ভূমিকা
রাশিয়ায় গ্রামসির যে একটি পরিবার ছিল, এটা সবাই জানে। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর এত দিন পরেও সেই পরিবারের কী পরিণতি হয়েছিল এবং তাঁর কারাবাসের আগে এবং কারাবাসের সময়ে সেই পরিবারের সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল, সে সম্পর্কে খুবই কম জানা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে সরকারি নথিপত্র আংশিক উন্মুক্ত হয়। এর ফলে গ্রামসির জীবনের এই দিকটির প্রতি আলোকপাত করা সম্ভব হয়েছে। তথ্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উত্স হলো তাঁর নাতি আন্তোনিও। তিনি ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি এই লেখায় বর্ণনা করেছেন কীভাবে ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে ইতালি ভ্রমণের সময় তাঁর দাদার প্রতি তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। মস্কোতে নিজের বাড়ি ফিরে গিয়ে তিনি যে যে দলিল পেয়েছেন, তা সংগ্রহ করেছেন। এখানে মূলত সুগ্ত (Schucht) পরিবারের সঙ্গে ব্যাপক যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়। জুলিয়া (১৮৯৬-১৯৮০) ছিলেন নিজে একজন বলশেভিক বিপ্লবী এবং গ্রামসির দুই সন্তানের জননী। তিনি সুগ্ত পরিবারের পাঁচ বোনের মধ্যে একজন। তাঁর এক বোন ইউজেনিয়া (১৮৮৯-১৯৭২) ছিলেন আরেক কমিউনিস্ট, যিনি রাশিয়ায় গ্রামসির আবেগে জুলিয়ার চেয়ে কিছু পূর্ববর্তী ছিলেন। আরেক বোন ছিলেন তানিয়া (১৮৮৭-১৯৪০), যিনি ইতালিতে গ্রামসির কারাবাসের সময় নিবেদিত সহায়তাকারী ছিলেন। আন্তোনিও গ্রামসি জুনিয়র তাঁর লা স্তোরিয়া দি উনা ফ্যামিগলিয়া রিভোলুজিওনারিয়া (২০১৪) বইয়ে জার শাসনের শেষ সময় থেকে বিখ্যাত সুগ্ত পরিবারের ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করেছেন। লেনিন ছিলেন এই পরিবারের একজন বন্ধু। তিনি স্তালিন-পরবর্তী সময় পর্যন্ত অন্য আরেক বোনের কাছে গডফাদার ছিলেন। সে সময় দলে ইউজেনিয়াকে পুনরায় অন্তর্ভূক্ত করতে জুলিয়া ক্রুশ্চেভের কাছে আবেদন করতে বাধ্য হন। ইউজেনিয়া একসময় ক্রুপস্কায়ার সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সে সময় এই পরিবার অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছিল। গ্রামসির ছোট ছেলে জুলিয়ানো (১৯২৬-২০০৭) বলেছেন, সেই ‘ট্র্যাজিক অত্যাচার ও স্বাভাবিক অবিশ্বাসের’ সময়ও কর্তৃপক্ষ এই পরিবারকে কোনো ঝামেলায় ফেলেনি। এই দয়ার জন্য দলের নেতা তোগলিয়াত্তিকে, তিনি ধন্যবাদ দিতে চান। ইনি সেই একই তোগলিয়াত্তি যাঁর সম্পর্কে জুলিয়া অভিযোগ করেছেন যে এই ব্যক্তি তাঁর স্বামীর নোটবুকগুলোকে দলের সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করত। তোগলিয়াত্তি গ্রামসির দুটি ছেলের মধ্যে একজনকে ইতালিতে ফেরত আনার চিন্তা আঁটছিল। এটাকে তোগলিয়াত্তি তাঁর দল এবং গ্রামসির মধ্যে ধারাবাহিকতার জীবন্ত নিদর্শন হিসেবে ধরে নিয়েছিল। গ্রামসির নাতি তাঁর বাবা ও চাচার মধ্যে বিপরীতমুখী চরিত্র ও পেশার ওপর আলোকপাত করেছেন। গ্রামসির এই দুই ছেলে হলেন জুলিয়ানো ও দেলিও (১৯২৪-১৯৮২)। গ্রামসি ও লেনিনের মধ্যে এই পর্যন্ত অপ্রকাশিত সাক্ষাতের বর্ণনা রয়েছে এই লেখায়। এখানে অনেক কিংবদন্তি যাঁরা গ্রামসির শেষ জীবন সম্পর্কে ঝটিকা মন্তব্য করেছেন, তাঁদের যুক্তি তিনি খণ্ডন করেছেন। তিনি পরিষ্কার করে বলেছেন, এই খণ্ডন তিনি করেছেন শুধুই পরিবারের প্রতি আনুগত্য থেকে নয়, বরং রাজনৈতিক জাগরণ থেকে। এত দিন পর্যন্ত রাজনীতি নিয়ে উদাসীন থাকলেও সোভিয়েত-পরবর্তী ইয়েলিসন এবং পুতিনের শাসনামলে, রাশিয়ার বুদ্ধিজীবী ও জনজীবনে দুর্নীতির কারণে তাঁর মধ্যে এই বিরক্তির জন্ম হয়েছে। এসবের বিপরীতে এবং সবকিছুর ফলাফল সত্ত্বেও, তাঁর দাদার কাজ তাঁর জন্য জীবন্ত অনুপ্রেরণা।
আমার পিতামহ
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে পর্যন্ত আমার কাছে আমার দাদা ছিলেন কিংবদন্তির মোড়কে একজন নিষ্প্রভ ব্যক্তি।১ এর নেপথ্যের নায়ক ছিলেন আমার বাবা। আমার বাবা ছিলেন একজন মহা রোমান্টিক মানুষ। তিনি একাধারে মেধাবী সংগীতবিদ, সুরকার এবং শিল্প-ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। তাঁর মূল আগ্রহের বিষয় ছিল ইতালীয় রেনেসাঁর শিল্প-ইতিহাস, সাহিত্য ও কবিতা। লিওপার্ডি ছিলেন তাঁর পছন্দের লেখক। মনে হতো আমার বাবা ধ্রুপদি বিষয়গুলোর মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। এসব বিষয়ের প্রতি তাঁর একধরনের স্বভাবগত টান ছিল; অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীর যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিগুলোও এর একটি কারণ। বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতার তিনি একজন চাক্ষুষ সাক্ষী। এই সময়েই তিনি তাঁর বাবাকে হারান, যাকে তিনি খুব অনুভব করলেও কখনো কাছে পাননি। তাঁর শিক্ষা এবং সন্তানোচিত অভিজ্ঞতার কারণে তিনি রাজনীতি একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘রাজনীতি একেবারে বাজে জিনিস, তার [গ্রামসির] রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? তিনি তাঁর শিক্ষক বার্তোলির উপদেশ মেনে একজন ভাষাতাত্ত্বিক হতে পারতেন, ভাষাতত্ত্বে তো তিনি বেশ দখল দেখিয়েছিলেন।’২ আমি মজা করে উত্তর দিতাম, ‘তিনি [গ্রামসি] তা না করলে তো তুমি এখানে থাকতে না!’
তাঁর বড় ভাই দেলিও [গ্রামসির বড় ছেলে] ছিল একেবারে ভিন্ন প্রকৃতির। তিনি নৌবাহিনীর একজন কর্নেল এবং একই সঙ্গে ব্যালিস্টিক ইন্সট্রাক্টর ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। পারিবারিক চিঠিপত্র থেকে এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে দেলিও যুদ্ধের সময় ইতালিতে গিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনের একজন নেতা হওয়ার কথা চিন্তা করছিলেন। তিনি ভবিষ্যতে ইতালীয় নৌবাহিনী তৈরিতে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদের পতনের পর ইতালি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। অর্থাত্, তাঁর বাবা যে কারণে জীবন দিয়েছেন, দেলিও সে পথে লড়তে চেয়েছিলেন। এই চিন্তাভাবনাগুলোর পেছনে সম্ভবত তোগলিয়াত্তি উত্সাহ জুগিয়েছিলেন। তোগলিয়াত্তি আমাদের পরিবারকে নিয়মিত সাহায্য-সহযোগিতা করার পাশাপাশি এই সময়ে গ্রামসির বড় ছেলের [দেলিও] সঙ্গে নিয়মিত চিঠি চালাচালি করতেন।৩ অনেক বছর পর চাচা আমাদের দেখতে আসেন। তখন মাঝে মাঝেই আমার বাবা ও চাচার মধ্যে তীব্র কথা-কাটাকাটি হতো। আমি ছিলাম এসব বাগিবতণ্ডার অনিচ্ছুক দর্শক। এই দুজন মানুষ পরস্পর সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিলেন। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এসব বাগিবতণ্ডা শুনে আমার প্রায় কোনো লাভই হয়নি। ওই সময় আমার বয়স খুব কম ছিল (১৯৮২ সালে দেলিওর মৃত্যুর সময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর)। রাজনীতির প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না।
আমি প্রায়ই আমার মা-বাবার সঙ্গে আমার দাদি জুলিয়া সুগ্তকে দেখতে যেতাম। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি মস্কোর বাইরে পেরেদেলকিনোতে ওল্ড বলশেভিকদের জন্য নির্মিত একটি সেনেটোরিয়ামে থাকতেন। বিছানাবন্দী হলেও শেষ পর্যন্ত মানসিকভাবে তিনি বেশ শক্তপোক্ত ছিলেন। তাঁর ভালোবাসার মানুষ ও পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি বেশ উত্সুক ছিলেন। তবে তিনি নিজ থেকে আমার দাদা সম্পর্কে কোনো কিছু বলেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। ইতালীয় আত্মীয়দের কাছে পাঠানো চিঠি ও সাক্ষাত্কার ব্যতীত তিনি কদাচিত্ আমার দাদা সম্পর্কে কথা বলতেন। তিনি যখন আমাদের বাসায় থাকতেন, তখন তিনি এবং তাঁর বোন ইউজেনিয়া মিলে গ্রামসির ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সামগ্রী দিয়ে একটি জাদুঘরের মতো বানিয়েছিলেন। চার তাকের একটি বড় কাচের আলমারিতে গ্রামসির নিজের তৈরি একটি সার্দিনিয় ডইলি, কাঠের কটলেরি, একটি সিগারেট হোল্ডার এবং অন্যান্য জিনিস রাখা ছিল। সেসব পুরোনো জিনিসপত্রের কথা আমার মনে আছে। কল্পনাপ্রবণ খেলাধুলার নিরন্তর উত্স হিসেবে ওগুলো আমার কাছে রহস্যাবৃত ছিল। সত্তরের দশকের শেষে ও আশির দশকের প্রথম দিকে আমার পরিবার ওই সব জিনিসপত্রের অধিকাংশই ঘিলারজার কাসা গ্রামসিতে দান করে দেয়। তবে পারিবারিক স্মৃতি হিসেবে কয়েকটি জিনিস আমরা রেখে দিই—একটি ছাইদানি, যা আমার ক্রমাগত-ধূমপায়ী দাদা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিজের সঙ্গে রেখেছিলেন এবং তাঁর নিজের সংগ্রহে থাকা ম্যাকিয়াভ্যালির প্রিন্স বইয়ের একটি কপি। এই বই প্রিজন নোটবুকস-এর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
বিশ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে—এটি এমন একটি সমাজ ছিল, যা এর সীমাবদ্ধতাগুলো সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রের বাস্তবিক স্মারকের প্রতিনিধিত্ব করত এবং বিরোধিতা সত্ত্বেও পশ্চিমা ধনতন্ত্রের বিরোধগুলোকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছে। এই সময়ে এসে আমার মধ্যে আমার দাদার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। গ্রামসির জন্মশতবর্ষ পালন উপলক্ষে ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি এবং ফন্দেজিওন ইন্সতিতো গ্রামসি ইতালিতে আমার ও আমার বাবার জন্য একটি ভ্রমণের আয়োজন করে। আমরা প্রায় ছয় মাস ইতালিতে থেকে সার্দিনিয়া থেকে শুরু করে তুরি পর্যন্ত গ্রামসির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সব স্থান ঘুরে দেখি (পরিচিতজনদের জন্য তুরির জেলখানায় আমার ও ফ্রান্সেসকা ভ্যাকার আয়োজন করা সংগীতানুষ্ঠানটি আমাদের সফরের সবচেয়ে আবেগঘন অনুষ্ঠান ছিল।) এই মাসগুলো অসাধারণ সব ঘটনায় পরিপূর্ণ ছিল। আমি নিজেকে ইতালীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করাচ্ছিলাম এবং আমার দাদা এর জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে পেরেছিলাম। ফিরে এসে আমি পূর্ণ উদ্যমে নিয়মানুগভাবে ইতালীয় এবং অল্পস্বল্পভাবে রুশ অনুবাদে গ্রামসির যে কাজগুলো ছিল, তা পড়া শুরু করি। তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে আমার দেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বুঝতে চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামসির চিন্তার প্রতি আমার আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর কাজের মাধ্যমেই আমি আমাদের বুদ্ধিজীবীদের পালন করা ধ্বংসাত্মক ভূমিকা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারি। বুদ্ধিজীবীরা নতুন সরকারের সমর্থনে জনমতামত গড়ে তোলে, যা রাশিয়াকে লুটতরাজের পথে নিয়ে যায়। পেরেস্ত্রোইকার বছরগুলোতে এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়। আমি গ্রামসি বিশেষজ্ঞে পরিণত হইনি—আমি একজন জীববিজ্ঞানী এবং সংগীতশিল্পী—তবে আমার চিন্তাচেতনা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আমাদের সময়ের কথা বলতে গেলে আমি বলতে পারি এই করাল ঐতিহাসিক সময়ে আন্তোনিও গ্রামসির মতো একজন বুদ্ধিজীবীর প্রয়োজনীয়তা আমি সত্যিকার অর্থে অনুভব করি, যিনি দ্বিধাবিভক্ত এবং আদর্শিকভাবে নপুংসক বিভিন্ন উপদলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার সামর্থ্য রাখতেন। এই উপদলগুলোকে বিরোধী দলও বলা যায় না। এরা ‘ঐতিহাসিক ব্লকে’ নিজেদের নিমজ্জিত করে রেখেছে। দুই দশক ধরে রাশিয়াকে শাসন করা দুর্নীতিবাজ ও নৈরাশ্যবাদী নতুন শাসকদের দমনমূলক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি সঠিক কৌশল নির্ধারণ করতে এরা অক্ষম।
গ্রামসিকে আঁকড়ে ধরার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি আমি ২০০০-এর দশকে নিই। এই সময়ে ফন্দেজিওন ইন্সতিতো গ্রামসির সঙ্গে কাজ করার অংশ হিসেবে আমি গ্রামসির রাশিয়ান পরিবারের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা শুরু করি। আমি তখনো জানতাম না যে গ্রামসির ইতিহাস পুনর্নির্মাণের এসব মিতাচারী ও অবিন্যস্ত প্রচেষ্টা একটি গোটা গবেষণা প্রকল্পের জন্ম দেবে। এর মাধ্যমে আমার দেশ ও আমার দাদার জীবনের ইতিহাস পুনর্নির্মাণে আমি ক্ষুদ্র অবদান রাখতে পারব বলে আশা করি। জুলিয়া সুগেতর পরিবার উভয় বিষয়ের সঙ্গেই নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল।৪ রাশিয়ার বুদ্ধিজীবীদের একাংশের বেশ চমকপ্রদ ঐতিহাসিক নজির আছে। এরা সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং নিজেদের সামাজিক ‘পূর্বানুমান’ থেকে দূরে থেকে ও রাষ্ট্রের নতুন মূল্যবোধব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করার মাধ্যমে বিপ্লবের নামে নিজেদের শ্রেণির সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। অন্যদিকে সুগ্ত পরিবার আমার দাদার জীবনের ওপর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উভয়ভাবেই গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এই অনন্য পরিবারটি গ্রামসি ও বিপ্লবী রাশিয়ার মধ্যে দৃঢ় বন্ধনের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেতুবন্ধের কাজ করেছে। অন্যদিকে, আমার মতে, গ্রামসির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ধোঁয়াশে কিছু ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে রাশিয়া অন্যতম মাধ্যম। এর মধ্যে কয়েকটির কথা আমি বলব।
প্রথম বিষয়টি হচ্ছে গ্রামসি ও লেনিনের মধ্যকার সম্পর্ক। ১৯৭০-এর দশক থেকেই এটা জানা ছিল যে বলশেভিকদের নেতা এবং ইতালীয় কমিউনিস্টদের ভবিষ্যত্ নেতার মধ্যে প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯২২ সালে। সোভিয়েত নথি থেকে আমরা দেখি যে ১৯২২ সালের ২৫ অক্টোবর ক্রেমলিনে লেনিনের অফিসে এই দুই নেতার প্রথম সাক্ষাত্ হয়। ১৯৭২ সালে প্রথম প্রকাশিত বায়োগ্রাফিক্যাল রেকর্ডস অব লেনিন-এ দুই নেতার মধ্যে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি তালিকা আছে। সবগুলো বিষয়ই ছিল গুরুত্বপূর্ণ: ইতালির দক্ষিণাঞ্চলের খুঁটিনাটি, ইতালির সমাজতান্ত্রিক দলের অবস্থা এবং কমিউনিস্টদের সঙ্গে এর একীভূত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। রেকর্ডটি তৈরির সময় ইনস্টিটিউট অব মার্ক্সিজম-লেনিনিজম ইতালীয় কমিউনিস্টদের সহযোগিতায় এই ঐতিহাসিক সাক্ষাত্-সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিবেদন খুঁজে দেখার দায়িত্ব আমার বাবাকে দেয়। একমাত্র চিঠিটি আসে ক্যামিলা র্যাভিরার কাছ থেকে। গ্রামসি নিজে র্যাভিরাকে যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন তার ওপর ভিত্তি করে র্যাভিরার দৃঢ় অনুমান হচ্ছে: এই সাক্ষাত্ই লেনিনকে অ্যামেদিও বর্দিগার পরিবর্তে আমার দাদাকে ইতালীয় কমিউনিস্টদের নেতা বানাতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বর্দিগার অনমনীয় এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব লেনিনকে হতাশ করেছিল।৫ কিন্তু এর অল্প কয়েক মাস পরেই প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথায় র্যাভিরা এই কথাগুলো বলেননি কেন? প্রখ্যাত ইয়ুসেপ্পি ফিওরিসহ গ্রামসির সব জীবনীকারেরাই এই বিষয়টি খেয়াল করলেন না কেন?৬ গ্রামসি নিজে লেনিনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাকারী এবং সুগ্ত ও ইলিয়ানভ পরিবারদ্বয়ের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনোই কোনো চিঠি বা প্রবন্ধে কেন এই বিষয়টি উল্লেখ করলেন না? এই আশ্চর্য নীরবতার কারণ হতে পারে বর্দিগার প্রতি আমার দাদার বিনয়। রাজনৈতিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ও মূল্যবান বন্ধু হিসেবে গ্রামসি বর্দিগাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। তবে এই ব্যাখ্যা হয়তো অতটা সোজাসাপ্টাও না।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে গ্রামসিকে কারাগার থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টাগুলো। এ ক্ষেত্রেও, প্রখর মেধাবী বিশেষজ্ঞদের (উল্লেখযোগ্যভাবে অ্যাঞ্জেলো আন্তনিও রোসি এবং ইসেপ্পে ভাস্কা, গ্রামসি ট্রা মুসোলিনি ই স্টালিন, ২০০৭) প্রয়াস সত্ত্বেও সত্যটি এখনো দ্বিধান্বিত রয়ে গেছে। আমাদের পারিবারিক নথিপত্র ঘেঁটেও আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু খুঁজে পাইনি। সবচেয়ে সম্ভাব্য পূর্বানুমান হচ্ছে: বন্দী হিসেবে গ্রামসিকে গুরুত্বপূর্ণ বস্তুগত সহায়তা দিলেও, ফ্যাসিবাদীদের কারাগার থেকে গ্রামসিকে মুক্ত করতে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ ঐকান্তিক কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি। তারা কার্যকারিতাহীন লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন এবং সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবেই তাতিয়ানা সুগ্তকেও এই কাজে জড়িয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রেও আমাদের কাছে বিদ্যমান ব্যাখ্যাটি সন্তোষজনক নয়। স্তালিন আর্কাইভনির্ভর কোনো গবেষণা থেকে এই সম্পর্কে উন্নততর ধারণা পাওয়া যেতে পারে, যদিও আজ পর্যন্ত সেখানে কারও প্রবেশাধিকার নেই।
১৯৩৬ সাল থেকে শুরু করে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই কয়েক মাস আমার দাদার জীবনের সবচেয়ে রহস্যাবৃত সময়। এখন পর্যন্ত সম্পাদিত সব গবেষণা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক ও জীবনী-সম্পর্কিত যে সাধারণ প্রশ্নটির সম্পূর্ণ উত্তর আমাদের কাছে নেই তা হলো: কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর গ্রামসি কী করার পরিকল্পনা করছিলেন? সমসাময়িক বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে একটি মতবাদ হচ্ছে: গ্রামসি ইতালীয় কর্তৃপক্ষের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে পুনরায় একত্র হতে পারবেন এবং সম্ভবত তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে পারবেন। পিয়েরো স্রাফার মতামতের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া এই ধারণা আমার কাছে অতিসরলীকৃত মনে হয়।৭ আমাদের পারিবারিক আর্কাইভ থেকে আমার সম্প্রতি আবিষ্কার করা তাতিয়ানার সেই সময়কার চিঠিপত্র থেকে এ বিষয়ে আরও নির্মোহ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা যায়। একইভাবে রোমের ফন্দেজিওন গ্রামসির সিলভিও পোনস কর্তৃক ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে রাশিয়ান স্টেট আর্কাইভস থেকে আবিষ্কার করা দলিলাদি আরও জটিল চিত্র হাজির করে। এই দলিলাদি অনুসারে ১৯৩৬-৩৭ সাল নাগাদ সোভিয়েত নিরাপত্তা বাহিনী এনকেভিডির সদস্যরা গ্রামসির কাছ থেকে ইতালীয় ট্রটস্কিপন্থীদের সম্পর্কে তিনি যা জানেন তার সবকিছু জানতে চায়। দুই মাস ধরে তারা চেষ্টা চালিয়ে যায়। গ্রামসির উত্তর ছিল: ইতালীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করতে পারলে তারা তাদের প্রয়োজনীয় সব তথ্য পেয়ে যাবে। গ্রামসি একটি নতুন উসকানির আশঙ্কা করছিলেন। এই বিষয়ে আরও প্রশ্নের উদয় হয়: আনুষ্ঠানিক মর্যাদাসহ বা ব্যতিরেকে মস্কোতে ফেরার প্রতিদান হিসেবে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ কি গ্রামসিকে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার শর্ত দিয়েছিল অথবা, ১৯২৬ সালের অক্টোবরে ট্রটস্কিকে সমর্থন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে গ্রামসির লেখা বিখ্যাত চিঠির কারণে তারা কি পরোক্ষভাবে তাঁকে এটাই বোঝাতে চেয়েছিল যে ট্রটস্কিপন্থীদের প্রতি সহানুভূতির দাগ এখনো তাঁর গায়ে আছে? যা-ই হোক না কেন, গ্রামসির ভাগনি এডমে গ্রামসির মতে, ঠিক এই সময়েই স্যান্টো লুসার্জিতে জরুরি ভিত্তিতে একটি কক্ষ খুঁজে বের করতে সার্দিনিয়াতে তাঁর পরিবারকে একটি চিঠি লিখেছিলেন গ্রামসি। কিন্তু তিনি সার্দিনিয়াতে কী করতে চেয়েছিলেন? ২৪ মার্চ ১৯৩৭ সালে ইউজেনিয়াকে লেখা একটি চিঠিতে তাতিয়ানা লেখেন, ‘আন্তোনিও বিশ্বাস করে যে সার্দিনিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ইতালি থেকে পালিয়ে যাওয়া অনেক বেশি কষ্টসাধ্য। আমরা এটার উল্লেখ করতে পারছি না পাছে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।’ এই অংশটিকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা করব? ভ্যাকা ঠিকই বলেছেন, পালিয়ে যাওয়ার মতো সামর্থ্য গ্রামসির ছিল না। আমি বিশ্বাস করি, আমার দাদা সোভিয়েত কর্তৃপক্ষকে পরোক্ষভাবে এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে এর কয়েক বছর আগে বর্দিগা যেমন করেছিলেন, অনুরূপভাবে রাজনৈতিক জীবন থেকে চিরতরে অবসর গ্রহণ করে ইতালিতে থেকে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা তাঁর নেই। এটা হতে পারে যে স্রাফার বক্তব্যও একইরকম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। তবে ১৯৩৬ সালে স্রাফা গ্রামসির সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলেন এবং তিনি গ্রামসিকে মস্কো ট্রায়াল সম্পর্কে সাম্প্রতিক খবরাখবর জানিয়েছিলেন। এই ট্রায়ালটি ছিল ধারাবাহিকভাবে চলমান একাধিক ট্রায়ালের একটি। এর মাধ্যমে লেনিনের নিকটতম সহযোগীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ ট্রটস্কিপন্থী হওয়ার দোষে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। নীরবতা ছিল গ্রামসির প্রতিক্রিয়া, একটি ‘অনুচ্চারিত মন্তব্য’, যার মধ্যে সম্ভবত আতঙ্ক ও ধিক্কার লুক্কায়িত ছিল। তিনি নিজে বা নিজের পরিবারের জন্য ছাড় না দিয়ে নীরব ছিলেন। তাতিয়ানার চিঠিপত্র (এবং অন্যান্য উত্স থেকে) এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আমার দাদার স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়েছিল এবং তিনি এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলে এই অবস্থায় তাঁর রাশিয়ায় যাওয়ার কথা না। গ্রামসি চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পূর্বে জুলিয়া এবং তাঁর সন্তানেরা যেন তাঁকে দেখতে আসেন। এই গোটা বিষয়টি নিয়ে আমার ধারণা হচ্ছে, ১৯৩৬ সালের শুরুর দিকে পর্যন্ত গ্রামসি প্রকৃতপক্ষেই সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা করছিলেন; তবে এই বছরের শেষের দিকে তাঁর নিজের স্বাস্থ্য এবং রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতির (যেমনটি স্রাফা তাঁকে জানিয়েছিলেন এবং এনকেভিডির আচরণে যা তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন) ফলে তিনি তাঁর পরিকল্পনায় আমূল পরিবর্তন আনেন এবং ফিওরির বিশ্বাসমতে, গ্রামসি স্বদেশেই অবসর গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আমার দাদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তাঁর জীবন ও ধারণাগুলোর প্রতি আমার আগ্রহের চেয়েও বেশি কিছু। গ্রামসির নাতি এবং এক প্রকারভাবে তাঁর শিষ্য হওয়ার দরুন তাঁর স্মৃতি এবং যে আদর্শের কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন সেগুলোকে যেকোনো ধরনের স্বার্থসাধন ও সব ধরনের অনুমাননির্ভরতা থেকে মুক্ত করা আমার দায়িত্ব। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামসিকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপরীতে স্থাপন করার বা তাঁকে কমিউনিজমের শিকার হিসেবে বর্ণনা করার প্রচেষ্টাগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে। ম্যাসিমো ক্যাপরারা থেকে শুরু করে ইয়ানকার্লো ল্যাহনার পর্যন্ত অনেক ইতালীয় লেখক এসব বিষয় পক্ষপাতদুষ্ট কথা বলছেন।৮ যেমন এটা বলা হয়ে থাকে যে সোভিয়েত পার্টি এবং তাঁর রাশিয়ান পরিবার তাঁকে পরিত্যাগ করেছিল। ল্যাহনারের মতে, ১৯৩৪ সাল থেকে শুরু করে গ্রামসির মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিত্সার খরচ ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বহন করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক উদ্ধার করা গ্রামসির পরিবারকে তাতিয়ানার লেখা চিঠি থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে বিষয়টা এ রকম ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, তাঁর স্বামীর যত্নের জন্য জুলিয়া নিয়মিতভাবে তাতিয়ানাকে বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতেন এবং নিশ্চিতভাবেই এই টাকার মূল জোগানদাতা ছিল সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ।
এত বছর ধরে জমতে থাকা সব আবর্জনা আমি ঘাঁটতে যাব না। যেমন তোগলিয়াত্তির সাবেক সচিব ক্যাপরারা আভাসে-ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেছেন যে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা গ্রামসিকে প্রলুব্ধ করার জন্য জুলিয়া সুগ্তকে পাঠিয়েছিল বা একই সংস্থা জুলিয়ার বোন তাতিয়ানাকে গ্রামসির ওপর নজরদারি করার জন্য নিয়োগ দিয়েছিল বা সুগ্ত পরিবার গ্রামসির সন্তানদের তাদের বাবার আদর্শ সম্পর্কে কোনো কিছুই জানায়নি ইত্যাদি। এই ছাইপাঁশগুলো এতটাই এগিয়েছিল যে শ্রদ্ধাভাজন লউগি দা ম্যাজিস্ট্রি মৃত্যুশয্যায় গ্রামসির সঙ্গে কথা হয়েছিল বলে দাবি করেন। কুইসিসানা হাসপাতালে একই সময়ে চিকিত্সাধীন এক বৃদ্ধার সাক্ষ্য হাজির করে এও বলা হয় যে আমার দাদা জানালা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বা তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।
আমার দাদা এবং আমাদের পরিবার সম্পর্কে সম্ভবত এগুলোই সর্বশেষ মিথ হলে ভালো হতো, কিন্তু বিধি বাম। সাংস্কৃতিক অধঃপতনের এই অবস্থায় গ্রামসি সম্পর্কে (এবং অন্যদের সম্পর্কে) কল্পকাহিনি তৈরি চলমান আছে। গণমাধ্যম দ্বারা মানুষের চৈতন্যকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে তা আরও ঘনীভূত হচ্ছে। হারম্যান হেস তাঁর উপন্যাস দ্য গ্লাস বেড গেম-এ যেমনটা চিহ্নিত করেছেন যে এই যুগটা হচ্ছে ‘হাস্যরসময় প্রবন্ধের যুগ’, এমন একটি অদ্ভুত সময় যখন পারস্পরিক উদ্ধৃতায়নের মাধ্যমে সৃজনশীলতা ও সত্যিকার গবেষণা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি ‘এই মহান এবং একই সঙ্গে ভয়ানক পৃথিবীতে’ মানবিক মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে চাই তবে একজন কর্মী, বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী এবং একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই বিদ্বেষপ্রবণ প্রবণতাগুলোর বিরোধিতা করা আমাদের দায়িত্ব।
টীকা
১. লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় অ্যাংলিও ডি’ওরসি সম্পাদিত ইনচিয়েস্তা সু গ্রামসিতে ২০১৪ সালে। ২০১২ সালের ২০ জানুয়ারি তুরিনের তিয়াত্রো ভিত্তোরিয়াকে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারের ওপর ভিত্তি করে লেখা।
২. মাত্তিও বার্তোলি (১৮৭৩-১৯৪৬) একজন ডায়ালেক্টোলজিস্ট। তিনি বহু বছর তুরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক ছিলেন।
৩. পালমিরো তোগলিয়াত্তি (১৮৯৩-১৯৬৪) গ্রামসির পরে ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
৪. জুলিয়ার বাবা অ্যাপোলন (১৮৬১-১৯৩৩) ছিলেন স্যাক্সন বংশের জার জেনারেলের পুত্র। তাঁর সম্মানিত চাকরির স্বীকৃতির কারণে তিনি খুবই মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। তিনি ইউক্রেনের একজন সম্মানিত ইহুদি আইনজীবীর মেয়ে জুলিয়া হার্শফেল্ডকে বিয়ে করেন। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই জনতুষ্টিবাদী ছিলেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে গোপন বিপ্লবী দল চালানোর দায়ে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। লেনিনের ভাই আলেক্সান্ডারের সঙ্গে একই সময়ে তাঁকে ১৮৯৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পশ্চিম সাইবেরিয়ার তমেস্ক নির্বাসনে পাঠানো হয়। পরে তাঁকে সামারায় নির্বাসিত করা হয়। প্রায় ছয় বছর পর পিটার্সবার্গে ফিরে এসে অ্যাপোলন দ্রুত তাঁর পরিবারকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে সুইজারল্যান্ডে এবং পরে ফ্রান্স ও ইতালিতে। সেখানে তিনি ১৯১৬ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন। পিটার্সবার্গে ফিরে এসে তিনি ১৯১৭ সালের শুরুতে বলশেভিক বিপ্লবে অংশ নেন। ইউজেনিয়া তখন সেখানেই ছিলেন এবং জুলিয়া তাঁর পথ অনুসরণ করে চলে আসেন। দুই বোনই একই বছরের সেপ্টেম্বরে দলে যোগদান করেন। তাঁদের মতো অ্যাপোলনও নতুন রাষ্ট্রে বেতনভুক্ত পদবি নেন। ১৯২২ সালে প্রথম গ্রামসির সঙ্গে এই বোনদের দেখা হয়।
৫. ক্যামিলা র্যাভেরা (১৮৮৯-১৯৮৮) ছিলেন রাজনীতিবিদ এবং ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। অ্যামেদিও বর্দিগা (১৮৮৯-১৯৭০) দলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম নেতা।
৬. ইয়ুসেপ্পি ফিওরি, আন্তোনিও গ্রামসি: লাইফ অব আ রেভল্যুশনারি (১৯৬৬), লন্ডন, ১৯৭১।
৭. পিয়েরো স্রাফা (১৮৯৮-১৯৮৩) ছিলেন একজন নব্য-রিকার্ডিও অর্থনীতিবিদ ও গ্রামসির ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
৮. ম্যাসিমো কাপরার (১৯২২-২০০৯) ছিলেন ইতালীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং কার্যনির্বাহক। ২০ বছর তোগলিয়াত্তির ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পরে ম্যানিফেস্টো দলের সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর তিনি ক্যাথলিকতাবাদে মগ্ন হন এবং তাঁর কমিউনিস্ট অতীতকে অস্বীকার করেন। তিনি মধ্য-দক্ষিণপন্থীদের একজন প্রচারক বনে যান। গিয়ানকার্লো ল্যাহনার (১৯৪৩-) দক্ষিণপন্থীদের একজন ব্যাপক প্রচারক এবং মারাত্মকভাবে কমিউনিস্টবিরোধী। তিনি সিলভিও বের্লুসকুনির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। এর তথ্য নির্দেশ হলো তাঁর লা ফ্যামিগলিয়া গ্রামসি ইন রাশিয়া, মিলান ২০০৮।
মূল প্রবন্ধের উত্স: নিউ লেফট রিভিউ ১০২, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০১৬, পৃ. ৬৯-৭৫।
অনুবাদক: গোলাম মুস্তাফা