দ্য জিওপলিটিকস অব ইমোশনস: হাউ কালচারস অব ফিয়ার, হিউমিলিয়েশন অ্যান্ড হোপ আর রিশেপিং দ্য ওয়ার্ল্ড—দমিনিক মোইসি দ্য বডলি হেড লন্ডন, ২০০৯
বিশ্ব জ্ঞানভান্ডারকে বিধৌত করেছে, এমন মননের অন্যতম উত্পত্তিস্থল হিসেবে ফরাসি জাতিকে চিহ্নিত করায় কোনো অতিমাত্রিকতা নেই। কি দর্শন, কি সাহিত্য, কি শিল্পকলা, প্রত্নতত্ত্ব বা স্থাপত্যশিল্প—প্রতিটি অঙ্গনে ফরাসিদীপ্তির ছাপ অলঙ্ঘনীয়। তবে কেবল অবদানের অঙ্ক কষে একে মূল্যায়ন করা শ্রেয় নয়। ভিন্নধর্মী, অপ্রচলিত অবস্থান, নতুন দৃষ্টিকোণ ও নতুন প্যারাডাইম সৃষ্টি ফরাসি সৃজনশীলতার সঙ্গে অবিভাজ্য হয়ে আছে। ভিক্তর হুগো-ফ্লবারের ধ্রুপদি সাহিত্য, সার্ত্র-কামুর অস্তিত্ববাদী দর্শন, মিশেল ফুকোর আধুনিকোত্তর দর্শন (পোস্ট-মডার্ন), মনে-সেজানের অন্তমুদ্রণাশ্রয়ী (ইমপ্রেশনিস্ট) চিত্রশিল্প—তার সব না হলেও কয়েকটি উদাহরণ। তবে প্রজ্ঞার এ চিরপরিচিত ক্ষেত্র ছেড়ে ফরাসি পাণ্ডিত্য যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির দুয়ারে আঘাত হানবে, যেখানে ইঙ্গ-মার্কিন আধিপত্য অতিমাত্রায় উচ্চারিত, সেটি ভাবা কঠিন ছিল এত দিন। সেটি উপলব্ধি করা গেল ঠান্ডাযুদ্ধের সমাপ্তি এবং নতুন বিশ্বব্যবস্থার উদ্ভবের ক্রান্তিলগ্নে এসে। আমাদের স্মরণে আছে, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিদায়ে কী ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্ম হবে, এর সম্ভাব্যতাকে ঘিরে জন্ম নেয় নানা ধরনের আলোচনা। সে সময় দুটি বিশ্লেষণ, এবং দুটিই মার্কিন ঐতিহ্য থেকে আসা, বিশেষভাবে অনুপ্লাবিত করে বিশ্ব ব্যুত্পত্তি জগেক। এর একটি ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার ইতিহাসের সমাপ্তি (The End of History and the Last Man) থিসিস, অন্যটি স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষ (The Clash of Civilisations) তত্ত্ব। আজ বলা চলে, তৃতীয় ধারার আগমনী বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে ফরাসি পাণ্ডিত্যের ফসল ‘Geopolitics of Emotions’ নামের একটি লেখা। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক দমিনিক মোইসির এ লেখাটি প্রথমে প্রকাশ পায় প্রবন্ধ আকারে, ফরেন অ্যাফেয়ার্স জার্নালে, ২০০৭ সালে। প্রবন্ধটি যখন বিদগ্ধ পাঠকের হাতে পড়ে, তখন এটিকে পূর্ণ গ্রন্থাকারে প্রকাশের দাবি আসে। ২০০৯ সালে আমরা হাতে পাই মোইসির উল্লিখিত গ্রন্থটি, যাকে ফরাসি ম্যাজিক বলে অনেকে আখ্যায়িত করেছেন। মোইসি তাঁর গ্রন্থের আদি নাম দিয়েছিলেন দ্য ক্ল্যাশ অব ইমোশনস। এ শিরোনাম পরবর্তী সময়ে কেন তিনি পরিবর্তন করেন, এর কোনো উল্লেখ নেই। যদিও ধরে নেওয়া যায়, নামকে কেন্দ্র করে তিনি অযথা কোনো পলেমিক্সে জড়িয়ে পড়তে চাননি। এর চেয়ে পাঠকের কাছে নিজ বক্তব্যের সারবস্তু পেশ করা তাঁর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। নাম পরিবর্তন হলেও মোইসির রচনাটি হাতে নিয়ে ধরে নেওয়া যায় যে এটি উল্লিখিত ওই দুটি দৃষ্টিকোণকে আক্রমণ করেই কেবল লেখা নয়, এর বিকল্পও বটে। নিঃসন্দেহে লেখাটি সে লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হয়েছে—ওই বিশ্লেষণের শক্ত বাঁধনকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে।
বাংলাদেশি বিদগ্ধ পাঠকের কাছে বইটি কতটুকু পরিচিত, সেটি পরিমাপ করা কঠিন। কিন্তু তাদের সংখ্যা যা-ই হোক না কেন, তাদের কাছে মোইসির উদ্দেশ্য সহজ-সরল হিসেবে প্রতীয়মান হবে। বিশ্বায়ন (গ্লোবালাইজেশন) নামের যে প্রক্রিয়া বৈশ্বিক জীবনকে আজ প্রভাবিত করছে, এর একটি জুতসই ব্যাখ্যা দেওয়া তিনি অত্যন্ত জরুরি মনে করেছেন এবং যে যুক্তির ওপর তিনি তাঁর মতাদর্শের মূল গাঁথুনিটি নির্মাণ করেছেন সেটি হলো, এ বিশ্বরাজনীতিকে আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার সময় এসেছে। এ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির স্থাপত্য নির্মাণে আবেগের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে কি না, সেটি অনুধাবন করা প্রয়োজন। পরখ করে দেখা আবেগ দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, মানুষের জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করা সম্ভব কি না। ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য বাবরি মসজিদ ও এর অবমাননা এক শক্তিশালী আবেগ হিসেবে কাজ করে। এ আবেগ নিয়ে ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায় বেঁচে আছে সংগ্রাম করে ও আশায় অনুপ্রাণিত হয়। একইভাবে ২০০৮ সালে মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীদের মুম্বাই শহর আক্রমণ এবং তাদের পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ আবেগাপ্লুত করে হিন্দু সম্প্রদায়কে। ইসলামি জঙ্গিবাদ মোকাবিলা সে কারণে তাদের অস্তিত্বের সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়, স্থান করে নেয় তাদের সমষ্টিগত মনস্তত্ত্বের গভীরে। অন্যদিকে, আরব বিশ্বের জন্য ইসরায়েলের হাতে লাঞ্ছনা ও পরাজয় এক গভীর ক্ষত হিসেবে বিরাজমান। এ ক্ষত মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক, মানসিক ও আত্মসম্মানকে প্রভাবিত করে। একে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক অঙ্ক কষা ও রাজনৈতিক নীতিনির্ধারণ সম্ভব নয়। আবেগের প্রভাব থেকে পশ্চিমা বিশ্বও মুক্ত নয়। একদিকে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ, অন্যদিকে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা এর জন্য এক অশনিসংকেত। যে অনিশ্চয়তার মধ্যে পশ্চিমা বিশ্ব আজ নিমজ্জমান, তা থেকে একধরনের ভীতি আজ একে গ্রাস করে আছে। কিন্তু আবেগের এ চিত্র কতটুকু গ্রহণযোগ্য—যখন প্রচলিত বিচারে আবেগকে মনোবিজ্ঞানের প্রত্যয় হিসেবেই কেবল দেখা হয় এবং সে কারণে এর প্রয়োগমূল্য মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বাইরে নগণ্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এ সন্দেহ আমাদের মনে উদয় হলেও মোইসির মনে এ ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব্ব নেই। তিনি লিখেছেন:
One cannot fully understand the world in which we live without trying to integrate and understand its emotions. Emotions are like cholesterol, both good and bad. The problem is to find the right balance (p. x)
উল্লেখ করা প্রয়োজন, আবেগকেন্দ্রিক বিশ্লেষণের রেওয়াজ যে একেবারে আকস্মিক, তা কিন্তু নয়। অতীতে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতির বিশ্লেষণে অনেকেই আবেগের প্রভাবে সম্মোহিত হয়েছেন। আবেগের তীব্র অনুভূতির সামাজিক ও শৈল্পিক মূল্য সম্পর্কে উল্লেখ আছে প্লেটো থেকে হবস ও কান্ট থেকে হেগেলের ভাববাদী দর্শনে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লব এবং প্রজ্ঞার বিজয় দিয়ে যে আধুনিক সমাজের জন্ম হয়, এর অতিমাত্রিকতায় ক্লান্ত হয়ে অনেক কবি, সাহিত্যিক ও দার্শনিক আবেগভিত্তিক নতুন আন্দোলন গড়ে তোলেন প্রজ্ঞার রাহু থেকে মুক্তির আশায়। বুর্জোয়া উদারনীতিবাদের হূদয়হীনতা, অর্থনৈতিক একগুঁয়েমি, উপযোগবাদ ও বস্তুবাদ এবং ক্যাশ নেক্সাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ জন্ম নেওয়া রোমান্টিকবাদী আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে আমরা জানি টমাস কার্লাইল, বেঞ্জামিন দিগ্রাইলি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলি, কিটস, বায়রন, ব্লেক প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদকে। মানুষের প্রকৃতিকে অভিন্ন হিসেবে দেখার যে পরামর্শ প্রজ্ঞাকেন্দ্রিক চিন্তাকাঠামো দেয়, এ ধারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ। কারণ, ব্যক্তির আবেগ ও সৃজনশীলতার মুক্তভ্রমণ এ প্রজ্ঞাকাঠামো বাধাগ্রস্ত করে। কেবল ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে আবেগের প্রায়োগিক মূল্য বাণবিদ্ধ হয়েছিল মার্ক্সের বস্তুবাদী বিশ্লেষণে—তখন আবেগের বদলে শ্রেণীস্বার্থ স্থান করে নেয় বৌদ্ধিক জগতে।
যা-ই হোক, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল এবং কেন আবেগ বিশ্বরাজনীতি বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে, সে সম্পর্কে মোইসি দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, একটি হলো, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক উত্তরণের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। এ উত্তরণ সূচিত হয়েছে শীতলযুদ্ধের (কোল্ড ওয়ার) সমাপ্তির মুহূর্ত থেকে। ৪৫ বছরের শীতলযুদ্ধের আদর্শিক লড়াই সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে ইউরোপ এবং পরে গোটা বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স তাদের এককালের মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আঁতাত গড়ে তোলে এবং শুরু হয় বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা। শীতলযুদ্ধের দীর্ঘসূত্রতা পৃথিবীকে একধরনের স্থিতিশীলতা উপহার দিয়েছিল বটে; কিন্তু এর মূল ভিত্তি ছিল আদর্শ (সমাজতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র)। আদর্শের দোহাই দিয়ে সেকালে সবকিছু বৈধ করার রেওয়াজ ছিল—কি আঞ্চলিক যুদ্ধ, কি সামরিক অভ্যুত্থান ও ভিন্ন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ। এ আদর্শিক সংঘর্ষের সমাপ্তি ১৯৮৯ সালে বার্লিন দেয়ালের পতন, অধিকৃত আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ ভাঙনের মধ্য দিয়ে ঘটে। সে সময় থেকেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি আদর্শকে সমভাবে নির্বাসিত করেছে ইতিহাসের গহ্বরে। এ আদর্শের সংকট দিয়ে শেষ হয়েছে এমন এক যুগের, যাকে ঐতিহাসিক হব্স্বম চরম সময়কাল (এজ অব এক্সট্রেমস) হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। কিন্তু যে গুণগত পরিবর্তন শীতলযুদ্ধ সমাপ্তির পর লক্ষ করা গেল, তাতে ছিল এক বড় মাপের উত্তরণের ইঙ্গিত—আদর্শভিত্তিক মেরুকেন্দ্রিকতা থেকে আত্মপরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির। এর প্রভাবে বিশ্বরাজনীতিতে আজ দেখা দিয়েছে এক নতুন মেরুকরণের। ধীরে হলেও আদর্শের স্থান দখল করতে উদ্যত মানুষের আত্মপরিচয়। মোইসির দৃষ্টিতে:
Today, as we shall see, quests for identity by peoples uncertain of who they are, their place in the world, and their prospects for a meaningful future have replaced ideology as the motor of history, with the consequence that emotions matter more than ever in a world where media is playing a role of a sounding board and a magnifying glass (p. 4).
আত্মপরিচয়ের সঙ্গে আবেগের সুগভীর সম্পর্ককে অস্বীকার করা কঠিন এবং সে কারণে মোইসির দৃষ্টিকোণের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, আমার পূর্বসূরি কে, আমার বর্তমান অবস্থা কেন এমন হলো, ভিন্ন হতে পারত কি ইত্যাদি সব প্রশ্ন যেমন ব্যক্তিমানুষকে বিদ্ধ করে, তেমনি করে জাতিকে। ওই একই প্রশ্ন অবলীলাক্রমে বাংলাদেশের ৪০ বছরের স্বাধীনতা-উত্তরকালকে সামনে রেখে করা সংগত। কতটুকু পেলাম, বাকিটা কেন পেলাম না ইত্যাদি প্রশ্ন আমাদের মনের গভীরে স্থান নিয়ে আছে। ব্যক্তিজীবন আজ সে কারণে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, যত না সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদযুদ্ধ। এর চেয়ে আমি কে, বাঙালি হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে আমার অবস্থান কোথায়, এ অবস্থান থেকে উত্তরণ সম্ভব কি না এবং কীভাবে ইত্যাদি প্রশ্ন। এ আত্মপরিচয়ের পরিমণ্ডল আজ যেভাবে স্ফীত হচ্ছে, তাতে করে একে এক প্রবল সুনামির স্রোতের সঙ্গেই কেবল তুলনা করা চলে। উদাহরণের জন্য বেশি দূরে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। অতিসম্প্রতি আমরা লক্ষ করেছি, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ জাতীয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিমজ্জিত—বসনিয়া থেকে ইউক্রেন, ইউক্রেন থেকে জর্জিয়া পর্যন্ত যার বিস্তৃতি। আরব বিশ্বের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অন্তর্জ্বালার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আদর্শবর্জিত আবেগের জোয়ার লক্ষ করা গেছে। একে বিশ্লেষণ করা কঠিন হলেও মিসরের হোসনি মোবারক থেকে শুরু করে সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের উত্খাত-সংগ্রামে সম্ভবত ওই একই অনুভূতি ইন্ধন জুগিয়েছে আংশিকভাবে হলেও। আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম আজ সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী। মোইসি এ অনুভূতির সারমর্মকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে:
Today’s globalised world is the ideal fertile ground for the blossoming of or even the explosion of emotions. Globalization causes insecurity and raises the question of identity. In the cold war period there was never any reason to ask “who are we?”. The answer was plainly visible on every map that depicted the two adversarial systems dividing the globe between them. (p.12)
অবশ্য বিশ্বায়নের অভ্যন্তরীণ চালিকাশক্তি কী এবং কেন আবেগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হলো, সে সম্পর্কে মোইসির কোনো দ্বিধা নেই। আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি আজ যে তীব্রতা অর্জন করেছে, সেটি প্রযুক্তির ভূমিকা ছাড়া কখনোই সম্ভব হতো না। মধ্যপ্রাচ্যের বিপ্লবের জোয়ারকে বসন্তবিপ্লব নামে আখ্যায়িত করা হলেও অনেকে একে টুইটারবিপ্লব নামেও অভিহিত করেন, যার গভীরে প্রোথিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার নতুন মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তির অভাবনীয় প্রভাব। আমরা কোনো বিশেষ প্রয়াস ছাড়াই আজ স্বচক্ষে দেখছি, বিশ্ব আজ কত বেশি খোলামেলা হয়েছে, প্রযুক্তি মানুষের মনের অন্তর্নিহিত গভীর আবেগ প্রকাশের ক্ষমতা কত বেশি বাড়িয়েছে, সে কারণে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বিশ্ব আজ অনেক বেশি স্বচ্ছ। দূর প্রান্তে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে মানুষ অবগত হচ্ছে। গণমাধ্যম সৃষ্টি করছে বিশ্ব পরিমাপে নিজের অবস্থান অনুধাবন এবং নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখার সুযোগ। আত্মপরিচয়ের প্রশ্নটি সে কারণে আদর্শের চেয়েও অনেক বেশি জরুরি। এ যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়তোবা আরও সম্ভব হতো না, যদি গণমাধ্যমের ওপর একচেটিয়া পশ্চিমা আধিপত্য খর্ব না হতো। আল-জাজিরা থকে শুরু করে অন্যান্য মিডিয়ার আবির্ভাবে গণমাধ্যমে সূচিত হয় একধরনের বিপ্লব, যেটি এককালের পূর্ব-পশ্চিম বিভাজনকে চ্যালেঞ্জ করে। বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব জনতা সংখ্যালঘিষ্ঠ ধনিকশ্রেণীর জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় নিজের অবস্থানকে তুলনা করতে সক্ষম হচ্ছে মিডিয়াভিত্তিক তথ্যের আয়নায়, একে অন্যের প্রতিচ্ছবি দেখে। তারা আজ স্পষ্টত দেখছে শাসকের চরিত্র, জাতির স্খলনের কারণ খুঁজে নেওয়া সহজ হচ্ছে আনুপাতিকতানির্ভর বিচারের সহায়তায়। আদর্শিক ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ, জাতি ও গোত্রের যে আবেগ জমাট বেঁধেছিল, বিশ্বের বিচ্ছিন্নতা ঘুচে যাওয়ায় সেটি মূর্ত হয়ে উঠেছে। ঠিক যেমন পণ্য, আদর্শ, অর্থ, পুঁজি ও মানুষ মুক্তভাবে চলাফেরা করে, তেমনি আত্মপরিচয়ের আবেগও বাধাহীন গতিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে অভিগামী। সীমান্তের বাধা এক অদৃশ্য শক্তির প্ররোচনায় উন্মুক্ত। আবেগের স্রোতধারায় মিলিত হচ্ছে বিশ্বের সব মানুষ, প্রভাবিত করছে একে অন্যের সংস্কৃতি ও আবেগকে।
বিশ্বায়ন-অনুসৃত এ পরিবর্তন অবশ্য একমাত্র পরিবর্তন নয়, পাশাপাশি চোখে পড়ে তার আরও এক রূপ, সেটি হলো নিরাপত্তাহীনতা। মোইসি লিখেছেন, ‘বিশ্বায়নের প্রভাব সব জাতি ও রাষ্ট্রের মনে আশঙ্কা এবং আশঙ্কা থেকে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়। এর সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই।’ ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে সন্ত্রাসী আক্রমণ এর একটি উদাহরণ। এ নিরাপত্তাহীনতা উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের ঘাড়ে চাপল, কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই বলতে হয়। শীতলযুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন একে দেখা হয়েছিল স্বৈরশাসনের ওপর গণতন্ত্রের, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর ধনতান্ত্রিক, উদারনীতিক দর্শন ও রাষ্ট্রনীতির এবং সোভিয়েতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিজয় হিসেবে। বিশ্ব বলতে বোঝানো হলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এককেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে, কিন্তু কে ধারণা করেছিল যে অতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এই এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা বহুকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে। বহুকেন্দ্রিকতার এ ভিত—যেটি চীন, ভারত, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশের অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক সাফল্যে গড়ে ওঠা, সেটি আজও তেমন সুপ্রতিষ্ঠিত নয় বটে; কিন্তু এর গোড়াপত্তন যে ঘটেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। মোইসি লিখেছেন:
If the twentieth century was both “the American century” and the “century of ideology,” I think there is strong evidence that the twenty-first century will be “the Asian century” and the “century of identity.” The parallel shifts from ideology to identity and from West to East mean that emotions have become more important than ever in the way we see the world (p. 14)
তবে এ বহুকেন্দ্রিকতা সত্য হলেও তার মধ্যে লক্ষ করা যায় একধরনের প্যারাডক্স, যেটি আজ এমনকি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকেও এড়ায় না। সারা বিশ্বের মনোজগত্ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আমেরিকান সংস্কৃতির প্রভাবে—অপ্রতিরোধ্যভাবে। অথচ বিশ্ব অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি আজ আমেরিকা বা ইউরোপের হাতে নেই—সেটি ধীরে হলেও স্থানান্তরিত হয়ে চলে এসেছে এশিয়ার হাতে। ২০০৮ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সংকট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চলমান অভ্যন্তরীণ সংকট এবং অনিশ্চয়তার কারণে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের আগের শক্তি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি চীন, ভারতের মতো এশীয় দেশে চলছে যুগান্তকারী উত্থান। মোইসির অপ্রতিসম বহুকেন্দ্রিকতার (অ্যাসিমেট্রিক মাল্টি-পোলারিটি) চিত্র পশ্চিমা বিশ্বের জন্য একেবারে নতুন, তাদের পক্ষে তাঁকে হজম করা আরও কঠিন। সে কারণে তাঁর মনে সঞ্চিত হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতার বীজ। অতীতের গৌরবময় কাল তাঁর দৃষ্টি থেকে দ্রুত অপস্রিয়মাণ—অতীতের স্মৃতির মধ্যে জন্ম নেওয়া নস্টালজিয়া তাঁর আবেগের মূল উত্স। ফলে এশিয়ার তুলনায় ভিন্ন চরিত্রের হলেও বিশ্বায়নসৃষ্ট আবেগের প্রভাব থেকে পশ্চিমা বিশ্ব মুক্ত নয়, তাঁর মনন ওই আবেগের স্রোতধারায় সিক্ত—অজানা এক ভবিষ্যতের চিন্তা তাঁকে আবেগাপ্লুত করে অনেক বেশি—অন্যান্য যেকোনো অঞ্চল এবং সময়ের তুলনায়।
এদিক দিয়ে বিচার করলে তাহলে বলতে হয়, বিশ্বায়নের এ অসম বিকাশ জন্ম দিয়েছে দুই পৃথিবীর—এর একটি আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে নিমজ্জমান, অন্য জগিট ভীতি ও অনিশ্চয়তার ধূম্রজালে ম্রিয়মাণ। এ বিভ্রান্তিকর চিত্র মোইসির মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির চিরাচরিত ব্যুত্পত্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। চিরাচরিত বিশ্লেষণ বলতে আমাদের বুঝতে হবে বাস্তববাদী (রিয়েলিস্ট) নামের পরিচিত এক তাত্ত্বিক স্রোতধারাকে, যেটি এতকাল প্রচণ্ড দাপট নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির তাত্ত্বিক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। বাস্তববাদী ধারায় গড়ে ওঠা তাত্ত্বিক কাঠামোর সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো, এটি অতিমাত্রায় রাষ্ট্রকেন্দ্রিক, যেটি বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে অপাঙেক্তয়। কারণ, আন্তরাষ্ট্রীয় সংযোগ আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে একক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক কোনো প্যারাডাইম কার্যকরী হওয়া কঠিন। ওই বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিবেশকে অত্যন্ত বৈরী হিসেবে চিত্রায়িত করে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম—এমন আন্তর্জাতিক সংগঠনের অভাব রয়েছে এবং সে কারণে ওই দায়িত্বটি নিজের হাতে নেওয়া ছাড়া রাষ্ট্রের অন্য কোনো গত্যন্তর থাকে না। যেখানে নৈরাজ্য বিরাজ করে, সেখানে আত্মরক্ষার নীতিই একমাত্র কার্যকর—রাষ্ট্রের শক্তি বাড়ানো সে কারণে বাস্তববাদীদের কাছে বেদবাক্যের মতো। তারা নৈতিক মূল্যবোধতাড়িত কোনো নীতিমালার প্রতি সংবেদনশীল নয়—অন্য রাষ্ট্রের প্রতি সংযমশীলতা, দয়া ও বৃহত্তর মানবতার কল্যাণের ধ্রুপদি বাণী সে কারণে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। ওই রাষ্ট্রস্বার্থকেন্দ্রিক মানসিকতা প্রতিফলিত হয় তাদের তাত্ত্বিক কাঠামোয়, যার মধ্যে তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—(ক) রাষ্ট্রকেন্দ্রিক নীতিমালা প্রণয়ন (খ) নিজের স্বার্থের লক্ষ্যে সব ধরনের পদক্ষেপকে নৈতিক হিসেবে দেখা এবং (গ) স্বনির্ভরতা। এ তিনটি প্রতিপাদ্য প্রাচীন গ্রিক বাস্তববাদী তাত্ত্বিক থুসিডাইডেস পেলপনেসিয়ান যুদ্ধবিশ্লেষণে প্রয়োগ করেছিলেন। আজও আধুনিক বাস্তববাদী তাত্ত্বিকেরা, যাঁদের পুরোধা হিসেবে আছেন কার, কেনেথ অয়ালজ ও মরগেন্থুরের মতো পণ্ডিতজন, বিশ্লেষণের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে দেখেন থুসিডাইডেস, ম্যাকিয়াভেলি, টমাস, হবস ও রুশোর মতবাদকে। এঁরা সবাই নৈতিকতাকে অর্থহীন এবং রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর মনে করেন। এ যুক্তির ওপর ভর করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রজ্ঞাভিত্তিক (বেসড অন রিজন) বিশ্লেষণের এক প্রাসাদ গড়ে উঠেছে, যার মূলে আছে আজকের যুগে অনুসৃত ক্ষমতার ভারসাম্যতত্ত্ব, নিরসনমূলক হামলা (প্রিয়েমটিভ অ্যাটাক), পারমাণবিক নিরোধকতা (নিউক্লিয়ার ডিটারেন্স) ইত্যাদি নীতিমালা।
মোইসির মতে, ওই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক চিন্তাকাঠামোর সঙ্গে একবিংশ শতাব্দী সংগতিপূর্ণ নয় এবং ভিন্ন হওয়ার কারণে পুরোনো ওই বিশ্লেষণকাঠামো এর জন্য অনুপযোগী। এ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বরাজনীতির পোস্টারটি দুটি দার্শনিক বিশ্লেষণে প্রতিফলিত হয়। উভয়ই প্রত্যক্ষবাদী দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ায় মোইসির বিশ্লেষণে এরা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা, আমাদের স্মরণে আছে, ইতিহাসের সমাপ্তি (The end of history and the last man) ঘোষণা করেছিলেন এ দাবিতে যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের কারণে উদারনীতিবাদ ও পশ্চিমা গণতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় সাধিত হয়েছে এবং সে কারণে মানবজাতি আদর্শিক বিকাশের শেষ বিন্দুতে উপনীত হয়েছে—ফুরিয়ে গেছে আর কোনো আদর্শিক কাঠামো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। ফুকুইয়ামা লিখেছিলেন:
What we may be witnessing is not just the end of the cold war, or the passing of a particular period of post war history, but the end of history as such; that is, the end point of mankind’s ideological evolution and the universalisation of Western liberal democracy as the final form of human government. (15)
দার্শনিক হেগেলের বিশ্ব ইতিহাস ধারণায় প্রভাবিত এ বিশ্লেষণ যে অতিমাত্রিক উন্নাসিক, পশ্চিমাঘেঁষা ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিক, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার অসারত্ব প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। বিশেষ করে, আজ যখন উদারনীতির ঘূর্ণিবলয়ে নিমজ্জিত বিশ্ব অর্থনীতি এবং গণতন্ত্র এক কঠিন সংকটের মধ্যে নিপতিত। উদারনীতিনির্ভর দর্শনশাসিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও উত্তর আমেরিকা বহুলাংশে চীনের অগ্রগতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। দাবি করা অযৌক্তিক নয়, পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে চীনের পুঁজি দিয়ে। চীনের অগ্রগতি কোনো উদারনীতি-আশ্রিত প্রজেক্ট নয়, সেটি সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে। ওই অলৌকিক উন্নয়নের মূলে রয়েছে ভিন্ন ধরনের আধুনিকতা, যাকে এশীয় আধুনিকতা নামে আখ্যায়িত করা চলে। এ আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য বলতে পুঁজিবাদের সঙ্গে কর্তৃত্ববাদের মিশ্রণকে বোঝায়, অনেকে যাকে পুঁজিবাদ ও এশীয় মূল্যবোধের মিশ্রণ হিসেবেও দেখেন। যদি দাবি করা হয় যে সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদকেন্দ্রিক আদর্শের বিস্ফোরণপীড়িত বিংশ শতাব্দীর রাজনীতি শেষ হয়েছে, যেটি ফুকুইয়ামার অন্যতম বিবৃতি, তাহলে একবিংশ শতাব্দীকে ইতিহাসের সমাপ্তির পরিবর্তে অ্যাংলো-সাক্সন নব্য-উদারনীতিবাদের পরাজয় এবং চীন-সিঙ্গাপুরীয় পুঁজিবাদের বিজয় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করাই শ্রেয়। বলা বাহুল্য, ফুকুইয়ামার অতি সরলীকৃত বিশ্লেষণে তিক্ত হয়ে মোইসি উপহার দিয়েছেন তাঁর বিকল্প বিশ্লেষণটি।
মোইসির মডেল ও তাঁর আক্রমণের অন্য টার্গেট হলো স্যামুয়েল হান্টিংটনের সভ্যতার সংঘর্ষ তত্ত্ব, যেটি ফুকুইয়ামার তত্ত্বের মতোই সরলীকৃত। হান্টিংটনের দাবি, ফরাসি বিপ্লবের পর সংঘাতের যে চরিত্র আন্তরাষ্ট্রীয় ছিল, সেটি রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আদর্শের সংঘাতে পরিণত হয়। এ দাবির সঙ্গে মোইসির দ্বন্দ্ব নেই। শীতলযুদ্ধের অবসানের পর কমিউনিজম, ফ্যাসিবাদ ও উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক আদর্শভিত্তিক প্রতিটি সংঘাত ইউরোপের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী—এ যুক্তি মেনে নিলেও ওই সংঘর্ষ যে ইউরোপ বনাম অইউরোপীয় সংঘর্ষে রূপ লাভ করেছে, সেটি মেনে নিতে রাজি নন। রাজি নন ইউরোপীয় সভ্যতা, আরব অথবা চীনা সভ্যতার ভিন্নতাকে পুঁজি করে সংঘর্ষের চিত্র আঁকতে। হান্টিংটন লিখেছিলেন:
Differences among civilisations are not only real; they are basic. Civilisations are differentiated from each other by history, language, culture, tradition and most important, religion. (p.25)
হান্টিংটন অবশ্য অস্বীকার করছেন না যে পৃথিবী আজ এক বিবর্তের ধারায় আক্রান্ত, যে বিবর্তনের চরিত্র মোইসির বিশ্লেষণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘A West at the peak of its power confronts non-West's that increasingly have the desire, the will and the resources to shape the world in non-Western ways’ (p.26)। কিন্তু তাঁর দাবি হলো, বিভিন্ন সভ্যতা যেহেতু পাশাপাশি অবস্থান করে, তাদের মধ্যে সুগভীর খাদ বিদ্যমান। বিশেষ করে, মুসলিম সভ্যতা ও পশ্চিমা জুডায়ে-খ্রিষ্ট সভ্যতায় এবং সভ্যতার মধ্যে পরিবর্তন যেহেতু অতি ধীরে ঘটে, সেহেতু ওই খাদ সহজে অতিক্রান্ত হয় না। এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। পশ্চিমা সভ্যতার সঙ্গে ইসলামি বিশ্বের সংঘর্ষ এক হাজার ৩০০ বছরের পুরোনো হতে পারে, কিন্তু ইসলামি বিশ্বকে একক ও অভিন্ন সত্তা ভাবা এর অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্যকে, সে বিচিত্রতা সাংস্কৃতিক, দেশীয়, জাতিগত ও ভৌগোলিক হতে পারে, উপেক্ষা করা নিতান্তই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ওই বিচিত্রতার মধ্যে যে প্রগতিশীলতার উপাদান নেই, সে দাবিও অযৌক্তিক, অপ্রমাণিত।
সংগত কারণেই মোইসি এ দুই চিত্রের পরিবর্তে এঁকেছেন আবেগভিত্তিক বিশ্ব মানচিত্রের নিজ রূপরেখা, যেটি এখানে বিচার করা যায়। মোইসির মতে, তিনটি আবেগের সাহায্যে বিশ্বের রাজনৈতিক চিত্র আঁকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো হলো আশা, অবমাননা ও ভীতি, এরাই আজকের বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রক। এ তিনটি আবেগ কেবল আবেগ নয়, এরা একাধারে একেকটি প্রতীক, যার সহায়তায় বিশ্বরাজনীতিকে তিনটি আবেগপ্রভাবিত অঞ্চলে বিভক্ত করা সম্ভব। তাঁর মতে, প্রথম অঞ্চলটি হলো এশিয়া, যে মহাদেশ আজ ‘আশা’ আবেগে আপ্লুত। এখানে আশা বলতে মোইসি আত্মপ্রত্যয় বা আত্মবিশ্বাসকে বুঝিয়েছেন। তাঁর মতে, গত দুই শতকে এশিয়ার ভূমিকায় অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর ম্রিয়মাণ এশিয়া আজ স্বাধীন এক রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত হয়েছে। এ আশাবাদ প্রকাশিত হচ্ছে সংস্কৃতির উদারতায়। আজ চীন ও ভারতে ‘ধনী হও এবং শান্ত থাকো’—এ নীতি মূলধারায় পরিণত হয়েছে। চীন অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকার উত্তরসূরি হবে। ভারত পৃথিবীর সর্ববৃহত্ গণতন্ত্র। জাগ্রত ভারতের বৃহত্ সাম্রাজ্যের ইতিহাস নেই এবং পশ্চিমা গবেষণায় ভারতকে দীর্ঘকাল ধরে বিচার করা হতো আধ্যাত্মিক জগত্ হিসেবে। আজ সেখানে অদক্ষতা, দুর্নীতি, সম্পদ বিতরণে মেরুকরণ ও বর্ণপ্রথা থাকতে পারে; কিন্তু তা সত্ত্বেও এক নতুন গৌরববোধ তার অন্তর্নিহিত শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আজ তার পরিচয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশ দ্বারা চিহ্নিত। মধ্যপ্রাচ্য ও ইসলামি বিশ্ব দ্বিতীয় এক অঞ্চল, যেখানে এশিয়ার আশাভিত্তিক ভবিষ্যতের তুলনায় ‘অবমাননা’র আবেগ প্রাধান্য পায়। অবমাননার অর্থ হলো অক্ষমতা। এ অক্ষমতা তার গৌরবময় অতীতের সঙ্গে বেমানান। এ অঞ্চল মানবসম্পদের দিক থেকে ঊর্ধ্বমুখী, অথচ রাজনৈতিকভাবে নিম্নগামী। ইসরায়েলি রাষ্ট্র গঠন এবং ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ এ অবমাননার অংশ, যদিও এর কারণ ইসলাম নয়, বরং একনায়কতন্ত্র ও মৌলবাদ। অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্বে বিরাজ করছে ‘ভীতি’র আবেগ। এককালের বিশ্ব চালিকাশক্তির ভূমিকা থেকে অপসারিত হয়ে এ অঞ্চল বিশ্বায়নের যুগে কি রাজনীতিতে, কি অর্থনীতিতে পরাভূতপ্রায়।
আবেগের সহায়তায় ইতিহাসের এ গতিপথ বিশ্লেষণ যদি আমরা গ্রহণও করি, এর পরও প্রশ্ন থেকে যায়, এটি কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত। কেন বিজ্ঞানসম্মত, সে প্রশ্নের উত্তর ও যুক্তি যথেষ্ট ক্ষুরধার। প্রথমত, তিনি প্রমাণ করতে চান যেকোনো বাস্তবতা—সে প্রকৃতিজগত্ হোক অথবা রাষ্ট্র-রাজনীতিসংশ্লিষ্ট হোক—কখনোই মনঃকল্পনাবর্জিত নয়। এখানে পাঠক দেখবেন ফরাসি মননের দার্শনিক ভিন্নতাকে, যেটি জ্ঞানতত্ত্বের আপেক্ষিকতা দ্বারা প্রভাবিত। মোইসির দাবি, প্রকৃতিজগতের বিভিন্ন উপাদান, যেমন—জনসংখ্যা, সম্পদ ও জ্বালানির উত্সকে বিকৃতভাবে রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের নিমিত্তে উপস্থাপন করা সম্ভব। একইভাবে যেকোনো দেশের মানচিত্রকেও অখণ্ড এবং স্থায়ী ভাবা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, আরব বিশ্বের কাছে ইসরায়েলের মানচিত্রের কোনো অস্তিত্ব নেই। একইভাবে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলি মানচিত্রে জুডায়া ও সামারিয়া হিসেবে উল্লিখিত করা হয়। তুর্কিদের জন্য সাইপ্রাসের মানচিত্র ভিন্ন, গ্রিসের জন্য যেটি উপযোগী নয়। সৌদি আরবের জন্য আরব উপসাগর আরবীয়, অথচ ইরানের জন্য সেটি পার্সিয়ান। যুদ্ধ ও রাজনৈতিক আঁতাত প্রতিনিয়ত ওই মানচিত্রকে বদলে দিচ্ছে। ভাঙন ও গঠনের মাধ্যমে জন্ম হচ্ছে নতুন রাষ্ট্র এবং জাতির। পোল্যান্ডের কথা ভাবা যায়, দেশটি প্রায় ১০০ বছর ধরে স্বাধীন দেশ হিসেবে হারিয়ে গিয়েছিল বিশ্বমানচিত্র থেকে (১৭৯৫-১৯১৮)। প্রতিবেশীরা পোল্যান্ডকে নানা ভাগে বিভক্ত করে শাসন করেছে ওই ১০০ বছর। লেবাননে ধর্মীয় সংখ্যালঘিষ্ঠদের প্রকৃত সংখ্যা কখনো সত্যকে প্রতিফলিত করেনি রাজনৈতিক কারণে। ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় ১৯৪৫ থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে এ মানচিত্রের যত্সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। আজ এর পরিবর্তন ঘটছে প্রতিনিয়ত, বিশেষ করে, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে। ফলে যে ভূখণ্ডকে মানচিত্র প্রকাশ করে, তা তো অভিন্ন, অপরিবর্তনীয় কোনো ক্যাটাগরি নয়, বরং সেটি মানুষের গোত্র আবেগ ও ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে—এর আদলেই সেটি প্রকাশ পায়।
দ্বিতীয় কারণ হলো, দীর্ঘকাল ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে ভাবার অধিকার ছিল কেবল মুষ্টিমেয় বিশেষজ্ঞের, যাঁরা সমাজের এলিট। এঁরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে দাবা খেলা হিসেবে দেখেছেন, যেখানে সরকার ও রাষ্ট্র সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যস্ত। তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে জটিল, বিস্তীর্ণ ও বহুমুখী প্রবণতায় ভরপুর একটি ক্ষেত্র হিসেবে দেখেন এবং সে কারণে এর অনুধাবন বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে দাবি করেন। রাষ্ট্র যেসব স্বতঃসিদ্ধ প্রত্যয়ের সহায়তায় তার নীতিনির্ধারণ করে—যেমন: জনসংখ্যা, রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সীমানা, অর্থনৈতিক সম্পদের পরিমাণ, সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থ—এর প্রতিটি প্রত্যয়কে বস্তুনিষ্ঠ, আবেগবর্জিত হিসেবে দেখা হয়। ফলে তাঁদের বিশ্লেষণে আবেগের স্থান অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। আবেগকে নিতান্তই নরম, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও বিশ্লেষণের অনুপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে বৈজ্ঞানিক সূত্রনির্ভর, প্রত্যক্ষবাদী ও ইন্দ্রিয়প্রভাবিত বুদ্ধিজীবী মনন দ্বারা। এভাবে একাধারে আবেগকে সংযত রাখাও সম্ভব হয়েছে কৃত্রিম উপায়ে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে। মোইসির এ যুক্তিকে অবহেলা করা কঠিন। ধর্ম যদি অনুভূতি ও বিশ্বাসের আধার হয়ে থাকে, তাহলে এর ভিত্তিতে ইউরোপ তো যুদ্ধ করেছে ৩০ বছর ধরে। ধর্মীয় ক্রুসেডের কথা না হয় বাদই দেওয়া হলো। ১৬৪৮ সালে ওয়েস্ট ফালেন চুক্তিই কেবল সেই ধর্মীয় আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিল, যদিও এর পুনঃ বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।
তবে মোইসির সঙ্গে একমত হয়েও দুটি প্রশ্ন করা এখানে সংগত। প্রথমত, যে তিনটি আবেগ ব্যবহার করে মোইসি তাঁর বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছেন, এর বাইরেও অন্যান্য আবেগের অস্তিত্ব আছে, যেমন—ক্রোধ, ভালোবাসা ও সংহতি। এগুলো মোইসির বিশ্লেষণে অনুপস্থিত? দ্বিতীয়ত, আবেগ কি পরিমাপযোগ্য? যদি না হয়, তাহলে একে রাজনৈতিক বিজ্ঞানের প্রত্যয় হিসেবে বিবেচনার যৌক্তিকতা কোথায়? প্রথম প্রশ্নের উত্তরে মোইসির যুক্তি হলো, নির্বাচিত তিনটি আবেগের প্রতিটি একটি অভিন্ন আবেগের সঙ্গে যুক্ত, অন্য কোনো আবেগকে এ ছকে স্থাপন সম্ভব নয়। উল্লিখিত তিনটি আবেগকে একক বন্ধনে আবদ্ধ করে আত্মপ্রত্যয় তাদের একই বলয়ে অন্তরীণ রাখে। ভীতিকে আত্মপ্রত্যয়ের অভাব হিসেবে বিবেচনা করা শ্রেয়; আশা আত্মপ্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে; অবমাননা বলতে ক্ষতবিক্ষত আত্মপ্রত্যয়কে বোঝায়, যেখানে আশাহীনতার আধিপত্য নিশ্চিত।
মোইসি উল্লেখ করেছেন:
The reason I have chosen these three emotions is that they are closely linked with the notion of confidence, which is the defining factor in how nations and people address the challenges they face as well as how they relate to one another (p. 5).
মোইসি আবেগকে শুধু আত্মকেন্দ্রিক হিসেবে ভাবতে রাজি নন। তাঁর মতে, এরা পরিমাপযোগ্য। যেকোনো দেশ কতটুকু আত্মপ্রত্যয়ী, সেটি বিচার করা যায় নির্দিষ্ট সময়কালে এর খরচের প্যাটার্ন দেখে—কী পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ ঘটছে, এর ওপর। জাতীয় আত্মপ্রত্যয়ের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায় কোনো দেশের স্থাপত্যশিল্পে, সংগীতে অথবা শিল্পকলায়। ইউরোপের রেনেসাঁকালে শিল্প, সাহিত্য ও স্থাপত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে উঠতি বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের আত্মপ্রত্যয়। আজ ওই ধরনের আত্মপ্রত্যয়ের নিদর্শন মেলে চীনা জাতির কর্মকাণ্ডে। বিদেশি সভ্যতার ভীতি কাটিয়ে চীন তার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে গর্বের সঙ্গে বিশ্বজনতার সামনে তুলে ধরতে আজ কুণ্ঠিত নয়। চীনের জনপ্রিয় ধ্রুপদি রচনা আজ সে কারণে স্বাচ্ছন্দ্যে ইংরেজিতে অনুবাদ হচ্ছে। চীনের দেয়াল ভেঙে আজ বেরিয়ে আসছে নতুন আত্মপ্রত্যয়ী এক সমাজ। আজ চীনের রক্ষণাত্মক হওয়ার কোনো কারণ নেই। আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ আত্মপ্রত্যয় পরিমাপ করা সনাতনী প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে সেটি অপরিমাপযোগ্য।
সবশেষে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মোইসির বিশ্লেষণ ভৌগোলিক অবস্থানের সঙ্গে আবেগের পুরোপুরি সামঞ্জস্য দেখাতে সমর্থ হয়নি। সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত বটে; কিন্তু দেশটিকে অবমাননার কলঙ্ক দিয়ে অঙ্কন করা যায় না। সেখানে এশিয়ার মতো আশার আলো আছে। ফলে আশার দিক থেকে সেটি এশিয়ায়, যদিও ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে। এ ছাড়া এশিয়ার সব দেশ যে এ আশাবাদের মধ্যে নিহিত, সেটি দাবি করা যুক্তিযুক্ত নয়। মোইসির আলোচনায় মধ্য এশিয়া, কোরিয়া অথবা পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা আশাবাদী বলয়ের বাইরে, যদিও ভৌগোলিকভাবে তারা এশিয়ায়। জাপান ইউরোপ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবু সে তার আগের ভূমিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন। জাপান আজ নির্জীব। এশিয়া হওয়ার জন্য জাপান অতিমাত্রায় ইউরোপীয়, ইউরোপীয় হওয়ার ক্ষেত্রে জাপান অতিমাত্রায় এশীয়। তার পরও ইউরোপীয় ভীতি তার ভেতরে ঢুকেছে। জনসংখ্যা অতিমাত্রায় বয়স্ক, অর্থনীতি অনগ্রসর। জাপানের পাশাপাশি আরও বেশকিছু জটিল দেশ আছে, যেখানে মোইসির কাঠামো কার্যকর নয়, যেমন রাশিয়া। ইরানের ক্ষেত্রেও মোইসির যুক্তি প্রযোজ্য নয়। ইরান এগিয়ে চলেছে অবমাননাকে পাশ কাটিয়ে। অন্যদিকে, ইসরায়েলকে অবমানিতের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা চলে, যদি ধরা হয় ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার অবিচার ও দ্বন্দ্বের ইতিহাসকে। দক্ষিণ আমেরিকা মোইসির আলোচনায় সেভাবে উল্লিখিত নয়, যদিও ব্রাজিলের উন্নতি আকাশচুম্বী।
যা-ই হোক, সন্দেহ নেই মোইসির আলোচনা এক নতুন জগেক উন্মোচিত করে। প্রথাগত বিশ্লেষণের প্রভাবে প্রভাবিত আমাদের মনন এ ব্যুত্পত্তি জগতের সঙ্গে একমত না-ও হতে পারে। কিন্তু কে জানে, হয়তোবা মোইসির এ দৃষ্টিকোণ আগামী দিনের পথপ্রদর্শক হিসেবে গৃহীত হবে। ইতিহাসের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে প্রায় সব মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান তাদের প্যারাডাইমের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। শীতলযুদ্ধের অবসান এবং বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার উষালগ্নে রাজনৈতিক বিজ্ঞানে সম্ভবত সেটিই ঘটতে চলেছে।
গ্রন্থপঞ্জি
১. Fukuyama, F. ‘The End of History?’, Quadrant (August 1989), pp.15-25
২. Huntington, S.P., ‘The Clash of Civilisations?’, Foreign Affairs, Vol. 72, No. 3, (1993), pp. 22-49.
৩. Dominique Moisi (2009) The Geopolitics of Emotions : How cultures of Fear, Humiliation and Hope are Reshaping the World, London: The Bodley Head, pp. 174