ইসলামি রাষ্ট্রের পতন ও উত্থান

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

দ্য ফল অ্যান্ড রাইজ অব দ্য ইসলামিক স্টেট—নোআহ ফেল্ডম্যান, প্রিন্সটন: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৮। 

পটভূমি

৯/১১ ও ২০১১-পরবর্তী পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক মতবাদ হিসেবে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটলেও মানচিত্রের এই অংশ দীর্ঘদিন ধরে ছিল স্বৈরশাসনের অধীন। ২০১১-পরবর্তী বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসনের পতনের পর নতুন শাসনব্যবস্থা কী হবে তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে রয়েছে নানা মতবাদ। আফগানিস্তান ও ইরাকে গণতন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় পশ্চিমা শক্তিরা বুঝতে পেরেছে যে এই ভূখণ্ডে উদারবাদী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সময় এখন নয়। উপরন্তু এই দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমর্থন রয়েছে। এমতাবস্থায় এই দেশগুলোতে নতুন এক মতবাদের প্রবর্তন দেখা যাচ্ছে, যা গণতন্ত্র ও ইসলামবাদের একটি মিশ্রণ। এই মতবাদকে বলা হচ্ছে ‘ইসলামবাদ’ বা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’। বর্তমানে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান মূলত এই ‘ইসলামবাদ’ মতবাদের আলোকে। নোআহ ফেল্ডম্যান দ্য ফল অ্যান্ড রাইজ অব দ্য ইসলামিক স্টেট বইটিতে মূলত এই মতবাদের প্রতি সমর্থন রেখে আলোচনা করেছেন। ফেল্ডম্যান মনে করেন, ইসলাম ও গণতন্ত্র সংগতিপূর্ণ। শরিয়তের গণতন্ত্রায়ণ ও সাংবিধানিকীকরণ করে যথার্থ প্রতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র কার্যকর করা সম্ভব। লেখক বইটিতে বিভিন্ন যুক্তি ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে বলেছেন কীভাবে এই নতুন ইসলামি রাষ্ট্র সফলতা লাভ করতে পারে।

মার্কিন নাগরিক নোআহ ফেল্ডম্যান একজন লেখক ও একাধারে হার্ভার্ড ল স্কুলের আইন বিষয়ের অধ্যাপক। তিনি নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের লেখক ও কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স-এর সিনিয়র ফেলো। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক, ইয়েল থেকে আইন ও অক্সফোর্ড থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৩ সালে তিনি জ্যেষ্ঠ সাংবিধানিক উপদেষ্টা হিসেবে ইরাকে ‘কোয়ালিশনাল প্রভিশনাল’ কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করেন। তিনি একই সঙ্গে ইরাকের নতুন সংবিধান লেখার উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ফেল্ডম্যান কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো: আফটার জিহাদ: আমেরিকা দ্য স্ট্রাগল ফর ইসলামিক ডেমোক্রেসি (২০০৩), হুয়াট উই ও ইরাক: ওয়ার অ্যান্ড দ্য এথিকস অব নেশন বিল্ডিং (২০০৪), ডিভাইডেড বাই গড: আমেরিকাস চার্চ—স্টেট প্রবলেম অ্যান্ড হুয়াট উই শুড ডু অ্যাবাউট ইট (২০০৫), দ্য ব্যাটেলস অ্যান্ড ট্রিয়াম্পস অব এফডিআর’স গ্রেট সুপ্রিম কোর্ট জাস্টিসেস (২০১০) এবং কুল ওয়ার: দ্য ফিউচার অব গ্লোবাল কম্পিটিশন (২০১৩)।১ ফেল্ডম্যান একজন অ-ইহুদি নারীকে বিয়ে করার জন্য সনাতনী ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিন্দিত।২ তিনি আরব বিশ্বের ইসলামপন্থীদের প্রতি নমনীয় দৃষ্টি রেখেছেন। তিনি মনে করেন, এই ভূখণ্ডে গণতন্ত্র কায়েমে ইসলামপন্থীরাই একমাত্র ভরসা।৩ তিনি তাঁর এমন ধারণার জন্য বিশ্বজুড়ে সমালোচিত। এত সমালোচনার পরও ফেল্ডম্যান সমাদৃত। নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন ফেল্ডম্যানকে একজন নতুন ধারার প্রভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মার্কিন পত্রিকা/সাময়িকী ইস্কয়ার তাদের ২১ শতকের সর্বাধিক প্রভাবশালী মানুষের তালিকায় ফেল্ডম্যানকে ‘আমাদের সময়ের একজন বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

সরকার ও রাজনীতিতে কৃতিত্ব রাখার জন্য ফেল্ডম্যান দ্য ফল অ্যান্ড রাইজ অব দ্য ইসলামিক স্টেট বইটির জন্য ২০০৮ সালে ‘প্রোজ’ (Prose Award) পুরস্কার পান। ২০১২ সালে লেখক বইটিতে একটি নতুন সূচনা যোগ করেন, যেখানে তিনি ইসলামবাদের উত্থান বর্ণনা করেছেন, আলোকপাত করেছেন ২০১১-পরবর্তী আরব বিশ্বে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-পরবর্তী রাজনৈতিক ইসলামবাদে বিশ্বাসী বা ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনসমর্থন সম্পর্কে।

১৩০০ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম থেকেছে। এর অবসান বা পতন ঘটেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। নোআহ ফেল্ডম্যান ১৩০০ বছরের ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসানকে ‘ইসলামি রাষ্ট্রের পতন’ ও ৯/১১ ও ২০১১-পরবর্তী শরিয়ত আইনের প্রতি জনসমর্থনকে ‘ইসলামি রাষ্ট্রের উত্থান’ হিসেবে আখ্যা করেছেন। পতনের আগের ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থাকে তিনি বলছেন, ‘ট্র্যাডিশনাল বা ক্লাসিক্যাল ইসলামিক স্টেট’ (traditional/Classical Islamic State) বা ‘ঐতিহ্যিক/ধ্রুপদি ইসলামি রাষ্ট্র’ এবং বর্তমানে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের সংমিশ্রণে যে শরিয়ত আইন প্রণয়নের ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে তাকে লেখক বলছেন, 'Political Islam ও 'Islamism' বা ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ ও ‘ইসলামবাদ/ইসলামবাদিতা’। এই আধুনিক রাজনৈতিক ইসলামের মতাদর্শে বিশ্বাসী এই ধারার প্রবর্তকদের বলেছেন, 'Islamic Democrats' ও 'Islamists' বা ‘ইসলামি গণতন্ত্রবাদী’ বা ‘ইসলামপন্থী গণতন্ত্রবাদী’ ও ‘ইসলামপন্থী’। নোআহ ফেল্ডম্যান দ্য ফল অ্যান্ড রাইজ অব দ্য ইসলামিক স্টেট বইটি তিনটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে লিখেছেন। প্রথম অধ্যায়ে লেখক পতন-পূর্ববর্তী অর্থাত্ ১৩০০ বছর ধরে যে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা চলেছে অর্থাত্ ‘ঐতিহ্যিক বা ধ্রুপদি ইসলামি রাষ্ট্র’ তার শক্তিশালী দিকগুলো তুলে ধরেছেন। লেখক এই ব্যবস্থার বর্ণনা করে বলেছেন কী কী কারণে এই ব্যবস্থার স্থায়িত্ব এত দিন ছিল। এ ব্যবস্থায় ‘খিলাফত প্রথা’র মাধ্যমে শাসনকাজ পরিচালিত হতো। আইনের যথার্থ প্রয়োগ ও বিচারের জন্য খলিফা ও আইনি বিচারক ও জনগণের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ছিল 'Scholors' বা ‘ধর্মীয় পণ্ডিত/ধর্মগুরু’। ১৯০০ শতকে অটোম্যান শাসনব্যবস্থার অধীনে এ ব্যবস্থার বিনাশ ঘটে। রাজনৈতিক সংস্কারের নামে ধর্মগুরুদের কার্যকারিতা কমিয়ে খলিফাদের একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাতে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থায়িত্বের যে মূল কারণটি ছিল—ক্ষমতার ভারসাম্য, তা ভেঙে যায় এবং এ ব্যবস্থা পতনমুখী হয়। বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক ক্লাসিক্যাল ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা পতনের কারণগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। তৃতীয় অধ্যায় ফেল্ডম্যান ব্যাখ্যা করেছেন বর্তমান ইসলামবাদিতার ধারণা ও তার উত্থান সম্পর্কে।

১.

৯/১১-পরবর্তী বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো জনসমর্থন পেয়েছে। তুরস্কে ‘টার্কিশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ বা একেপি সর্বাধিক ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে, যারা আদর্শগত দিক থেকে ইসলামি চেতনায় উদ্বুদ্ধ।৪ আফগানিস্তানে মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা সরকার একটি সাংবিধানিক ‘লয়া জিরগা’ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে, যাতে ইসলামি ও গণতান্ত্রিক উভয় আদর্শের প্রতিফলন আছে।৫ বাগদাদেও দেখা যায় জনসমর্থন আছে এমন একটি সাংবিধানিক পথের, যা ইসলাম ও গণতন্ত্র দুইয়ের মিশ্রণে তৈরি।৬ ২০১১-পরবর্তী ‘আরব বসন্তের’ পরও দেখা যায় স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে ‘ইসলামাবাদিতা’ বা ‘ইসলামি গণতন্ত্রবাদীরা’ জনসমর্থন অর্জন করছে। তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলীর দুর্নীতির প্রতিবাদে এক ফলবিক্রেতা তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদ করেন। তারপর আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিক সমিতি ও মধ্যবিত্ত পরিবারের তরুণদের মাধ্যমে। দেশের মিলিটারি জনগণের সঙ্গে একাগ্রতা প্রকাশ করে এবং বেন আলী শাসনের অবসান ঘটে। এই পুরো আন্দোলনে ইনাহদা—ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের কোনো ভূমিকা ছিল না। রশিদ ঘানৌচি, ইনাহদা দলের প্রতিষ্ঠাতা, ২০ বছর ধরে তাঁর পরিবারসহ লন্ডনে নির্বাসনে ছিলেন।৭ অথচ আন্দোলনের পর গণতন্ত্রের পথযাত্রায় জনগণের সর্বাধিক ভোট যায় ইনাহদা দলের প্রতি। ২০১১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে দলটি ৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে সর্বোচ্চ জনসমর্থন অর্জন করে।৮

তিউনিসিয়ার পরপরই মিসরে শুরু হয় শাসনব্যবস্থা ও সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন। আন্দোলন বেগবানের অপরাধে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’কে (মিসরে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল) অভিযুক্ত করা হলেও তারা তা অস্বীকার করে।৯ নভেম্বর ২০১১ সালের সংসদীয় নির্বাচনে বিপুল ভোট অর্জন করে ক্ষমতায় আসে ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ এবং একই বছর ব্যাপক ভোট অর্জন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন একই দল থেকে। আরব বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও ‘আরব বসন্ত’ বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে। মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ার শাসন ইসলামপন্থী ও সামরিক বাহিনীর মাঝে দোদুল্যমান। ইয়েমেনে ‘আরব বসন্তের’ হাওয়ায় ২০১১ সালের প্রথমার্ধে আন্দোলন দেখা দেয়, যার নেতৃত্ব দেয় তাওয়াকেল কারমান। কারমান ইসলাহ দলের সদস্য, যার সংযোগ রয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডের ইয়েমেন অংশের এবং আহমার গোষ্ঠীর সঙ্গে। সিরিয়ায় আরব বসন্তের আন্দোলনের ছোঁয়া লাগলেও এর গতি মন্থর। বিদ্যমান আসাদ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা মূলত সুন্নি মুসলমান, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ (৬০ শতাংশ) জনগোষ্ঠী। সিরিয়ার আন্দোলন সফলতা না পাওয়ার পেছনের কিছু কারণের মধ্যে একটি হলো বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা সংখ্যালঘু কিছু গোষ্ঠীর সহায়তা লাভ করেছে, যাদের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলমানদের ক্ষমতায় আসা খুব লাভজনক হবে না।১০ মরক্কোর রাজতন্ত্রও এই বসন্তের বাইরে থাকতে পারেনি। যদিও রাজতন্ত্রের পতনও হয়নি। জনগণ যখন সংস্কারের আন্দোলন শুরু করে, রাজা মুহাম্মদ-৬ তখন অন্যান্য স্বৈরশাসকদের মতো (মিসর, লিবিয়া, বাহরাইন, সিরিয়া) বলপ্রয়োগে তা দমন না করে আন্দোলনকারীদের দাবির সঙ্গে কিছুটা আপস করেন। রাজা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে মরক্কোর সবচেয়ে বড় বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করে নেন। একজন ইসলামপন্থীকে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন করা হয় এবং আন্দোলনকারীরাও সংস্কারে সন্তুষ্ট থাকে।১১

অপর এক রাজতন্ত্র জর্ডানে মরক্কোর মতোই দ্রুত এবং দায়িত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আন্দোলন প্রতিহত করেছে সেই দেশের রাজা এবং শাসন ও আসন দুই-ই রক্ষা করেছে। জর্ডানে আন্দোলনের ধরনও ছিল ভিন্ন, মূলত সামাজিক যোগাযোগ মধ্যমকেন্দ্রিক। তবে রাজধানী আম্মানে কিছু সংস্কারপন্থীদের আন্দোলন হয়েছে।১২ জর্ডানের আন্দোলনকারীরা মূলত সংস্কারের দাবি করে, তারা শাসক বা শাসনব্যবস্থা পতনের আন্দোলন করেনি। সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের দেশ জর্ডানে জনগণ যখন সংসদীয় নির্বাচনের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি, যা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১০-এ, রাজা আবদুল্লাহ, আন্দোলনকারীদের দাবি রক্ষার্থে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন করে সংসদ গঠন করে।১৩ ভিন্ন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় অপর এক রাজতন্ত্র বাহরাইনে। এখানে শিয়া জনগোষ্ঠী সুন্নি শাসক দ্বারা শাসিত হয়ে আসছে। প্রাথমিকভাবে আন্দোলন সংস্কারের জন্য হলেও সরকার তা দমনে বলপ্রয়োগ করে। তাতে আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে যায়। সৌদি আরবের সাহায্যে এক হাজার সৌদি সশস্ত্র বাহিনী এসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে বুঝিয়ে দেয় যে মানচিত্রের আরব উপসাগরীয় অংশে আরব বসন্তের স্থান নেই।১৪

পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোতে ৯/১১ বা ২০১১-পরবর্তী আন্দোলন ও শাসন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেখা যায়, জনগণের মাঝে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। জনগণ চায় স্বৈরশাসনের পতন।  স্বৈরশাসনের পতনের পর কী ধরনের শাসন আসবে তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে রয়েছে বিভিন্ন মতবাদ। এই দেশগুলোতে জনমনে রয়েছে ইসলামের প্রতি নমনীয়তা। আবার জনগণ চায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং উন্নয়ন। এসব দেশে রাজনৈতিক দল বলতে ইসলামপন্থী দলগুলো সক্রিয়। ইসলামপন্থী দলগুলো দেশে শরিয়ত আইন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে। বইটিতে লেখক এই ইসলামপন্থী দলগুলোর সক্রিয়তা ও ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতি জনসমর্থনের কারণ খুঁজতে আলোকপাত করেছেন ইসলামি রাষ্ট্রের অতীত ইতিহাসের ওপর।

২.

মুসলমানদের কাছে ইসলামি রাষ্ট্র কোনো অতীত ইতিহাস নয় বরং একটি বর্তমান বিষয়, যা থেকে ভবিষ্যত্ নির্ধারণ হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলেও ইসলামি চেতনা মানুষের মাঝে উজ্জীবিত ছিল, যার মূল চালিকা মুসলিম ব্রাদারহুড বলে উল্লেখ করেছেন লেখক। ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণা, যা পূর্ববর্তী প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে তা বর্তমান প্রজন্মের কাছে এত জনপ্রিয় কেন, তা জানতে লেখক ইসলামি রাষ্ট্রের ইতিহাসে আলোকপাত করেছেন। ইসলামি রাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা ও স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে লেখক দুটি বিষয় চিহ্নিত করেছেন—আইনের শাসন ও ক্ষমতার ভারসাম্য।

হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময়কাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ১৩০০ বছর, ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েম ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ফেল্ডম্যান ইসলামি শাসনব্যবস্থার ব্যাখ্যা দিয়েছেন—

শরিয়ত আইন ইসলামি রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। এই শরিয়ত আইনের দুটি উত্স। কোরআন ও হাদিস। কোরআন ও হাদিসের আলোকে পরিস্থিতি অনুযায়ী আইন প্রণয়ন হবে। এই আইনের ব্যাখ্যা দেবেন ইসলামি ধর্মগুরু বা পণ্ডিতগণ। কেউ এই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। একজন শাসক বা খলিফা স্রষ্টা প্রদত্ত আইন দ্বারা শাসন করবেন। খলিফাও আইনের শাসনের বাইরে নয় (ফেল্ডম্যান- পৃ. ২)।

অনেক পাশ্চাত্য চিন্তাবিদের মতে, ইসলামি আইন বর্বরতাপূর্ণ। অনেকে মনে করেন এ ব্যবস্থায় শাসক যা খুশি তা-ই করতে পারেন। মন্টেস্কুর মতো বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে বেআইনি মনে করেন (The worst possible non-legal regime)। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, ইসলামি শাসনব্যবস্থায় মুসলিম কাজিরা বিচারকাজের নামে গাছের নিচে বসে তাঁদের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত দেন (ফেল্ডম্যান, পৃ. ২২) । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর, অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামি রাষ্ট্রের পতন ঘটে। ১৯২৪ সালে আদর্শগত দিক থেকে কিংবা অনুশীলনের দিক থেকে উভয় ক্ষেত্রেই এত বছরের পুরোনো ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার মৃত্যু ঘটে। লেখক এখানে ইসলামি রাষ্ট্র বিষয়ে বিভিন্ন মতামতের উল্লেখ করেননি। ইসলামি রাষ্ট্রের সংজ্ঞার ক্ষেত্রেও সংকীর্ণতা দেখা যায়। প্রথমত, ইসলামি রাষ্ট্রের ধরন বা উপাদানগুলো যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করেননি। দ্বিতীয়ত, ইসলামি আইনের কথা বলতে গিয়ে নানা পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যেমন—ট্র্যাডিশনাল বা ঐতিহ্যিক ইসলামি আইন বা ক্লাসিক্যাল ইসলামি আইন, এবং সনাতনী বা ancient ইসলামি আইন। কখনো ট্র্যাডিশনাল বা ঐতিহ্যিক ও ক্লাসিক্যাল ইসলামি আইন প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। কখনো বা আলাদা অর্থ বহন করেছে। ইসলামি আইনের এই বিভিন্ন পরিভাষার যথার্থ ব্যাখ্যা বা আলোচনা নেই। সৌদি আরবের ইসলামি আইনকে উল্লেখ করেছেন সনাতনী বলে, আবার অটোমান সাম্রাজ্যের আইনকে বলেছেন ট্র্যাডিশনাল বা ‘ঐতিহ্যিক ও ক্লাসিক্যাল ইসলামি আইন’। এমন দুই ধরনের পরিভাষা ব্যবহার করার কারণ স্পষ্ট নয় এই বইটিতে।

তিনি বলেছেন ইসলামি আইনের উত্স শরিয়ত আইন। শরিয়ত আইন বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন তা ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা ছিল এই বইটির আলোচ্য বিষয় বুঝতে। লেখক উল্লেখ করেছেন শরিয়ত আইনের উত্স কোরআন ও হাদিস। কোরআনে যা বর্ণিত আছে তা হলো মানুষের সুষ্ঠু জীবনযাপনের নির্দেশনা, যা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ওহি আকারে নাজিল হয়েছে। মুহাম্মদ (সা.) পরলোকগমন করার পর ২০০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন উলামা বা ধর্মগুরু তাঁর বাতলানো পথের কথা এবং তাঁর অনুশীলনের কথা সংকলন করেছেন। বিভিন্ন উলামার লেখার মধ্যে পার্থক্য আছে, দ্বিমতও আছে। এই বইগুলোর মধ্য থেকে কিছু বই আবার জনসমর্থন পেয়েছে, যেমন—আল-হানাফি, আল-মালিকি, আল-শাফি, আল-হাম্বলি প্রমুখ। এই বিভিন্ন লেখা থেকে বিভিন্ন মতবাদের উত্পত্তি হয়েছে।১৫ ইসলামি আইন বলতে এমন বিভিন্ন মতবাদের প্রভাব বিভিন্ন সমপ্রদায়ের মাঝে দেখা যায়। লেখক ক্লাসিক্যাল ইসলাম বলতে যা বুঝিয়েছেন তাতে কোনো মতবাদের প্রাধান্য আছে বা আদৌ আছে নাকি তা স্পষ্ট নয়।

ইসলামি রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে ফেল্ডম্যান ইসলামি ধর্মগুরুদের অবস্থান গুরুত্বসহকারে দেখেছেন। এই ধর্মগুরুরা খলিফা ও আইন প্রয়োগকারীদের মাঝে যোগসূত্র এবং ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষাকারী। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম কাজিরা আইনের প্রয়োগ করেন। তিনি যদি ঘটনা বিচারে যথার্থ আইন প্রয়োগে অপারগ হন, তবে তিনি যোগ্য কোনো আইনি ব্যক্তির শরণাপন্ন হবেন অথবা ঘটনাটি তাঁর হাতে স্থানান্তর করবেন। সেই দ্বিতীয় অভিজ্ঞ ব্যক্তি শরিয়ত ও হাদিসের আলোকে সেই ঘটনার সমাধান বাতলাবেন, যা ফতোয়া নামে পরিচিত। ইসলামি শাসনব্যবস্থায় ফতোয়া জারি করা একটি আইনি প্রক্রিয়া। সুন্নি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় খলিফা সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন। বিচারক নিয়োগ করার দায়িত্ব যথাযথ ব্যক্তির, যিনি এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন, এই আইন বিশেষজ্ঞরা খলিফার নিকট দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন। তবে এই আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ ধর্মগুরুরা দিয়ে থাকেন। আইন বিশেষজ্ঞরা তাঁদের আইন জ্ঞানের প্রমাণ ধর্মগুরুদের কাছে দিয়ে থাকেন। আইন বিষয়ে উচ্চতর জ্ঞান ও ধারণার প্রমাণ দিতে পারলেই কেবল পণ্ডিতরা তাঁদের ‘মুফতি’ উপাধি দেন এবং তাঁরা ফতোয়া দেওয়ার অধিকারপ্রাপ্ত হন। কেবল বিশ্বস্ত ও জ্যেষ্ঠ পণ্ডিতবর্গই তাঁদের শিষ্যদের মধ্য থেকে কাউকে এ ক্ষমতা পালনের জন্য নির্বাচন করতে পারেন। বিচারকেরা রাষ্ট্র প্রদত্ত নিয়োগপ্রাপ্ত। তবে পণ্ডিতরা রাষ্ট্রের নিয়োগপ্রাপ্ত নয়। তাই তাঁরা খলিফার কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না, যার ফলে বিচারকেরা যদি তাঁদের নিয়োগদাতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে থাকেন বা খলিফা যদি বিচারকদের বিচারিক কাজে হস্তক্ষেপ করেন, পণ্ডিতরা সে ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করেন। পণ্ডিতদের অবস্থান নির্ধারিত হয় তাঁদের জ্ঞান ও চালচলনের ভিত্তিতে, অন্য পণ্ডিতদের মাঝে তাঁদের খ্যাতির ভিত্তিতে। (ফেল্ডম্যান, পৃ. ২২-২৩)

ইসলামি শাসনব্যবস্থায় শাসক তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন না। বিচার বিভাগীয় কর্তৃত্ব খলিফার হাতে। তবে কোন ঘটনায় কোন আইন প্রয়োগ হবে, সেটা পণ্ডিতরা ধার্য করেন শরিয়ত মোতাবেক। কোনো খলিফা যদি তাঁর অধীনে কর্মরত বিচারকদের ওপর আইনি প্রক্রিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করেন, তা পণ্ডিতগণ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইসলামি রাষ্ট্রে আইন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। তাই কোনো খলিফা যদি আইন ভঙ্গ করেন, তবে তিনি সৃষ্টিকর্তার আদেশ অমান্য করলেন, যা পাপের সমতুল্য। শাসক যদি পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আইনের শাসন প্রয়োগে ব্যর্থ হন, আইন বা বিচারের প্রতি নমনীয় বা পক্ষপাতদুষ্ট হন, তবে তিনি জনগণের কাছে দোষী এবং শাসন করতে অপারগ। এমন শাসক জনগণের কাছে কাম্য নয়। তাই লেখক মনে করেন, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা ১৩০০ বছর স্থায়ী হওয়ার অন্যতম কারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দ্বিতীয়ত আইন প্রণয়নব্যবস্থা।

আইনগতভাবে পণ্ডিতদের ক্ষমতা আছে খলিফা নিয়োগ বা বরখাস্ত করার। একজন খলিফা পদে আসীন হতে পারেন উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে। এই নির্বাচকমণ্ডলী হলেন একদল ব্যক্তি, যাঁরা কোনো সম্প্রদায়কে একত্র করে রাখা বা না রাখার কাজ করেন—যাঁরা আসলে পণ্ডিতদের মধ্যকারই কেউ। খলিফা যদি যথার্থ বিচার করতে ব্যর্থ হন, তবে পণ্ডিতদের অধিকার আছে খলিফাকে ব্যর্থ বলে ঘোষণা দেওয়ার। তবে বাস্তবিকভাবে খলিফাকে কখনোই ব্যর্থ বলে ঘোষণা দেওয়া হয় না। পণ্ডিতরা তাঁদের এই ক্ষমতার বলেই খলিফাদের আইনের শাসনের মাঝে রাখতে পারেন। এ ছাড়া যেহেতু খলিফা নির্ধারণ পণ্ডিতদের হাতে, তাই এক খলিফার পর অন্য কোন খলিফা আসবেন, সেটা ক্ষমতাসীন খলিফার জন্য জরুরি। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন খলিফারা তাঁদের বৈধতা অর্জনের জন্য পণ্ডিতদের ওপর নির্ভরশীল। খলিফারা তাঁদের সম্ভাব্য প্রতিকূলতাগুলো উভয়, অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত, মোকাবিলা করতে পণ্ডিতগণের ওপর নির্ভরশীল। কোনো বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে শাসক ও রাষ্ট্রকে রক্ষার্থে পণ্ডিতরা ‘জিহাদি’ নীতি বা আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ ধার্য করেন (ফেল্ডম্যান, পৃ.  ৩১-৪০) ।

কঠোর দৈহিক শাস্তির জন্য শরিয়ত আইন পশ্চিমা বিশ্বে সমালোচিত। ক্লাসিক্যাল ইসলামি আইন মোতাবেক চোরের শরীর থেকে তার হাত ছেদ করা হবে এবং ব্যভিচারীকে পাথর মারা হবে যতক্ষণ পর্যন্ত না মৃত্যুবরণ করে। লেখক উল্লেখ করেছেন, শরিয়তে এমন বিধানের উল্লেখ থাকলেও এমন বিচারের উদাহরণ খুবই বিরল। কারণ, এমন শাস্তির জন্য অনেক কঠিন প্রমাণ পদ্ধতির বিচারকাজ পালন করা হয়। ব্যভিচারের দায়ে পাথর মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করা শাস্তি প্রমাণ করতে যৌন নির্যাতনের ঘটনার চারজন প্রাপ্তবয়স্ক ভালো চরিত্রের পুরুষ প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকতে হবে।১৬

লেখক শাসক ও পণ্ডিতদের মধ্যে ভারসাম্য ব্যাখ্যা করলেও পণ্ডিত ও খলিফাদের নির্বাচন বা নির্ধারণপ্রক্রিয়া সম্পর্কে তা থেকে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। ফেল্ডম্যান ক্লাসিক্যাল ইসলামি আইনের বর্ণনায় এতটাই উদারনৈতিকতার পরিচয় দিয়েছেন যে বইটি পড়লে মনে হয়, ইসলামি আইনের কোনো বিকল্প হতে পারে না। তিনি তাঁর বর্ণনায় এই আইনের প্রতি কোনো পাল্টা মতবাদ বা যুক্তির উল্লেখ করেননি। ইসলামি আইনের সবচেয়ে সমালোচিত দুটি বিষয়—কঠোর দৈহিক শাস্তি ও মেয়েদের অবস্থান। ফেল্ডম্যান দৈহিক শাস্তির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, এমন শাস্তির উদাহরণ বিরল। তবে যাঁরা ইসলামি আইনের এই বিধান নিয়ে সমালোচনা করেন, তাঁদের যুক্তি তিনি উল্লেখ করেননি। মেয়েদের অবস্থান নিয়েও একই প্রশ্ন জাগে বইটি পড়ে। এই দুটি বিষয়ে ধারণা স্পষ্ট করা পরবর্তী আলোচনা গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ।

৩.

বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন কীভাবে ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন জড়িত। ১৮২০ সালে অটোমান সামরিক সংস্কারের পরও ১৮২৮ সালের যুদ্ধে ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে অটোমান নৌবাহিনীর পরাজয় হয়। ১৮৩০ সালে ফ্রান্স আলজেরিয়া দখল করে নেয়। ১৮৩৯ সালে আবদুল মাজিদ অটোমান শাসক থাকাকালীন পাঁচ বিশ্বশক্তির সহায়তা নিয়ে মিসরের আগ্রাসন থেকে অটোমান অঞ্চলগুলো রক্ষা করা হয়। বারবার পরাজয় এবং পরনির্ভরশীলতা সংস্কারের দাবি রাখে। এমতাবস্থায় পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতরা পাশ্চাত্যের আলোকে সংস্কারের দাবি তোলেন। ১৬০০ শতাব্দীর পর অটোমান আমলাতন্ত্রেরও কোনো সংস্কার হয়নি। তাই ঢালাওভাবে এ সাম্রাজ্যের সংস্কার ও পরিবর্তন আনা হয়। ১৮৩৯ থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত অটোমান শাসনব্যবস্থায় কর, সামরিক, বিচারব্যবস্থা—সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন আনা হয়। এই সংস্কারকে সমষ্টিগতভাবে বলা হয় ‘তানজিমাত’। এ সময় বিচারব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তন দুই ধরনের—আইনগত ও শাসনতান্ত্রিক। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের উদ্ভব হয়। তবে একই সঙ্গে এই সংস্কার আগের ক্ষমতার ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়।

শরিয়ত আইনের প্রয়োগের জন্য পণ্ডিতদের ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল। কারণ, কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কোন আইন প্রণীত হবে, তা সাধারণভাবে লিখিত ছিল না। ফলে ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতে আইন প্রণয়নের জন্য পণ্ডিতদের সাহায্য প্রয়োজন হতো। ইসলামি আইন তাই সংকলন করা হয়, যা ‘তানজিমাত’। ইসলামি আইনের ব্যাখ্যার প্রথা বন্ধ করে তা সর্বজনীন করা হলো। নতুন এই আইনিলিপি ছিল ইউরোপিয়ান আদর্শে গৃহীত। ১৮৫৮ সালের দণ্ডবিধি আইন ছিল ফরাসি অপরাধ আইনের আদলে। এই ব্যবস্থায় একজন বিচারক বা আইনজীবী একটি উত্স থেকে আইন নিয়ে তা কার্যকর করতে পারে। তাতে বিভিন্ন ঘটনা সর্বতোভাবে একটা আইনে আনা হলো। এতে আগের মতো আইনের প্রয়োগ শরিয়ত থেকে নিয়ে ব্যক্তিবিশেষে ব্যাখ্যা করে প্রয়োগ করার দরকার পড়ল না। তাতে পণ্ডিতদের কাজ ও গুরুত্ব দুটোই হ্রাস পায়। ১৮৭৬ সালে এই অটোমান সংবিধান ছিল মুসলিম বিশ্বের প্রথম লিখিত আইনের সংবিধান। এটি ছিল প্রথম মনুষ্য প্রদত্ত আইনের বিধান রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য (ফেল্ডম্যান, পৃ. ৬১)। ফেল্ডম্যান মনে করেন লিখিত এই আইনি সংবিধান ছিল মুসলিম বিশ্বে ইসলামি রাষ্ট্র পতনের মূল। লেখকের ভাষায়—

‘The Ottoman constitution of 1876 was the first self-described constitutional document issued anywhere in the Muslim world. So it would not be an overstatement to say that the arrival of written constitutionalism in the Muslim world marked the beginning of the end of the Islamic State.’  (পৃ. ৭১)।

নতুন সংবিধান সীমিত আকারে ইসলামি ছিল, ধর্মীয় বা আইন উভয় দিক থেকেই। সুলতানকে ‘সর্বোচ্চ খলিফা’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে মুসলমান ধর্মের অভিভাবক বানানো হয়। ইসলামি রাষ্ট্র বলতে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি মুক্তভাবে ও নিঃসংকোচে ধর্ম পালনের অঙ্গীকার করা হয়। সংবিধান প্রণয়নকারী সংগঠনের অধীন হয়ে যায় ইসলাম। পণ্ডিতশ্রেণি, যারা খলিফা ও বিচারকের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্যকারী হিসেবে অবস্থান করছিল, সেই ভারসাম্য আর রক্ষা হলো না। খলিফা হয়ে উঠলেন সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী। বিচারকদের আইনি প্রক্রিয়ায় এখন তিনি সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। নতুন আইন প্রণয়ন ও সেই আইন অনুযায়ী বিচারকার্য পরিচালনার জন্য পণ্ডিতশ্রেণিকে প্রতিস্থাপন করল একদল বিচারক শ্রেণি। তাদের কাছে আইন সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নয়, বরং রাষ্ট্রপ্রদত্ত। তাই রাষ্ট্রের প্রতি তারা অনুগত হয়ে গেল। খলিফা আইনের ঊর্ধ্বে উঠে যান। বিধাতা প্রদত্ত আইন তাঁর ওপর বলবত্ কি না বা খলিফা বা তাঁর শাসন কীভাবে আইনের গণ্ডিবদ্ধ, এ বিষয়ে কোনো ধারণাও দেওয়া হয় না। ফলে ফেল্ডম্যান মনে করেন, ইসলামি রাষ্ট্রের সফলতার যে মূল কারণ আইনের শাসন ও সুষ্ঠু বিচার তা ভেঙে যায়। এই সংবিধান গণতান্ত্রিক ছিল না। এই সংবিধান জনগণকে সব ক্ষমতার অধিকারী না করে সুলতানকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়। সব ক্ষমতা, সার্বভৌমত্ব সুলতানের অধীন হয়ে পরে (ফেল্ডম্যান, পৃ. ৭১)।

সংবিধানে গণতান্ত্রিক ধারায় পরিবর্তন করার অঙ্গীকার করা হয়। এ লক্ষ্যে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি সাধারণ সভা তৈরি করা হয়, যা ছিল পাশ্চাত্য আদলে মুসলিম বিশ্বের প্রথম আইনসভা। দুই কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উচ্চকক্ষ তৈরি হলো সুলতান কর্তৃক মনোনীত সিনেটর নিয়ে, যাঁদের সদস্যপদ আমৃত্যু পর্যন্ত। আর নিম্নকক্ষের সদস্যরা প্রতি চার বছরের জন্য নির্বাচিত হবেন। সুলতান হামিদ-২ ১৮৭৬ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতায় আসে। নির্বাচন হয় এবং ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে আইনসভা ধার্য করা হয়। বাক-স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তা চর্চা করতে লাগল। হামিদের সরকার ও তাঁর মন্ত্রীদের সমালোচনা করা হলো। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৮, এক বছরেরও কম সময়ে সুলতান এই আইনসভা ভঙ্গ করে দেন এবং সংবিধানও বানচাল করে দেন। অটোমান সাম্রাজ্যের লিখিত প্রথম সংবিধানের এখানেই ইতি ঘটে। তবে নতুন এই সংস্কার ‘তানজিমাত’ বানচাল করে আবার আগের ক্লাসিক্যাল ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় ফেরত যাওয়া হয়নি। সংস্কারের নামে যে পণ্ডিতদের অবস্থান নষ্ট করে সুলতান সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন, সংস্কার বানচাল করার পরও তা বলবত্ থাকে। এভাবে সংস্কার সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়। ৩০ বছর ধরে আবদুল হামিদ এভাবে শাসন করার পর তরুণ তুর্কিরা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে। আধুনিক তুর্কি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী তুর্কি তরুণেরা জন্ম দিল আতাতুর্কের অসাম্প্রদায়িক তুরস্কের।

ফেল্ডম্যান উল্লেখ করেন যে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে একটি বড় কারণ হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন সংস্কার-পরবর্তী শরিয়ত নতুন দায়িত্বে অবতীর্ণ হয়েছে। আগে ক্লাসিক্যাল সুন্নি সংবিধান ছিল সব ক্ষমতার অধিকারী, যার প্রণয়ন হতো ধর্মগুরুদের মাধ্যমে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে শরিয়ত পারিবারিক আদালতে সীমাবদ্ধ থাকে। ধর্মগুরুরা তাঁদের আগের আধা স্বায়ত্তশাসনের অবস্থানচ্যুত হন এবং রাষ্ট্রের একটি অঙ্গসংগঠনে পরিণত হন। যেহেতু ধর্মগুরুদের ক্ষমতা ও অবস্থানগত অবনতি ঘটে তাই তাঁরা তাঁদের সীমিত ক্ষমতা নিয়েই খলিফার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকেন এবং খলিফার শাসনের প্রতি বৈধতা প্রদান করেন। লেখকের মতে, কামাল পাশা, যিনি আতাতুর্ক নামে পরিচিত, ধর্মকে কোণঠাসা করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক আদর্শ রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যকার যোগসূত্র খর্ব করে দেয়। ধর্ম কেবলই রাষ্ট্রের অধীন এবং মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত হয়। ১৯২৪ সালে আতাতুর্ক খিলাফত প্রথা সম্পূর্ণ বাতিল করে দেন। তবে সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের একটি ভিন্ন উদাহরণ। সেখানে আজও ক্লাসিক্যাল ইসলামি আইনের প্রচলন আছে, যাকে লেখক বলেছেন প্রাচীন ইসলামি আইন। সেখানে রাষ্ট্রীয় কার্যনির্বাহকের কাজ এখনো ধর্মগুরুরা করে থাকেন। তবে লেখক এটাও স্পষ্ট করে বলেছেন যে তিনি এমনটিও মনে করেন না যে সুন্নি মুসলিম বিশ্বে ক্লাসিক্যাল ইসলামি প্রথা থাকলেই কেবল এই শাসনব্যবস্থা স্থায়িত্ব পাবে ও যথার্থ আইনের শাসন কায়েম হবে।

৪.

ইসলামি রাষ্ট্রের জনপ্রিয়তা ও পতনের কারণ উল্লেখ করে লেখক আলোকপাত করেছেন বর্তমানের ইসলামি রাষ্ট্রের উত্থানের ওপর। তিনি আলোচনা করেছেন বর্তমানের ইসলামি রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এবং তা কীভাবে ১৯২৮-পূর্ববর্তী ইসলামি আইন থেকে পৃথক। বর্তমান ইসলামি রাষ্ট্র যে মতবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে লেখক বলছেন ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ বা ‘ইসলামবাদ’ বা ‘ইসলামবাদিতা’। অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে যখন ইসলামি সংস্কার হয়, বিস্ময়করভাবেই তখন এই সংস্কারের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণি ধর্মগুরুরা তাদের অবস্থান রক্ষার্থে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদক্ষেপ নেননি। তেমনি অস্বাভাবিক একটি ব্যাপার হলো বর্তমানের ইসলামবাদের উত্থানের পেছনেও এ ধরনের কোনো ধর্মগুরুদের অবদান নেই। সুন্নি মুসলিম বিশ্বে আধুনিকতাবাদী ইসলামি চেতনার উত্থান হয় ধর্মীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। একে বলা হয় ‘ইসলামবাদ’ বা ‘ইসলামবাদিতা’। এ ধারায় সবচেয়ে প্রভাবশালী মূলধারার ইসলামি সংগঠন—আন্তর্জাতিক মুসলিম ব্রাদারহুড। ১৯২৮ সালে মিসরে এই সংগঠনটি গঠিত হয়। বর্তমানে মরক্কো, আলজেরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডান, লেবানন হয়ে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোসহ দক্ষিণ এশীয় বিভিন্ন দেশ যেমন পাকিস্তান, আফগানিস্তান এমনকি পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ইসলামি রাজনৈতিক শক্তিগুলো সক্রিয়। ‘ইসলামবাদ’ প্রচারে লেখক মুসলিম ব্রাদারহুডকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তারা বিশ্বের বুকে ইসলাম সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে। তাদের মতে, ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে ধর্মকে পরিত্যাগ করার কারণেই ইসলামি সমাজের পতন ঘটেছে। ইসলামকে আবার মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের অপরিহার্য অংশে পরিণত করতে পারলে সর্বতোভাবেই মুসলিম সমাজের উন্নতি হবে। মুসলিম ব্রাদারহুডের কাছে ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আদর্শের পাশাপাশি ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, এমনকি খেলাধুলার ক্ষেত্রেও ইসলাম অপরিহার্য। এভাবে মুসলিম ব্রাদারহুড মানুষের জীবনের সব পর্যায়ে ইসলামকে নিয়ে যাওয়ার আদর্শে কাজ করতে থাকে। তাই স্বৈরশাসনের বিপরীতে এসব দেশে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল টিকতে না পারলেও মুসলিম ব্রাদারহুড একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যমান থেকেছে।

১৯৭৬ সালের আগে সুন্নি মুসলমান দেশগুলোতে ধর্মগুরুরা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যেভাবে নীতিনির্ধারকের কাজ করতেন, তানজিমাত-পরবর্তী ধর্মগুরুদের প্রতিস্থাপন আর দেখা যায় না। কোনো পদক্ষেপও নেওয়া হয়নি ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করে ইসলামি পণ্ডিত, শাসক ও বিচারকদের মধ্যে যোগসূত্র সাধন করবে।

বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনীতি অঙ্গনে ইসলামপন্থী মনোভাব দেখা গেলেও প্রকৃত ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দেখা যায় না। এর কারণ হিসেবে লেখক বর্তমানের ‘ইসলামবাদ’ বা ‘ইসলামবাদিতা’র সঙ্গে অতীতের ক্লাসিক্যাল ইসলামি রাষ্ট্রের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। প্রথমতই, ক্লাসিক্যাল ইসলাম শরিয়ত আইন প্রবর্তনের কথা বলে এবং দ্বিতীয়ত ক্লাসিক্যাল ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনায় সাংগঠনিক কাঠামো ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামবাদ বিংশ শতাব্দীর একটি আধুনিক ধারণা। কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদী ধারণার মতোই ইসলামবাদ একটি ধারণা, যা শরিয়ত আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দুইয়ের মিশ্রণ। ইসলামবাদ শরিয়ত আইন প্রয়োগের কথা বললেও তা ক্লাসিক্যাল ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের কথা বলে না। পণ্ডিতশ্রেণির পুনরুত্থানের কথা বলে না ক্ষমতা ভারসাম্য রক্ষার্থে। ধর্মীয় পণ্ডিতগণ, যাঁদের কেবল পারিবারিক আদালতে বিয়ে, তালাক, সম্পত্তি বণ্টন—এসব কাজে আবদ্ধ রাখা হয়েছে, তাঁদের হারিয়ে যাওয়া অবস্থান পুনর্গঠনের কথা বলা হয় না। ইসলামপন্থীরা ইসলামি আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন। তাঁরা মনে করেন, ধর্মগুরুদের ওপর নির্ভর না করেও ইসলামি চেতনায় ও আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়। এই বিশ্বাস নিয়েই তাঁরা মনে করেন কোরআনের ব্যাখ্যা সবাই তাঁর মতো করেই দিতে পারেন। তবে বিভিন্ন মতবাদের ইসলামপন্থীদের এই বিষয়ে ভিন্নমত আছে। উদারপন্থী ইসলামবাদীরা পণ্ডিতদের জ্ঞান ও শিক্ষার কিছু সংস্কার চান। আবার একই সঙ্গে কিছু গোঁড়া ইসলামবাদী পণ্ডিতের বিচারকাজ ও অবস্থান গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন।

 ইসলামপন্থীরা এমন একটি ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলেন, যেখানে লিখিত সংবিধান থাকবে শরিয়ত মোতাবিক। আইনের প্রয়োগ করবেন নতুন আইনি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা। শাসক নির্বাচিত হবেন জনগণের ভোটে। এখানে শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তার স্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই। শাসনকাজ নির্বাহ, আইন প্রয়োগ, বিচার ও আমলাতান্ত্রিক কাজগুলো করবেন রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত ইসলামপন্থীরা। শাসনব্যবস্থায় শরিয়ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকলেও ধর্মগুরুরা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রের কাজ পরিচালনা বা নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে থাকবেন না। বরং ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক মতবাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক ‘ইসলামপন্থী শরিয়ত’-Islamist Shari'a ও ‘ইসলামি শরিয়ত’ Islamic Shari'a-এর মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করেছেন। ‘ইসলামপন্থী রাজনৈতিক’ ধারা ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ কায়েমের কথা বলে। যেখানে ‘ইসলাম’ শব্দটির একটি আধুনিক অর্থ দাঁড় করানো হয়েছে, যা আগে ক্লাসিক্যাল ইসলামি ব্যবস্থায় অনুপস্থিত ছিল।

“Islam, understood as an encompassing and modern idelogy. Islam is the thing that makes Islamism into a distinctive approach to the reform of government and society. It is the engine meant to restore Muslim societies to world prominence and power” (ফেল্ডম্যান, পৃ. ১১১).

তাঁদের মতে, ‘ইসলাম’ সরকার ও সমাজে সংস্কার আনার লক্ষ্যে একটি ধারণা। এই ধারণা বিশ্বের বুকে মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরবে। ইসলামপন্থী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে লেখক চিহ্নিত করেছেন—(i) ইসলামি আইন, যা সংস্কারের কারণে লিখিত আকার ধারণ করেছে এবং (ii) ইসলামি মূল্যবোধ, যা প্রাচীন বা ঐতিহ্যবাহী/ঐতিহ্যগত ইসলামি আইনের সংকীর্ণতামুক্ত। এখানে ইসলামি আইন বলতে আগের শরিয়ত আইন বোঝায়, আর ইসলামি মূল্যবোধ হলো ইসলামি চেতনা। ইসলামি আইনের বিভিন্ন বিধান বিশ্বের বুকে এই আইনকে সমালোচিত করলেও ইসলামবাদীরা মনে করেন ইসলামি আইন থেকে বিচ্যুতি মূলত ইসলামি রাষ্ট্র পতনের মূল। তাই তাঁরা আইনের প্রতি তাঁদের আহবান অক্ষুণ্ন রাখতে চান (ফেল্ডম্যান, পৃ. ১০৫-১১৩)।

ইসলামি আইনের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আইনের প্রয়োগ ও আইনের বিচার সমান গুরুত্ববহ। ইসলামপন্থী শরিয়তে বিচার তিন ভাগে ভাগ করা যায়—সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনের বিচার। সামাজিক বিচারের মধ্যে পড়ে ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক, সরকার ও জনগণের সম্পর্ক। এখানে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যবর্তী একটি অবস্থানের কথা বলা হয়েছে, যেখানে সবাই সমানাধিকার উপভোগ করবে। এখানে যে কর-ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে তা ক্লাসিক্যাল ইসলামি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কোনো অনৈতিক সরকার এলে তার অবসানের জন্য সহিংস পন্থা সব সময় অবলম্বন করা যেতে পারে। সরকার এমন হবে যে ইসলামবাদীদের বর্ণনা করা ইসলামি আদর্শে বিশ্বাসী।

ইসলামি আইন প্রতিষ্ঠায় আর একটি উপাদান হলো ইসলামি চেতনা। ফেল্ডম্যানের লেখা পড়ে বোঝা যায় যে তিনি বিশ্বাস করেন ইসলাম ও গণতন্ত্র সংগতিপূর্ণ। তাঁর ইসলামবাদের বর্ণনা মূলত এই ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি বর্তমানের ইসলামবাদ বর্ণনায় এর প্রতিকূল মতবাদের উল্লেখ করেননি। অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন ইসলাম ও গণতন্ত্র অসংগতিপূর্ণ, এমনকি পরস্পরবিরোধী মতবাদ। গণতন্ত্র যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, ইসলাম সমানাধিকারের কথা বলে। ইসলামি সংবিধানে জনগণের মতামত ও আদর্শের ওপরে স্থান পায় ঐশ্বরিক শ্রেষ্ঠত্ব। জনগণের শাসন কায়েম করার কথা বলা হয়েছে। আবার এও বলা হয়েছে যে ইসলামি আইন যেকোনোভাবেই কায়েম করা হবে। আইন যেহেতু স্রষ্টা প্রদত্ত, ধারণা করা যায় যে জনগণের স্বার্থে আইনের কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন বা বিয়োজন সম্ভব নয়। গণতন্ত্র যেখানে জনগণের শাসন, জনগণের দ্বারা, জনগণ হতে এবং জনগণ থেকে, সেখানে শরিয়ত আইন অপরিবর্তনীয়। শরিয়ত আইন কীভাবে গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ তা আরও একটু বিশদভাবে ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় বইটিতে। রাষ্ট্রের সংবিধানে আইনের উত্স হিসেবে বলা হয়েছে শরিয়ত আইনের একটি উত্স। যেখানে ইসলামি আইন একার্থকভাবে কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রথায় মনোনীত ইসলামপন্থী বিধান সাহায্য করবে। অর্থাত্, আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্র নকশায় ইসলামি আইন সব আইনের উত্স। এই আইনে ব্যাখ্যা দেওয়ার যে অবকাশ থেকে যায়, যার ফলে পণ্ডিতদের প্রয়োজন হয়। বর্তমান নকশায় যেহেতু পণ্ডিতদের অবস্থান নেই, তাই শরিয়ত আইনের ব্যাখ্যা ইসলামি মূল্যবোধের আলোকে জনগণের নির্বাচিত সংবিধানে সংকলিত থাকবে। এই হবে মূল সংবিধানের একটি সাহায্যকারী সংবিধান। যেখানে ইসলামি আইনের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে, সেখানে এই সাহায্যকারী সংবিধান ব্যবহূত হবে। জনসম্মতিতে গৃহীত এই সংবিধানকে বলা হয়েছে শরিয়তের গণতান্ত্রিকীকরণ, যা ধর্মগুরুদের প্রতিস্থাপন করবে। শরিয়তের সঙ্গে সাহায্যকারী এই সংবিধানকে বলা হচ্ছে শরিয়তের সাংবিধানিকীকরণ। শরিয়তের সাংবিধানিকীকরণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পণ্ডিতশ্রেণিকে প্রতিস্থাপন করবে। শরিয়তের সাংবিধানিকীকরণের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের কাজ করবে ইসলাম বৈধ পর্যালোচনাকারী কোর্ট। এই কোর্টের বিচারকেরা ইসলামি আইনের প্রয়োগের ব্যাখ্যা দেবে। ধর্মগুরুদের মতোই বিচারকেরা ইসলামি আইন পর্যালোচনা করে অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমন্বয় সাধন করবে (ফেল্ডম্যান, পৃ. ১১৩-১১৮)।

ইরানের উদাহরণ দিয়ে লেখক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর গঠিত সরকার ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করলেও  দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরাচারী হওয়ার কারণে জনগণের কাছে নিন্দিত। ইসলামবাদীরা যদি যথার্থ বিচার কায়েম করতে পারে, তবে শরিয়ত আইনের শাসন সমগ্র আরব ও মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। লেখক মনে করেন ইসলামবাদ তখনই সফল হবে, যখন আইনের শাসন যথাযথভাবে কায়েম থাকবে এবং সেই শাসন ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য যথার্থ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা হবে, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব স্তরের সংগঠন আইন ও সাংবিধানিক বিচারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে এবং তা পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে। অন্যথায় যেকোনো বিপ্লব বিফলে যাবে। আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিক পরিবর্তন এলে স্বাভাবিকভাবেই তা বৈধতা পাবে, ধর্মগুরু ও বিচারকদের বহিরাগত বিশেষজ্ঞ দ্বারা প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে হবে।

৫.

নোআহ ফেল্ডম্যান-এর দ্য ফল অ্যান্ড রাইজ অব দ্য ইসলামিক স্টেট বইটি মূলত ইসলামি রাষ্ট্রের ইতিহাস বর্ণনা করে। এখানে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তাঁর অভাব অনেক জায়গাতেই অনুভূত হয়। বইটির ওপর বিভিন্ন মন্তব্য দেখলে দেখা যাবে, সবাই বইটিকে ইসলামি রাষ্ট্রের ইতিহাস-বিষয়ক একটি ছোট লেখনী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জে টলসন, ইউ এস নিউজ ও ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট বইটির পর্যালোচনায় বলেছে, বইটি ইসলামি আইনব্যবস্থা সম্পর্কে একটি ছোট ও চিন্তাশীল ইতিহাস। ইকোনমিস্ট লিখেছে, বইটি ইসলাম ও ইসলামি রাজনীতি বিষয়ে অনভিজ্ঞ বা নতুন পাঠকের জন্য ভালো একটি বই, যেখানে ইসলামি রাষ্ট্রের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। বইটি মূলত ইসলামি রাজনীতি বিষয়ে কৌতূহলী পাঠকদের ইসলামি রাষ্ট্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেয়। তবে বইটি ইসলামি রাষ্ট্রের ইতিহাসের একপেশে বর্ণনা দেয়। এখানে অন্যান্য মতবাদের উল্লেখ নেই। বইটিতে যথেষ্ট গবেষণার অনুপস্থিতি অনুভূত হয়।

লেখক ইসলামি রাষ্ট্রের স্থায়িত্বের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (ক) আইনের শাসন ও (খ) পণ্ডিত কর্তৃক ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে আইনের শাসন কায়েম। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে ইসলামি রাষ্ট্র ১৩০০ বছর স্থায়ী হয়েছে। ইসলামি রাষ্ট্রের পতনের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন (ক) ইসলামি আইনের সংস্কার এবং (খ) পণ্ডিতশ্রেণিকে অপসারণ করে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা। তিনি এই প্রথম অধ্যায়ে ইসলামি শরিয়ত আইনের কোনো সমালোচনা না করে এই ব্যবস্থাকে উপস্থাপন করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলেছেন কীভাবে সংস্কারের ফলে এ অবস্থার পতন ঘটে। তৃতীয় অধ্যায়ে যখন ইসলামবাদ বা আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্রের উত্থানের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হয় যে বর্তমানের ইসলামপন্থীরা অতীতের ইতিহাস ও ভুল থেকে শিক্ষা নেবে । কিন্তু দুঃখজনকভাবে তৃতীয় অংশে তা দেখা যায় না। বরং তৃতীয় অধ্যায়ে যে আধুনিক ইসলামবাদের আদর্শে ইসলামি রাষ্ট্রের বর্ণনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে দ্বিতীয় অংশে উল্লিখিত ইসলামি রাষ্ট্রের পতনের কারণ সদৃশ। লেখক যে নতুন ইসলামি রাষ্ট্রের আদর্শের কথা বলেছেন তার প্রতি লেখকের সমর্থন প্রকাশ পায়। লেখক বলেছেন, নতুন ইসলামি রাষ্ট্র তখনই সফল হবে যখন ইসলামপন্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রে নতুন প্রাণ দেবেন। লেখক উল্লেখ করেছেন, নতুন ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি (ক) শরিয়তের গণতন্ত্রীকরণ ও (খ) শরিয়তের সাংবিধানিকীকরণ। এ ব্যবস্থায় শরিয়ত রাষ্ট্রীয় আইনের উত্স। এ ক্ষেত্রেও লেখক শরিয়তের যথার্থ ব্যাখ্যা দেননি। শরিয়ত আইনের উত্স যদি কোরআন ও হাদিস হয়, সে ক্ষেত্রে আবারও প্রশ্ন জাগে কোন মতবাদের হাদিস এখানে গৃহীত হবে। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে যে এই ব্যবস্থায় আইনের একটি উত্স হবে শরিয়ত। একটি গণতান্ত্রিক উপায়ে সংগৃহীত সংবিধান থাকবে, যা শরিয়তের সাহায্যকারী দলিল হিসেবে কাজ করবে। ইসলামি আইনে পতনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেছেন আগের ক্লাসিক্যাল ইসলামি আইন থেকে বিচ্যুতি পতনের একটি কারণ। আবার পতনের দ্বিতীয় কারণ পণ্ডিতশ্রেণির অপসারণও পুনঃস্থাপন করা হচ্ছে না নতুন মতবাদে এবং তা ন্যায্য করা হচ্ছে বারবার ইরানের রাষ্ট্রব্যবস্থার উল্লেখ করে। ইরানে পণ্ডিতরা তাঁদের আধিপত্য ও দুর্নীতির কারণে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন বলে লেখক পণ্ডিতদের অবস্থান প্রত্যর্পণ করার পক্ষপাতী নন (পৃ. ১২৮-১২৯)। সে ক্ষেত্রে পণ্ডিতদের অবস্থান নেবে একটি সর্বজনগৃহীত লিখিত সংবিধান, যা শরিয়তের সঙ্গে সাহায্যকারী দলিল হিসেবে থাকবে। যদি ক্লাসিক্যাল ইসলামের জনপ্রিয়তার উপাদান ও পতনের কারণ থেকে আমরা শিক্ষা না নিই, তাহলে কেন তা ব্যাখ্যা করা হলো তা স্পষ্ট নয়। যদিও এই ব্যাখ্যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইসলামি রাষ্ট্রের ইতিহাস সম্পর্কে ভালো একটি ধারণা দেয়।

দ্বিতীয় অংশের পতনের কারণে লেখক বলেছেন, একদল পশ্চিমা শিক্ষায় দীক্ষিত মানুষের মাধ্যমে ইসলামি আইনের সংস্কার হয়েছে। যারা পণ্ডিতদের অপসারণ করে তাদের অবস্থান নিয়েছেন। নতুন ইসলামি রাষ্ট্রের আদর্শেও তা পরিলক্ষিত। মুসলিম বিশ্বে বর্তমানে যেভাবে শাসনের পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে এই ইসলামপন্থীরা কীভাবে ক্ষমতায় আসবে এবং শরিয়তের গণতান্ত্রিকীকরণ ও সাংবিধানিকীকরণ করবে তা উল্লেখ নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মুসলিম ব্রাদারহুড মুসলিম সমাজের সংস্কার ও ইসলামি মূল্যবোধ জাগ্রত রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। তবে এই ইসলামবাদীরা সবাই কি মুসলিম ব্রাদারহুডের অনুসারী কি না তা উল্লেখ নেই। কীভাবে তারা সংঘবদ্ধ হবে তারও উল্লেখ নেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্নায়ুযুদ্ধকালীন ধর্মহীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিজম-ব্যবস্থার বিপরীতে যে ধর্মীয় আদর্শের উত্থান ও প্রসার ঘটেছে, এই লেখায় তার উল্লেখ নেই। জিহাদি চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিভিন্ন চরমপন্থী দল ধর্মের নামে যে মতবাদের প্রচার ও প্রসার করে চলেছে তারও কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। সত্তর-পরবর্তী সৌদি আরবের তেলের অর্থে ওয়াহাবি ইসলামের আদর্শ দূরপ্রাচ্য এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। সেখানে লেখকের উল্লেখিত এই উদারনৈতিক ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কীভাবে জায়গা করে নেবে তা লেখক উল্লেখ করেননি।

লেখক যে নব ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার সমর্থক তার প্রমাণ হলো তিনি ইরাকের গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তবে গণতান্ত্রিক মতাদর্শ গ্রহণ না করে ইসলামি মতবাদের গণতান্ত্রিকীকরণ কেন প্রয়োজন হলো তা লেখক এড়িয়ে গেছেন। আফগানিস্তান ও ইরাকে একটি উদারপন্থী গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের ব্যর্থতা ও তার কারণ লেখক কোথাও উল্লেখ করেননি। বর্তমান ইসলামি রাষ্ট্রের ব্যাখ্যা এবং তা সফলতার কারণগুলো উল্লেখের ক্ষেত্রে লেখক যদি ৯/১১-পরবর্তী আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন গণতন্ত্রীকরণ প্রক্রিয়ার প্রচেষ্টা ও ব্যর্থতার আলোকে করতেন, তবে তা অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেত।১৭

নতুন ইসলামি রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিচারক ও সাহায্যকারী সংবিধানের উল্লেখ রয়েছে, ক্লাসিক্যাল ইসলামের পতন যখন লেখক বর্ণনা করেছেন তখন লেখক উল্লেখ করেছেন যে পণ্ডিতদের অপসারণ করে লিখিত সংবিধান গৃহীত হয়, যাতে পণ্ডিতদের ব্যাখ্যার প্রয়োজন থাকে না। এই কার্য পরিচালনার জন্য বিচারকমণ্ডলী ছিলেন। তবে যেহেতু তাঁরা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত, তাই তাঁরা সরকারের প্রতি অনুগত হন। ফলে শাসক তাঁদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারেন এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। পূর্ববর্তী ব্যবস্থায় পণ্ডিতগণ রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত ছিলেন না বলে শাসকের অনুগত হতে বাধ্য থাকতেন না। নতুন ইসলামবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিচারকেরা কীভাবে নিয়োগ পাবেন তা উল্লেখ করা হয়নি। তাঁরা যদি রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন তাহলে আমরা এই লেখাতেই জানতে পারি তার পরিণতি কী হয়। এই ব্যবস্থা কীভাবে এই প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করবে তার উল্লেখ নেই।

নতুন ইসলামি রাষ্ট্রের উত্থানের কথা বলতে গিয়ে লেখক কেবল আরব বিশ্বের দেশগুলোর কথা বলেছেন। প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও ইসলামবাদ রাজনীতিতে অনেক দিন ধরে আছে বা শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে বইটিতে আলোকপাত করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে এমনকি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পেছনেও সমসাময়িক বিশ্বরাজনীতি বড় অবদান রেখেছে। যেকোনো শাসনের পতন ও উত্থানের ক্ষেত্রে বিশ্বরাজনীতি এবং অন্যান্য বহিঃশক্তি প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই কোনো ব্যবস্থার উত্থান বা পতন সম্পর্কে জানতে হলে অভ্যন্তরীণ বিষয়াদির সঙ্গে সঙ্গে বাহ্যিক বিভিন্ন প্রভাবকের কার্যকরী গণনা করাও একান্ত প্রয়োজনীয়।

পরিশেষে বলা যায়, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে নোআহ ফেল্ডম্যানের এই বইটি দ্য ফল অ্যান্ড দ্য রাইজ অব দ্য ইসলামিক স্টেট উল্লেখযোগ্য। এ কারণেই এত সমালোচনা ও দুর্বলতার পরও বইটি বহুল পঠিত ও সমাদৃত। তবে উল্লেখ্য, বইটি সাবলীল ভাষায় ইসলামি রাষ্ট্রের ইতিহাস বর্ণনায় পাঠকের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সমর্থ। তবে গবেষণামূলক লেখনী হিসেবে বইটি গ্রহণযোগ্য নয়। বইটিতে পর্যাপ্ত তথ্য, উপাত্ত ও উদাহরণের প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হয়।

তথ্যসূত্র

1.       Noah Feldman, Faculty Profile. Harvard Law School.

          http://hls.harvard.edu/faculty/directory/10257/Feldman. accessed on 3 July 2015

2.       Mark J., 'Snap, Crackle, But Not Cropped', The Jewish Week, 31 August 2007.

          http://www.thejewishweek.com/features/snap_crackle_not_cropped. accessed on 2 July 2015

3.       Collected from Kramer M.’s personal blog Sandbox, from the write-up 'Noah Feldman: No more Baghdad', 6 January 2005. Kramer Martin is a President of Shalem College in Jerusalem.

     http://www.martinkramer.org/sandbox/tag/noah-feldman/. Accessed on 2 July 2015.

4.       Finkel A., 'Viewpoint: What now for Turkey's ruling party?', 31 October 2012, BBC News.

          http://www.bbc.com/news/world-europe-20141894. accessed on 4 July 2015.

5.       Fange A., 'The Emergency Loya Jirga: Hopes and Disappointments”, July 2012, Afghanistan Analysts Network.

          http://www.afghanistan-analysts.org/wp-content/uploads/downloads/ 2012/09/2_Fange_The_Emergency_Loya_Jirga.pdf.

6.       'Unmaking Iraq: A Constitutional Process Gone Awry', Policy Briefing, Middle East Briefing N 19, Amman/Brussels, 26 September 2005, International Crisis Group: Working to Prevent Conflict Worldwide.

          http://www.crisisgroup.org/~/media/Files/Middle%20East%20North%20

Africa/Iraq%20Syria%20Lebanon/Iraq/B019%20Unmaking%20Iraq%20A%20Constitutional%20Process%20Gone%20Awry.pdf

7.       Gardner F., 'Tunisia one year on: Where the Arab Spring started', 17 December 2011, BBC News.

          http://www.bbc.com/news/world-africa-16230190. accessed on 1 July 2015.

8.       McCarthy R., 'What happens when Islamists lose an election?' 11 June 2015, Washington Post.

          http://www.washingtonpost.com/blogs/monkey-cage/wp/2015/06/11/ what-happens-when-islamists-lose-an-election/. Accessed on 6 July 2015.

9.       Hamid S. and Brooke S., 'The Muslim Brotherhood’s Role in the Egyptian Revolution' , 1 February 2011, Combating Terrorism Center.

          https://www.ctc.usma.edu/posts/the-muslim-brotherhood%E2%80%99s-role-in-the-egyptian-revolution. Accessed on 65 July 2015

10.      Phillips C., 'Syria’s Bloody Arab Spring', LSE Ideas: Analysis,

          http://www.lse.ac.uk/IDEAS/publications/reports/pdf/SR011/FINAL_LSE

_IDEAS__SyriasBloodyArabSpring_Phillips.pdf. pg  37-42

11.      Lewis A., 'Why has Morocco’s king survived the Arab Spring?', 24 November 2011, BBC News: Middle East,

          http://www.bbc.com/news/world-middle-east-15856989. accessed on 2 July 2015. 

12.      Rohde D., 'In Jordan, the Arab Spring Isn't Over', 19 July 2013, The Atlantic: Global.

          http://www.theatlantic.com/international/archive/2013/07/in-jordan-the-arab-spring-isnt-over/277964/. Accessed on 1 July 2015.

13.      Murad M., 'Here is how Jordan escaped the Arab Spring', 9 February 2014, Aljazeera: Opinion.

          http://www.aljazeera.com/indepth/opinion/2014/02/here-how-jordan-escaped-arab-spr-20142510106257977.html. Accessed on 30 June 2015.

14.      Murphy B., 'Bahrain Mass Job Dismissals: Shiite Majority Claim Discrimination', 9 August 2011,  Huffington Post.

          http://www.huffingtonpost.com/2011/09/08/bahrain-jobs-shiite-protests_n_954298.html. accessed on 29 June 2015.

15.      Otto M. J., 'Sharia Incorporated: A Comparative Overview of the Legal Systems of the Twelve Muslim Countries in Past and Present', 2010, Leiden University Press: Law, Governance and Development Research. Pg: 23.

16.      S. Powers, 'Law, Society and Culture in the Maghrib: 1300-1500', in Cambridge Studies in Islamic Civilization, October 2009, page: 82

17.      L. Diamond, 'Building Democracy After Conflict: Lessons from Iraq', in Journal of Democracy, Vol.: 16, Number 16, January 2005, page: 9-10.