাষা’কে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হয়েছে। আমাদের কখনো মনে হয়, কেবল ৩ অনুচ্ছেদটি দিয়ে ইংরেজিবান্ধব আইনগুলোকে চোখ রাঙানো চলে না। বরং এটাই বলা ভালো যে ৪১ বছরে সংবিধানের অনেক কাটাছেঁড়া হলেও সংবিধান সংশোধনকারীরা ভাষার দিকে মনোযোগী হননি। বাংলাদেশের সংবিধান বাঙালি জাতিকে একটা ভাষাগত গোঁজামিলের মধ্যে রেখে দিয়েছে।
ইংরেজিতে লেখা সুপ্রিম কোর্টের মান্ধাতা আমলের বিধানগুলোকেও বাংলা করার কোনো উদ্যোগ বিচার বিভাগের তরফ থেকে নেই। বিনয়ের সঙ্গে বলি, এ ক্ষেত্রে কোনো প্রধান বিচারপতি আজ পর্যন্ত তেমন প্রশাসনিক দায় অনুভব করেছেন বলে জানা যায় না। অথচ তাঁরা জানেন, ভাষা বুঝতে পারা বা না-পারার সঙ্গে বিচারপ্রার্থীর মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িত।
আমাদের হাইকোর্ট ১৯৯১ সালের ওই মামলায় বলেন, ‘আমরা তিনটি পরিভাষা দেখতে পাচ্ছি। রাষ্ট্রভাষা, সরকারি ভাষা এবং আদালতের ভাষা।’ আমরা বলব, এ ধরনের বিভাজন কল্পনাপ্রসূত। আদালতের কথায়, ‘রাষ্ট্রভাষার অর্থ হলো, রাষ্ট্রের সকল কার্যক্রম অর্থাত্ নির্বাহী, আইন বিভাগ, বিচারিক প্রভৃতি বিষয়ে ব্যবহূত ভাষা। সরকারি কার্যক্রম যে ভাষায় চলবে, তা সরকারি ভাষা। আদালতের কার্যক্রম যে ভাষায় চলবে, তা-ই “আদালতের ভাষা”।’ এই তিনটি পরিভাষার মধ্যে ‘আদালতের ভাষা’ সংকীর্ণতম।’ এমন ব্যাখ্যা থেকে আমরা মুক্তি চাই।
১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদের আওতায় প্রণীত হয়েছে।৩৩ হাইকোর্ট এই পর্যায়ে সবচেয়ে অদ্ভুত যুক্তিটি দাঁড় করান এই বলে যে ‘আদালতের ভাষা’ যেহেতু সংকীর্ণতম, তাই ‘রাষ্ট্রভাষা’ বলতে ‘আদালতের ভাষা’ বোঝাবে না। অথচ, ১৯৮৭ সালের আইনটিতে এ ধরনের কোনো ফারাক বা পরিভাষা সৃষ্টি করা হয়নি। এমনকি উচ্চ ও নিম্ন আদালত বলেও আইনটিতে কিছু নেই। কিন্তু কী আশ্চর্য, হাইকোর্ট ওই আইনের আদালত শব্দের মানে করেছেন নিম্ন আদালত। তাঁদের কথায়, অধস্তন আদালতের ভাষা কী হবে, সেই অর্থে এটি বুঝতে হবে। সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে আদালতের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এতে আদালত মানে শুধু অধস্তন আদালত বোঝায়নি। নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, এতে সুপ্রিম কোর্টও অন্তর্ভুক্ত।
হাইকোর্ট আরও গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন বলে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়। তাঁর যুক্তি, বাংলা ভাষা প্রচলন আইনটি একটি সাধারণ আইন। কিন্তু সিপিসি বা সিভিল প্রসিডিউর কোড একটি বিশেষ আইন; যেখানে অধস্তন দেওয়ানি আদালত কীভাবে চলবে, তার বর্ণনা করা আছে। অথচ ১৯৮৭ সালের আইনকেই বিশেষ আইন বলা যায়।
এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল-জবাব এবং আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে ‘যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে।’ হাইকোর্টের ওই রায় ও তাঁর পর্যবেক্ষণ বাংলা ভাষার ওপর একটি বাধা। একটি আঘাত।
বর্তমান আইন কমিশন দুটি ঘোষণার সুপারিশ করেছে। আইন কমিশন আজমিরি বিবির রায় সম্পর্কে বলেছে, ‘সরকার অধস্তন দেওয়ানি আদালতের ভাষার ব্যাপারে দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭(২) ধারায় কোনো ঘোষণা দেয়নি বিধায় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জারি করা সত্ত্বেও অধস্তন দেওয়ানি আদালতের কার্যক্রম ইংরেজি ভাষায় চলমান রাখা যাবে। ফলে আজ অবধি বিচারকাজে বাংলা ভাষা পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি।’
দেওয়ানি কার্যবিধি বলেছে,
137.(1) The language which, on the commencement of this Code, is the language of any Court subordinate to the High Court Division shall continue to be the language of such subordinate Court until the Government otherwise directs.
(2) The Government may declare what shall be the language of any such Court and in what character application to and proceedings in such Courts be written.
এ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা ৫৫৮ হচ্ছে:
The Government may determine what, for the purposes of this Code, shall be deemed to be the language of each Court within the territories administered by it.
এমতাবস্থায় সরকার আদালতের ভাষা বাংলা মর্মে দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৯৯৮-এর সেকশন ৫৫৮-এর অধীন একটি এবং দ্য কোড অব সিভিল প্রসিডিউর, ১৯০৮-এর সেকশন ১৩৭(২)-এর অধীন একটি, অর্থাত্ মোট দুটি ঘোষণাপত্র জারি করতে পারে। প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্র দুটি জারি করা হলে আদালতে তা অবিলম্বে কার্যকর করা সম্ভব।
কিন্তু আমাদের সন্দেহ এই দুটি ঘোষণা জারির পরও উচ্চ আদালতে বাংলা নিশ্চিত করা যাবে কি না। বর্তমান আইন কমিশনের সঙ্গে আমরা একমত যে ‘ইংরেজিতে রচিত বিদ্যমান আইনসমূহ বাংলায় অনুবাদ ত্বরান্বিত করা জরুরি। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়সমূহের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুবাদ কাজ বেগবান করা এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষকে অধিকতর শক্তিশালী, গতিশীল এবং উদ্যোগী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন।’
প্রকৃতপক্ষে গলদ সংবিধানেই। সংবিধানই শোধরাতে হবে। প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা বলে দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান রাষ্ট্রের কোনো স্তম্ভের ওপরই হয়তো বাংলা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেনি। অবশ্য আমাদের সংস্কৃতি উন্নত হলে এতে আটকাত না, হয়তো এতেই চলত। তাই আমরা সংবিধানে উপযুক্ত সংশোধনী আনার প্রস্তাব করব। জাতিগত সংখ্যালঘুদের ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে তাদের ভাষাসমূহকে সংবিধানের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তাও ভাবা যায়। গতবারের একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রথম আলোতে তাঁর ধারাবাহিক লেখায় আমাদের জাতিসত্তার আরেকটি অনালোচিত পরিচয় উন্মোচিত করেছেন।৩৪ আর সেটা প্রমাণ করে যে আমরা এক অর্থে সমগোত্রীয় নই, বহু ভাষাভাষী জাতি।
২০০৩ সালে চীনের কুনমিংয়ের একটি প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়েছিলাম। সেখানে একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বাস। তাদের নিজস্ব ভাষা আছে। সেখানে আদালতের ভাষা যদিও চীনা সরকারি ভাষা। কিন্তু যখন রায় হয়, তখন তার অনুবাদ স্থানীয় ভাষায়ও করা হয়। অনুপস্থিত ব্যক্তির বাড়ির দরজায় আদালতের সমন লটকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেটা তাদের মাতৃভাষায়।
সম্ভবত উচ্চ আদালতে বাংলা চালুর সবচেয়ে বড় বাধা মনস্তাত্ত্বিক। এর সঙ্গে একশ্রেণীর আদালতকেন্দ্রিক মানুষের স্বদেশি ঠকানোর মনোবৃত্তিও রয়েছে। আদালতে বিদেশি ভাষা অব্যাহত রাখার সঙ্গে আদালতকেন্দ্রিক অসাধুতার সম্পর্ক নিয়ে টিআইবি যদি একটি নতুন সমীক্ষা চালায়, তাহলে তার ফলাফল কম চমকপ্রদ হবে বলে মনে হয় না।
আদালতের ইংরেজিচর্চা সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘প্রকাশ্য বিচারের’ ধারণার পরিপন্থী। কারণ, ইংরেজি না-জানা লোকের কাছে গোপন বিচার আর প্রকাশ্য বিচারের পার্থক্য নেই। তাঁকে দুর্বোধ্যতার অন্ধকারে রাখতে বা ঠকাতে পারে যে কেউ। অথচ বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রের জন্মের আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা ক্ষমতা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র বাংলা চালু করে দেব। সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে। পরে সংশোধন করে নেব।’ কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে সংবিধান লিখতে বসে সে কথা লেখাই বাকি পড়ল। বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট উদ্বোধন করতে গিয়ে ১৯৯৮ সালের ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘সকল স্তরের আদালতে’ বাংলায় নিপুণভাবে রায়ের জন্য ইনস্টিটিউটকে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে উচ্চ আদালতে বাংলা চালুর বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের কিছু করার নেই।
মূলত সুপ্রিম কোর্ট, বিশেষ করে আপিল বিভাগ চাইলে নিজেরাই আদালতে বাংলাবান্ধব একটা উপযুক্ত নির্দেশনা দিতে বা ব্যবস্থা নিতে পারেন। তাঁরা এ জন্য পর্যাপ্ত অনুবাদক নিয়োগ দিতে পারেন। বরাদ্দ চেয়ে সরকারকে পত্র দিতে পারেন। এটা করার মুখ্য দায় তাঁদেরই।
আসলে পাকিস্তানের সঙ্গেই যত শাসনগত মিল। আজও আমাদের সভা-সমিতিতে শৌর্যবীর্যের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, জিন্নাহর উর্দু ঘোষণার জবাবে ‘না’ দ্রোহ কীভাবে ধ্বনিত হয়েছিল। তবে পাকিস্তানে ভাষা বিল ওঠে। এখানে তা-ও নয়। পাকিস্তানের বিরোধী দল উর্দুসহ আটটি ভাষাকে জাতীয় ভাষা করার চিন্তায় সংসদে একটি বিল এনেছিল। ২০১১ সালের ১৯ মে পাকিস্তান টুডে-এর এক রিপোর্ট বলেছে, ‘আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আঞ্চলিক ভাষাসংক্রান্ত সংবিধান সংশোধন বিল ২০০৮ নাকচ করেছে।’ সিন্ু্লর সাংস্কৃতিক মন্ত্রী মিজ সাসুই পালিজোর প্রতিক্রিয়া প্রণিধানযোগ্য। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, সিন্ধি যদি ভারতের সংবিধানে মর্যাদা পায়, তাহলে পাকিস্তানের সংবিধানে তা পাবে না কেন। সিন্ধি, পাঞ্জাবি, বেলুচি ও পশতুকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। যাঁরা বলেন এতে বিশৃঙ্খলা ঘটবে, তাঁদের লজ্জিত হওয়া উচিত।
বাংলাদেশে ১৯৮৭ সালে জেনারেল এরশাদের আধা সামরিক আমলে বাংলা ভাষার প্রচলন আইনটি পাস হয়েছিল একটি বেসরকারি বিল হিসেবে। সরকার কিন্তু বিল আনেনি। তিন বছর পরে একটা পরিপত্র এল, তখনো এরশাদ ক্ষমতায়। বাংলাদেশের বহুল উচ্চারিত গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কেবল বাংলা ভাষা নিয়েই তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হয় না। এই নীরবতার অবসান হওয়া উচিত।
আশু বাস্তবায়নের আশায় একটি নির্দিষ্ট প্রস্তাব করি। মহামান্য আপিল বিভাগ যেন আপাতত তাঁদের প্রতিটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ এবং বিশেষ করে রায় ঘোষণা দিনের সংক্ষিপ্ত আদেশ বা রায়ের অপারেটিং অংশ শুধু বাংলায় কিংবা একসঙ্গে ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশে উদ্যোগী হন।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানের ৬২তম বার্ষিকীতে আমাদের স্লোগান হবে— বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বাংলা চাই। গত ৪১ বছরে আমাদের চার-পাঁচটি রায়ও বিদেশি কোনো সুপ্রিম কোর্ট উদ্ধৃত করেছে কি না সন্দেহ। সুতরাং যাঁরা পরিভাষার ঘাটতি বা বিদেশিদের চাহিদার কথা বলেন, তাঁদের কাছে অনুরোধ, আপনারা বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংবিধান ও আদালতগুলোর দিকে তাকান।
ভাষাদূষণ রোধে বাংলা একাডেমির সভাপতি আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে কমিটি গঠনের আদেশ হাইকোর্ট দিয়েছিলেন। আমাদের বরং মনে হয়, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। ভাবতে পারলে খুশি হতাম যে সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণ বাংলা ভাষার প্রতি নয়, আদালতের ভাষা কী হবে সেই বিষয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনের প্রতি সজাগ ও সচেতন রয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের ভাষা কী হবে, তা আইনে ও সংবিধানে স্পষ্ট বলা না থাকতে পারে, কিন্তু নিজস্ব প্রশাসনিক বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট এখানে একটি দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
মাতৃভাষায় আইনচর্চার অধিকারও মানবাধিকার। আইনচর্চা আর ন্যায্য বিচারের শর্তপূরণ সরাসরি এক জিনিস নয়। বিচারপ্রার্থীর অধিকার সম্পর্কে জাতিসংঘের ‘ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস’ (আইসিসিপিআর)-এ দুটি বিধান আছে। বাংলাদেশ ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এটি সই করেছে। এই সনদের যেসব বিষয়ে বাংলাদেশ তার অনিচ্ছা ব্যক্ত করেছে, তার মধ্যে এই বিধান দুটি নেই। সুতরাং বাংলাদেশের উচ্চ আদালত সংসদের পাস করা কোনো মামুলি বিধানের বিচ্যুতি করছে কি না জানি না, তবে মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ সনদ হিসেবে আইসিসিপিআর-এর নিশ্চয় ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। এর ১৪ ধারার ৩ দফার দুটি উপ-দফা বলছে,
a ) To be informed promptly and in detail in a language which he understands of the nature and cause of the charge against him; (f) To have the free assistance of an interpreter if he cannot understand or speak the language used in court.
সুতরাং, ভাষার অধিকারের সঙ্গে মানবাধিকারের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।
একটি নতুন তথ্য জেনে আমরা বেদনাহত হলাম। ১৯৬০ সাল থেকে চলে আসা হাইকোর্ট রুলস ৫২ বছর পরে হলেও বর্তমান সরকারের আমলে শেষ পর্যন্ত সংশোধিত হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে সংসদে বা কোথাও আলোচনা হলো না। সুপ্রিম কোর্ট এত বড় একটা কাজের খসড়া ওয়েবসাইটে দিতে পারতেন। কিন্তু তা তাঁরা দেননি। রাষ্ট্রপতি নীরবে তাতে সই করেছেন। প্রজ্ঞাপনও জারি হয়ে গেছে। এই রুলসে একটি বিধান ছিল যে হাইকোর্টে দরখাস্ত করতে হবে ইংরেজিতে।৩৫ কিন্তু অবাক ব্যাপার, এখানে একটি সংশোধনী আনা হয়েছে। ইংরেজি শব্দের পরিবর্তে বাংলা শব্দটি স্থাপন করা হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়াল সুপ্রিম কোর্ট স্বেচ্ছায় বাঙালিকে এতকাল পরে শুধু বাংলায় দরখাস্ত লেখার অধিকার মঞ্জুর করলেন। কিন্তু রায়সহ আর সবই চলবে ইংরেজিতে, আগের মতো। বাঙালির ইংরেজি বিধি এভাবেই সুপ্রিম কোর্ট অখণ্ডনীয় করে দিয়েছেন।
শেষ কথা
সুতরাং এটাই ঠিক যে সংসদের নির্দেশনা ছাড়া উচ্চ আদালতে বাংলা ঢুকবে না। অবশ্য গোটা বিশ্বেই সংসদ এই দায়িত্ব পালন করছে। আমরা মনে করি, আইন কমিশনের সুপারিশ অপ্রতুল, যদিও বিরাগভাজন হতে অনিচ্ছুক সরকার সেটাই আমলে নিতে দ্বিধান্বিত। তবে এ-ও ঠিক, সাধারণ আইন করলে হবে না। উপযুক্ত সাংবিধানিক রক্ষাকবচ লাগবে। কোনো সন্দেহ নেই, সমৃদ্ধ পরিভাষা না থাকা, অনুবাদ সমস্যা, দক্ষ লোকবলের অভাব একটা বড় সীমাবদ্ধতা। কিন্তু অনতিবিলম্বে বাংলায় রায় লেখার শুরুটা অবশ্যই করতে হবে।
মাননীয় বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারিতে ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’ বলে আমাদের যে দশা হয় এবং আমাদের ভাষা নিয়ে যে ঢলঢল ভাবালুতা প্রকাশ পায়, তাতে মনের খেদে বলতে ইচ্ছে করে, ‘ও হরি, আমাদের কেন মরণ হয় না?’
তিনি স্বীকার করবেন যে রাষ্ট্রের অন্য দুটি স্তম্ভ অপেক্ষাকৃত ভালো। তাই আদালতের, বিশেষ করে মাতৃভাষায় উচ্চ আদালতের অনীহা দেখে কেবল আমাদের বলতে ইচ্ছে করে, ‘ও হরি, আমাদের মরণ হয় না কেন?’ একুশে ফেব্রুয়ারির দেশে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার দেশের উচ্চ আদালতে ভাষাগত মানবাধিকারের অব্যাহত লঙ্ঘনের অবসান হোক।
তথ্যসূত্র
১ Written judgement in English invalid - lawyer, সর্বশেষ সংশোধিত ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১০, http://www.mysinchew.com/node/45542.
২ ‘Dato’ Seri Anwar Ibrahim v. Tun Dr. Mahathir Mohamad ’, Current Law Journal 2010 (1), http://www.thenutgraph.com/user_uploads /images/2010/01/ 25/001% 20Anwar%20v%20Mahathir.pdf
৩ H.J. Lubbe, The Right to Language in Court: A Language Right or a Communication Right?, (Bloemfontein: University of Free State, South Africa), p. 377, http://www.google.com/url?q=http://dialnet.unirioja.es/descarga/articulo/3199505.pdf&sa=U&ei=0qlvUbCfCc7IrQfXnoGYDw&ved=0CBgQFjAA&usg=AFQjCNG4_X4oKbk38mKP2CDA7f8nnlp_Zw
৪ প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮০।
৫ প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮১ ।
৬ প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮৩ ।
৭ মামলার নাম: ‘R v. Beaulac 1999,’ Judgement of the Supreme Court of Canada, মামলার নম্বর ২৬৪১৬, http://csc.lexum.org/decisia-scc-csc/scc-csc/scc-csc/en/item/1700/index.do
৮ Daren Butler, ‘Turkey to Allow Kurdish Language to be Used in Court,’ November 07, 2012, The Star Online, http://thestar.com.my/news/story.asp?file=/2012/11/7/worldupdates/2012-11-06T160714Z_1_BRE8A50XG_RTROPTT_0_UK-TURKEY-KURDS&sec=Worldupdates
৯ Constituent Assembly Debate on 12 September, 1949, http://www.indiankanoon.org/doc/1362403/
১০ Dawn, 19 November, 2013.
১১ ‘Hindi, not a National Language: Court,’ The Hindu, January 25, 2010, http://www.thehindu.com/news/national/hindi-not-a-national-language-court/article94695.ece
১২
‘Khurshid Acknowledges Demand for Making Tamil a Court Language,’ The Hindu, September 10, 2010, http://www.thehindu.com/news/national/tamil-nadu/khurshid-acknowledges-demand-for-making-tamil-a-court-language/article3878652.ece
১৩ ‘Use of Hindi in Courts’, Press Information Bureau, Government of India, September 3, 2012, http://pib.nic.in/newsite/erelease.aspx?relid=87283
১৪ Marco Wan, Reading the Legal Case: Cross-currents between Law and the Humnities, Routledge, 2012, p. 81.
১৫ দেখুন http://caluniv.academia.edu/MinaDan
১৬ দেখুন http://en.wikipedia.org/wiki/Henry_Pitts_Forster
১৭ Swapan Chakravorty and Abhijit Gupta, Print Areas: Book History in India, Orient Blackswan, 2004, p. 198.
১৮ Marco Wan, 2012, p. 82.
১৯ ‘Non-feasibility of Introduction of Hindi as Compulsory Language in the Supreme Court of India’, Law Commission Report of India, December 2008, Report No. 216, p. 16, http://lawcommissionofindia.nic.in/ reports/report216.pdf
২০ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬-১৭।
২১ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭-১৮।
২২ প্রাগুক্ত, পৃ. ২১।
২৩ প্রাগুক্ত, পৃ. ২০।
২৪ প্রাগুক্ত, পৃ. ২২।
২৫ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮-১৯।
২৬ প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯।
২৭ লেখকের সঙ্গে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সাক্ষাত্কার।
২৮ আপিলেট ডিভিশন, http://www.supremecourt.gov.bd/scweb/judgments.php?div_id=1; হাইকোর্ট ডিভিশন http://www.supremecourt.gov.bd/scweb/judgments.php?div_id=2
২৯ Law Commission Report of India, December 2008.
৩০ অনুচ্ছেদ ৩৪৩, ভারতীয় সংবিধান, http://www.constitution.org/ cons/india/const.html.
৩১ রহমান, মুহাম্মদ হাবিবুর, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, এ-কথার অর্থ কী?’ শীর্ষক নিবন্ধ তাঁর নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন, অন্যপ্রকাশ: ২০০০।
৩২ লেখককে দেওয়া সাক্ষাত্কার, ২৭ মে, ২০১৩।
৩৩ Nahid Ferdouci, ‘Bengali Language Situation in the Judicial System in Bangladesh’, Dhaka University Journal of Linguistics, 2009, 2 (3): 53.
৩৪ ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ তারিখ পর্যন্ত প্রথম আলোতে সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ভাষা নিয়ে ধারাবাহিক লেখা থেকে সংগৃহীত।
৩৫ ‘অধ্যায় IV: আবেদন ও এফিডেভিটের সাধারণ নিয়মাবলী’,
Court Rules: High Court Divison, http://www.supremecourt.gov.bd/scweb/rules/ Rules% 20of% 20H. Ct.% 20Judicature~Chapter%20IV.pdf
গ্রন্থপঞ্জি
Chakravorty, Swapan and Gupta, Abhijit. 2004. Print Areas: Book History in India. Orient Blackswan.
Ferdouci, Nahid. February 2009. ‘Bengali Language Situation in the Judicial System in Bangladesh’, Dhaka University Journal of Linguistics, 2 (3).
Lubbe, H.J. The Right to Language in Court: A Language Right or a Communication Right?. Bloemfontein: University of the Free State, South Africa.
Wan, Marco. 2012. Reading The Legal Case: Cross-Currents between Law and the Humanities. Routledge.
রহমান, মুহাম্মদ হাবিবুর। ২০০০। ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, এ-কথার অর্থ কী?’ শীর্ষক নিবন্ধ তাঁর নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন। অন্যপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত।