দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট: আইসিস অ্যান্ড দ্য নিউ সুন্নি রেভল্যুশন —প্যাট্রিক ককবার্ন, ভার্সো, লন্ডন/নিউইয়র্ক ২০১৪/২০১৫, পৃষ্ঠা ১৯২
পটভূমি
দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট: আইসিস অ্যান্ড দ্য নিউ সুন্নি রেভল্যুশন বইটি প্যাট্রিক ককবার্নের অন্যান্য বইয়ের মতোই আলোচিত একটি বই। মধ্যপ্রাচ্যে আইসিসের উত্থানের কারণগুলো লেখক বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন বইটিতে। তিনি ৯-১১-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভুল নীতিকে দায়ী করেছেন আইসিসের উত্থানের মূল কারণ হিসেবে। এর সঙ্গে গালফ রাষ্ট্রগুলোর আইসিসকে অর্থনৈতিক মদদদান ও ইরাক-সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও রাজনীতি কীভাবে আইসিসের উত্থানের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল, লেখক তার বিবরণ দিয়েছেন বইটিতে।
১৯২ পৃষ্ঠার বইটিতে ৯টি অধ্যায় আছে। ২০ পৃষ্ঠার মুখবন্ধের পর প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে পুরো বইটির সারসংক্ষেপ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে মসুল দখলের মধ্য দিয়ে আইসিসের শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক উল্লেখ করেছেন আঞ্চলিক শক্তিগুলো কীভাবে তাদের নিজেদের স্বার্থে আইসিসকে মদদ দিয়ে তাদের নৃশংসতা উসকে দেয়। জিহাদিদের উত্থান, নেতৃত্ব ও অন্যান্য জিহাদি দলের সঙ্গে আইসিসের সম্পর্কের কথা চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন ককবার্ন। পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়, কীভাবে জিহাদিরা ইরাকে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে ককবার্ন লিখেছেন, কীভাবে জিহাদিরা সিরিয়ার আন্দোলন নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে। সৌদি আরব আইসিসকে অনড় সমর্থন ও মদদ দিয়ে এসেছে ইরাক ও সিরিয়াতে শিয়া পৃষ্ঠপোষক সরকার দমনের জন্য। আইসিস শুধু একটি ত্রাস সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নয়, বরং একটি আদর্শ, যা বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর নাগরিক দলে দলে আইসিসে যোগ দিচ্ছে। এই ‘নির্ভীক’ আইসিস জিহাদিরা যখন যুদ্ধ শেষে নিজ নিজ দেশে ফিরে আসবে, তখন তারা নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রতী হবে। এমতাবস্থায় আইসিসের মদদদাতা সৌদি আরব তাদের বিভিন্ন নীতিগত পরিবর্তন এনে এই দানব প্রতিহত করার চেষ্টা করছে, যার বর্ণনা সপ্তম অধ্যায়ে ককবার্ন দিয়েছেন। অষ্টম অধ্যায়ে আইসিস যুদ্ধে পক্ষপাতী ও দায়িত্বহীন পশ্চিমা গণমাধ্যমের নেতিবাচক আলোচনা করেছেন ককবার্ন। শেষ অধ্যায়ে লেখক আবারও আইসিসের উত্থানের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করে আরব বসন্ত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সম্ভাব্য অবস্থান ও নীতিগত পরিবর্তনই নির্ধারণ করবে আইসিসের ভবিষ্যত্।
ফরেন পলিসি জার্নালের মতে, ককবার্নের বইটি আইসিস বিষয়ে জানার জন্য যথার্থ। বইটি এই দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িত বিভিন্ন অংশীদারের ভূমিকা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে। মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধ যতই অগ্রসর হচ্ছে, ততই যেন এর প্রকৃতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিষয়ক লেখক সাইমম হার্শের মতে ককবার্ন বর্তমানে ইরাকবিষয়ক সবচেয়ে ভালো সাংবাদিক। নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে, বইটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বর্ণনার প্রাচুর্যে ভরা। দ্য অবজারভার-এর মতে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও সংকট সম্পর্কে লেখা বইগুলোর মধ্যে খুব কম বই বইটির মতো তথ্যসমৃদ্ধ।
ব্রিটিশ জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ডের বিচারকদের মতে, প্যাট্রিক ককবার্ন আইসিসের আবির্ভাব সম্পর্কে শুরু থেকেই সোচ্চার। আইসিস বিষয়ে এত গভীরতা, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক লেখা যখন তিনি লিখছিলেন, তখন আর কেউ এই আসন্ন হুমকির ভয়াবহতা সম্পর্কে সোচ্চার ছিলেন না। তাঁদের মতে, এমআই-৬ ব্রিটিশ ব্রিগেডকে বাদ দিয়ে প্যাট্রিক ককবার্নকে নিয়োগ দেওয়া উচিত। মার্কিন সাংবাদিক, সমাজকর্মী, লেখক ও প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাবেক রাজনৈতিক সহযোগী, সিডনি স্টোন ব্লুমেন্থাল হিলারি ক্লিনটনকে লেখা এক ই-মেইলে প্যাট্রিক ককবার্নকে ইরাক বিষয়ে সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ সাংবাদিক বলে উল্লেখ করেছেন।১
ককবার্নের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটেছে বইটিতে। আইসিস বিষয়ে যাদের জানার আগ্রহ আছে, তাদের জন্য বইটি চিন্তার খোরাক জোগায়। বইটিতে ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যে বিশদ আলোচনা আছে, তা এই বিষয়ে আগ্রহী পাঠক ও লেখকের জন্য নির্দেশক বই হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। তবে পুরো বইয়ে আইসিস উত্থানের কারণগুলো বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্নভাবে বর্ণনা করা আছে, যা কখনো পুনরাবৃত্তিমূলক ও কখনো প্রয়োজনাতিরিক্ত। লেখার ক্ষেত্রে বইটি কাঠামোহীন। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল ও ইরাকে আইসিসের উত্থান ও এই বিষয়ে তথ্য বিস্তারের আবশ্যকতা বিষয়ে পশ্চিমা রাজনীতিক ও গণমাধ্যম উদাসীন। সেই শূন্যস্থান পূরণের উদ্দেশ্যে ককবার্ন এই আলোচনামূলক বইটি লিখেছেন। বইটি মূলত তাঁর ইরাকে আইসিস বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। বইটিতে অন্য কোনো রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে বইটির প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারত, বইটি বর্ণনামূলক না হয়ে, তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা বিষয়ে সাক্ষাত্কারমূলক বা আত্মজীবনীমূলক বই হলে পাঠকের পড়ার ক্ষেত্রে হয়তো আর একটু স্বস্তিদায়ক হতো। বইটির স্বীকৃতি অংশে লেখক বলেছেন, বইটির বিভিন্ন অধ্যায় বিভিন্ন সময়ে, কখনো ২০১৪ সালে নিউইয়র্কের আর্ট ফাউন্ডেশনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বা ইনডিপেনডেন্ট ও লন্ডন রিভিউ অব বুকস-এর জন্য প্রবন্ধ লেখার সময় লেখা হয়েছে। তাই হয়তো ধারণা করা যায়, বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে লেখার মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব আছে। সে ক্ষেত্রে সম্পাদনার অপ্রতুলতা ধরা পড়ে বইটিতে। বইটির আর একটি বড় দুর্বলতা এখানে আইসিসের আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য বা চরিত্র নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি। বইটি ২০১৪ সালে আইসিসের মসুল দখলের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও কারণ বা যুদ্ধের প্রকৃতি বর্ণনা ছাড়াই যুদ্ধরত দলের উত্থানের কারণ সম্পর্কে বর্ণনা কিছুটা অসম্পূর্ণ বোধ হয়।
লেখক পরিচিতি
প্যাট্রিক ককবার্ন একজন আইরিশ নাগরিক, যিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও ১৯৯১ সাল থেকে ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাংবাদিক। ককবার্নের জন্ম ও বেড়ে ওঠা আয়ারল্যান্ডে। তাঁর বাবা-মা উভয়ই সুপরিচিত সমাজতান্ত্রিক লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। তিনি অক্সফোর্ডের ট্রিনিটি কলেজ থেকে লেখাপড়া করেছেন ও পরবর্তী সময়ে বেলফাস্টের কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আইরিশ স্টাডিজে গবেষণা ছাত্র হিসেবে ছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি জেনেট এলিজাবেথকে বিয়ে করেন, যিনি কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন।
ককবার্ন ইরাকের বর্তমান ইতিহাসের ওপর তিনটি বই লিখেছেন। Out of the Ashes: The Resurrection of Saddam Hussein (1999), যা ২০০২ সালে Saddam Hussein: An American Obsession নামে ব্রিটেন থেকে পুনঃপ্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা The Occupation: War and Resistance in Iraq (2006) বইটি ২০০৬ সালে ন্যশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল পুরস্কার পায়। তাঁর লেখা অন্য বইগুলো হলো ২০০৮ সালে Muqtada: Muqtada al-Sadr, the Shia Revival I the Struggle for Iraq, ২০১৪ সালে The Jihadis Return: Isis and the New Sunni Uprising, যা ৯টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, ২০১৫ সালে The Rise of Islamic State: Isis and the New Sunni Revolution ও ২০১৬ সালে Chaos and Caliphate: Jihadis and the West in the struggle for the Middle East। এ ছাড়া ২০০৫ সালে তিনি আত্মজীবনীমূলক লেখা লিখেছেন, The Broken Boy।
কাজের প্রশংসা ও সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অর্জন করেছেন বিভিন্ন পুরস্কার। ২০০৫ সালে মার্থা গেলহর্ন পুরস্কার, ২০০৬ সালে দ্য জেমস কেমেরন পুরস্কার, ২০০৯ সালে অরওয়েল পুরস্কার, ২০১৩ সালে এডিটরিয়াল ইন্টেলিজেন্স কমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে বর্ষসেরা বিদেশি বিবরণদাতা, ২০১৪ সালে ব্রিটিশ জার্নালিজম পুরস্কারে বর্ষসেরা আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা ও ২০১৪ সালে দ্য প্রেস অ্যাওয়ার্ডে বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
আইসিসের উত্থান
আইসিসের উত্থান জানতে হলে ফিরে যেতে হবে আশির দশকে, ১৯৭৯ সালে, যখন আফগান মুজাহিদিনদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের আইএসআই সাহায্য করেছিল সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে। সাফল্যের সঙ্গে সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধজয় তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে এবং এই মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী সময়ে তালেবানে পরিণত হয়। এই যুদ্ধ থেকে দুজন নেতার আবির্ভাব হয়, যারা ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত অপসারণের পর সৌদি আরব পাড়ি জমায়। একজন ওসামা বিন লাদেন, অপরজন আবু মুসাব আল জারকাওয়ি। আদর্শগতভাবে দুজনের মধ্যে ছিল ভিন্নতা। লাদেন সেখানে আল-কায়েদার জন্ম দেন ও জারকাওয়ি আল-তাউহিদ ওআল জিহাদ নামে ভিন্ন আর একটি দল গঠন করেন। তারপর তাঁরা দুজনেই আবার আফগানিস্তান ফেরত যান, যার কিছুদিন পরই ৯-১১ হামলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করলে ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তান ও আবু মুসাব আল জারকাওয়ি ইরাকে পালিয়ে যান। ২০০৪ সালে ইরাকে মার্কিন হামলায় সাদ্দামের পতনের পর অনেক ক্ষুব্ধ ইরাকি সেনাসদস্য ও সুন্নি মুসলমান বিভিন্ন বিদ্রোহী দলগুলোতে যোগদান করেন। তখন জারকাওয়ির দল শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও ইরাকে শিয়াদের বিরুদ্ধে ও মালিকি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আল-কায়েদা তখন জারকাওয়ির দলের সঙ্গে জোট গঠন করে, তখন এর নাম হয় আল-কায়েদা ইন ইরাক (একিউআই)। ২০০৬ সালে মার্কিন হামলায় জারকাওয়ির মৃত্যু হয় ও আল-কায়েদা ইন ইরাক নেতৃত্বশূন্য হয়। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাক ত্যাগ করার ঘোষণা দেন। ডিসেম্বরে সাদ্দামের ফাঁসি হয়। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন দিন দিন আমেরিকানদের তাদের সরকারের ওপর হতাশ করে তোলে। সরকারকে তারা চাপের মুখে ফেলে ইরাক যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। ইরাকে মার্কিন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অপ্রত্যাশিত ছিল। সাদ্দাম ও জারকাওয়ির মৃত্যু ইরাকের চলমান সহিংসতা কমাতে পারেনি। মার্কিনদের পক্ষে ইরাকের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব সমাধান করা যে অসম্ভব ও এই দ্বন্দ্ব দিনে দিনে যে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, সেটাও তাদের জ্ঞাত ছিল। তাই মার্কিনদের জন্য ইরাক ত্যাগ ছিল আবশ্যক।
২০১১ সালে মার্কিন বাহিনী ইরাক ত্যাগ করে। একই বছর আরবজুড়ে নামে বসন্ত। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, মরক্কোসহ একের পর এক আরব রাষ্ট্রগুলোতে যখন অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন হচ্ছিল, তার প্রচেষ্টা সিরিয়াতেও হয়। তবে সিরিয়ার শাসক শক্ত হাতে তাঁর শাসনের ভবিষ্যত্ নির্ধারণ করেছেন। যার ফলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সিরিয়ার এই যুদ্ধই মূলত আইসিসের আসল জীবনীশক্তি। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সব বিশ্বশক্তি একে অন্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অনুশীলনে ব্যস্ত। আর এই সুযোগেরই ফসল আইসিস।
সৌদিদের প্রচণ্ড রকমের শিয়া বিস্তারভীতি রয়েছে, যদিও ৫৭টি মুসলমান দেশের মধ্যে মাত্র ৪টি দেশে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও অল্প কিছু দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠতা আছে। যেকোনো মুসলমান দেশে রাষ্ট্রপ্রধান শিয়া হলে সৌদি আরবের ভীতি যেন আরও অনেক বেশি বেড়ে যায়। পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারিকে সৌদিদের ব্যাপক অপছন্দের কারণ তাদের ধারণা, তিনি শিয়া। সৌদি রাজা আবদুল্লাহ অনেকবার আমেরিকাকে বলেছেন ইরান আক্রমণের জন্য। একই কারণে ইরাকের মালিকি সরকার সৌদিদের অপ্রিয়। আরব-সিরিয়া সম্পর্ক সব সময়ই বিভিন্ন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রকাশ্যে আসাদবিরোধী দলগুলোকে সাহায্যের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক ছিন্ন হয়। আরব বসন্ত যখন সিরিয়ায় হানা দেয় ২০১১ সালে, আসাদ তখন তাঁর হাজতে থাকা সব জিহাদিকে মুক্তি দিয়ে দেন। জারকাওয়ির মৃত্যুর পর আবু বকর আল-বাগদাদি তাঁর দলের নেতৃত্ব দেন ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক’ বা ‘আইএসআই’ নামে।
২০১২ সালে বাগদাদির এক সহযোগী সিরিয়াতে গিয়ে ‘জাভাত আল-নুসরা’ নামে নতুন দল গঠন করেন আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। ২০১৩ সালে বাগদাদি সব আল-কায়েদা ও জিহাদি দলের ওপর তাঁর নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ও সিরিয়া বা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ও লেভান্টের’ ঘোষণা করেন। তখন ‘জাভাত আল-নুসরা’র সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে।
২০১৪ সালের গ্রীষ্মে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট’ (আইএসআইএল বা আইএসআইএস বা আইসিস) মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পটভূমি ও মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। ১০ জুন ইরাক, মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্ব হঠাত্ করে জানতে পারে, মসুল ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আইএসআইএস (আইএসআইএল/আইসিস) নামে এক উগ্র ইসলামি দলের দখলে চলে গেছে। এর বেশ কিছু মাস পর খবর পাওয়া গেল যে ইসলামপন্থী ও সব আল-কায়েদা সম্বন্ধযুক্ত দল বাগদাদের নিকটস্থ শহর ফালুজা থেকে তুরস্ক-সিরিয়া সীমানা নিকটবর্তী শহর রাকা পর্যন্ত দখল করেছে। আইসিসের এই নব্য দখলকৃত অঞ্চলকে তারা ‘খিলাফত’ বলে দাবি করে। আইসিস যোদ্ধাদের ককবার্ন জিহাদি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সামরিক নীতিতে দক্ষ এই জিহাদিরা ইরাক, সিরিয়া ও কুর্দিদের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিতভাবে জয়লাভ করে, ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তর অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ইরান-ইরাক সীমান্ত থেকে ইরাকি কুর্দিস্তান ও আলেপ্পোর বহিরাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই অঞ্চল ওসামা বিন লাদেনের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের থেকে আকারে কয়েক শ গুণ বড়, যাকে ককবার্ন ব্রিটেন বা মিশিগান অঙ্গরাজ্যের থেকেও আকারে বড় বলে চিহ্নিত করেছেন। সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর রাকা দখলের মধ্য দিয়ে মার্চ ২০১৩ সিরিয়া আইসিসের অধীন হতে শুরু করে। জানুয়ারি ২০১৪ সালে আইসিস ফালুজা দখল করে, যা বাগদাদ থেকে মাত্র ৪০ মাইল পশ্চিমে। কয়েক মাসের মধ্যেই তারা মসুল ও তিকরিত দখল করে।
সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ আইসিসের পুঁজি। আইসিসের উত্থান ও টিকে থাকার একটি বড় কারণ সিরিয়ার যুদ্ধ বলে মনে করেন ককবার্ন, যা তিনি বইটির চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। ককবার্ন শুরু করেছেন ২০১৪ সালে আইসিসের ধারণ করা একটি ভিডিওচিত্রের মধ্য দিয়ে। সেখানে বিদেশি জিহাদিরা সম্ভবত সিরিয়ার কোনো অঞ্চলে তাদের পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে জিহাদের প্রতি তাদের দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞা দেখায়। পাসপোর্টগুলোর রং দেখে বোঝা যায়, কিছু জিহাদি ছিল সৌদি, জর্ডানিসহ আরও অনেক জাতীয়তার। প্রত্যেকে যখন তাদের পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুনের শিখায় ছুড়ে মারছিল, তখন তারা নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছিল। এক কানাডীয় ইংরেজি ও আরবি ভাষায় কানাডা ও সব মার্কিন মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করে বলেন, ‘আমরা আসছি, আমরা তোমাদের ধ্বংস করে দেব।’ এক জর্ডানি বলেন, ‘আমরা আবু মুসাব আল-জারকাওয়ির উত্তরসূরি, আমরা তোমাদের মেরে ফেলব।’ সৌদি, মিসরীয় ও চেচেন প্রত্যেকেই একই প্রতিজ্ঞা করে। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র দেখলে দেখা যাবে যে পুরো ইউফ্রেটাস উপত্যকা, পশ্চিম ইরাক থেকে নিয়ে পূর্ব সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্ত পর্যন্ত আইসিসের বা ‘জাভাত-আল নুসরা’ (জান), যাকে মার্কিন বাহিনী ‘কোর আল-কায়েদা ইন পাকিস্তান’ বা ‘Core al-qaeda in Pakistan’ বলে আখ্যায়িত করে, তাদের দখলে।
আইএসআইএলে ২০১০ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন আবু বকর আল-বাগদাদি, যিনি আবু দুআ নামেও পরিচিত। তাঁর আদর্শ মূল আল-কায়েদা থেকেও বেশি সাম্প্রদায়িক ও নৃশংস। আয়মান আল জাওয়াহিরির পাকিস্তানে তাঁর ঘাঁটি ছিল। আবু বকর আল-বাগদাদি আলোচনায় আসা শুরু করেন যখন তিনি ২০১০ সালে আল-কায়েদা ইরাকের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ববর্তী নেতা মার্কিন ও ইরাকি বাহিনীর হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। আল-কায়েদা ইন ইরাকের সাংগঠনিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলে তা বিলুপ্ত হতে থাকে। আল-বাগদাদির নেতৃত্ব গ্রহণ ২০১১-তে সিরিয়ায় সুন্নি আন্দোলনের অস্তিত্বের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
সিরিয়াতে দ্রুত গৃহযুদ্ধ অবসানের আশা ক্ষীণ। হয়তো এক ইরাকের স্বপ্নও ক্ষণস্থায়ী। এর শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি অঞ্চলের মধ্যেকার বিভেদ বেড়ে চলেছে দিন দিন। তাই ককবার্ন মনে করেন, আইএস সমস্যা দ্রুত সমাধানের আশাও ক্ষীণ। কারণ, আইসিস শুধু নিজ দেশে গড়ে ওঠা একটি ক্ষমতালোভী দল নয়। আইসিসকে বিভিন্ন শক্তি নিজেদের সুবিধার্থে জন্ম দিয়েছে, লালন করেছে ও সুযোগে ব্যবহার করছে। ইরাকে যেমন শিয়া সরকারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তাদের দরকার, তেমনি সিরিয়াতে বাশার সরকারকে নামাতেও তাদের দরকার। আবার আসাদ সরকারেরও আইসিসকে দরকার সিরিয়ায় সহিংসতা জিইয়ে রাখার জন্য, যাতে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো আইসিসকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আইসিসকে দরকার মুলসিম দেশগুলোর মধ্যে সময়-সুযোগমতো ব্যবহার করতে। আইসিস যখন বিদেশি নাগরিকদের শিরশ্ছেদের নৃশংস চিত্র দেখিয়ে পৃথিবীকে ভয় দেখাচ্ছিল, তখন বিদেশি নাগরিক ও সাংবাদিকেরা ভয়ে ইরাক-সিরিয়ার পথ মাড়ানো বন্ধ করল। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় সুবিধা হলো যে তাদের এক দশকের ভুল নীতির চর্চা ও অনাবৃতকরণ কমে গেল ও আইসিস বিষয়ে খবর পাওয়ার সূত্র খুবই সংকীর্ণ হয়ে গেল। তাতে গণমাধ্যম এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হলো।
যেভাবে আফগানিস্তানে তালেবানদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে পরে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল আমেরিকা। তবে আইসিস তালেবান মডেল থেকে অনেক ভিন্ন। এখন তারা অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি হিংস্র। তাদের ব্যাপ্তি পৃথিবীব্যাপী। যে আদর্শের বলে আইসিস গঠন করা হয়েছে, আইসিসের সদস্য সংগ্রহ চলছে, তাতে আইসিস এখন শুধু একটি সন্ত্রাসী দল নয়, আইসিস এখন একটি আদর্শে পরিণত হয়েছে। আর এই আদর্শ এখন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।
ককবার্নের এই বইটির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা এখানে আইসিসের আদর্শ ও উত্থানের সূচনা সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই। তাই ইকোনমিস্ট বইটির পর্যালোচনায় বলে যে বাগদাদির খিলাফতের ডাক হঠাত্ করে এত নৃশংসতা ও বিস্তার কীভাবে লাভ করল, তার উত্স খুঁজতে গিয়ে এর আদর্শ সম্পর্কে একেবারেই কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না বইটিতে।২
আইসিসের উত্থানের কারণ
আইসিসকে লেখক বলেন যুদ্ধশিশু (পৃ. ৮)। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ ও ২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধের বদৌলতে এই সহিংস দলের জন্ম। সনাতন ধর্মীয় আদর্শ ও সামরিক দক্ষতাই এদের সম্বল। ককবার্ন উল্লেখ করেন, পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমের মতে, ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নুর-ই-আল-মালিকির সাম্প্রদায়িক নীতি ইরাকের অন্তর্দ্বন্দ্বকে আরও চলমান করেছে। অতঃপর সিরিয়া যুদ্ধ ইরাকের পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। সিরিয়ায় ইরাকি জিহাদিরা একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র পায় তাদের ক্ষমতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করার। আইসিসকে এই যুদ্ধের প্রতিটি খেলোয়াড় নিজের সুবিধামতো ব্যবহার করছে। তাই এর উত্থানের কারণ বহুমুখী। বইয়ের মুখবন্ধে ককবার্ন তাঁর এক সুন্নি মেয়েবন্ধুর ই-মেইলের কথা উল্লেখ করেছেন:
The bombardment was carried out by the government. The air strikes focused on wholly civilian neighborhoods. May be they wanted to target two ISIS bases. But neither round of bombardment found its target… The bombing hurt civilians only... The government bombardment did not hit any of the ISIS men… because of this bombardment youngsters are joning ISIS in tens if not in hundreds because this increases hatred towards the government (XVII).
এখানে প্রতীয়মান হয়, সাধারণ জনগণ আইসিসকে ঘৃণা করলেও ইরাকি সরকারি বাহিনীর আগ্রাসী পদক্ষেপে কীভাবে দিনে দিনে সরকারবিরোধী আক্রোশ আইসিসের প্রতি ঘৃণার থেকেও বড় হয়ে ওঠে।
ককবার্ন উল্লেখ করেন, ৬ জুন ২০১৪ ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর মসুল দখল করা ছিল আইসিসের উল্লেখযোগ্য বিজয়। ১৩ জুন আইসিস যোদ্ধারা ৬০ হাজার সৈন্যের ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়, যেখানে ইরাকি সামরিক ও পুলিশ বাহিনী ছিল যৌথভাবে। দুই বিপরীত বাহিনীর যোদ্ধাসংখ্যায় বিশাল পার্থক্য থাকলেও তা কেবল সংখ্যাই মাত্র। এই অবিস্মরণীয় বিজয়ের পেছনের আসল কারণ দুর্নীতি। সংখ্যা বড় হলেও বাস্তবে এর এক-চতুর্থাংশ উপস্থিত ছিল। বাকিরা তাদের বেতনের প্রায় অর্ধেক তাদের অফিসারদের দিয়ে লম্বা ছুটি কাটাত।
মসুল সব সময় নিরাপত্তাহীন ছিল। আইসিসের আগে আল-কায়েদা ইরাকে দুই মিলিয়ন সুন্নি মুসলিমের এই শহরে তত্পর ছিল। তখন তারা ব্যবসায়ীদের থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে চলত। লেখার এই অংশে ককবার্নের সাংবাদিকতার বিস্তর পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করে ইরাকের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি এক তুর্কি ব্যবসায়ীর উদাহরণ দেন, যিনি মসুলে নির্মাণকাজের চুক্তি নিয়েছিলেন। এক আইসিস নেতা তাঁর কাছে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার চাঁদা চেয়েছেন। তিনি বাগদাদ সরকারকে এ ব্যাপারে অবগত করেও কোনো ফল পাননি। আইসিসের আর একটি বড় সুবিধা ছিল টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস উপত্যকায় তাদের অবস্থান। ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চলে তাদের অবস্থানের কারণে তারা উত্তর-পশ্চিম ইরাক ও সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলের ওপর দখল রাখতে পেরেছে। তাই এই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মসুল ও তিকরিত দখল করে নিয়েছিল বাগদাদকে বাদ দিয়ে। সময়টা ছিল ২০১৪ জুন থেকে আগস্ট, তারা ইরাকের কুর্দিস্তানে প্রবেশ করে এবং সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার কুর্দিশ ছিটমহল কোবানিতে প্রবেশ করে।
ইরাকে দুর্নীতি ছিল চরম। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ পাওয়া যেত না। এমনকি বিচারক রায় দিয়ে দিলেও ঘুষ ছাড়া জেল থেকে বের হওয়া যায় না। আবার যে কেউ যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারে, কারণ, হয়তো সেই কর্মকর্তা ১০ থেকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে তাঁর কাজ পেয়েছিলেন। লেখক ইরাকের দুর্নীতির বর্ণনা প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায়ে দিয়েছেন। পঞ্চম অধ্যায়ে অনেক বিশদভাবে খুবই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রভাবে বর্ণণা করেছেন, যা খুব বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয় না বইটির মূল বিষয়বস্তু সাপেক্ষে।
সামরিক বাহিনীতে দুর্নীতি ছিল সকল স্তরে। একজন আর্মি জেনারেল দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বিভাগীয় কমিশনার হয়ে যেতে পারেন। ককবার্ন তাঁর এক ব্যবসায়ী বন্ধুর কথা উল্লেখ করেন, যিনি তাঁর ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন, কারণ, পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে বিক্রয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে এত বেশি ঘুষ দিতে হয় যে পণ্যের বিক্রয়মূল্য অনেক বেড়ে যায় এবং তাতে লোকসানের মুখ দেখতে হয় (৬৫)। তথাপিও লেখক বলেছেন অর্থনীতি দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। লেখকের মতে, The frequent demand for bribes has not in itself crippled the sate or the economy. The highly autonomous Kurdistan Regional Government is deemed extremely corrupt, but its economy is booming and its economic management is praised as a model for the country.
তবে তিনি এই প্রশংসিত অর্থনৈতিক মডেলের কেবল উল্লেখ করেছেন, কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব
ইরাকে শিয়াশাসিত সরকার কর্তৃক সুন্নিগোষ্ঠীর প্রান্তিকীকরণ ইরাকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধির মূল কারণ। দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শাসন করার জন্য মালিকিকে ক্ষমতায় বসালেও তাঁর শাসন সাদ্দামের শাসনের মতোই সাম্প্রদায়িক, দুর্নীতিগ্রস্ত, অকার্যকর ও পাশবিক। ককবার্ন আইএসের আদর্শগত দিকটিতে ও তাদের বর্বরোচিত শাসনের ওপর কোনো আলোকপাত করেননি, তবে তিনি আইএসের উত্থানের পেছনে প্রতিহিংসাপরায়ণ শিয়া শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র সুন্নি বিরোধিতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন।
ইরাকি সামরিক বাহিনী যখন সমূলে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তখন শেষ দিনে ইরাকি জনগণ ব্যারাকের ভেতরে প্রবেশ করে সৈন্যদের ওপর পাথর মারতে থাকে। ইরাকি সৈন্যকে ইরাকি সুন্নি জনগণ ইরানপুষ্ট মালিকির ছেলে মনে করে তাদের জারজ বলে গাল দেয়। মসুলে ইরাকি সামরিক বাহিনী বিদেশি শক্তি হিসেবে গণ্য হওয়ায় জনরোষের শিকার হয়। ইরাকি বাহিনী জনগণের ভয়ে তাদের অস্ত্র ও ইউনিফর্ম খুলে রেখে পালিয়ে যায় মসুল থেকে।
ককবার্ন এক সৈন্যের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, I saw women and children with military weapons; local people offered the soldiers dishdashes to replace their uniforms so that they could flee. (১৬)। মহিলা ও বাচ্চারাও অস্ত্র হাতে তাদের ধাওয়া করে। কিছু মানুষ তাদের সাহায্য করে, যাতে তারা পোশাক পরিবর্তন করে পালিয়ে যেতে পারে। তিকরিত ও বাইজিতেও একই অবস্থার সম্মুখীন হয় তারা। তিকরিতে যেসব সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, তাদের শিয়া ও সুন্নি দুই ভাগে ভাগ করা হয়। শিয়া সৈন্যদের ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয় এবং এই দৃশ্য ধারণ করে অন্য সৈন্যদের ভয় দেখানো হয় (১৭)। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধ আরও গাঢ় হয় যখন শিয়া মাজারগুলো বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয় (১০৩)।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে সুন্নি বাণিজ্যমন্ত্রীর দেহরক্ষী রাফি-আল-ইসাওয়ায়িকে সরকার গ্রেপ্তার করে। তবে উত্তর ও মধ্য ইরাকে সুন্নি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হয়। ইরাকে ৩৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ সুন্নি। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, সুন্নি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। ককবার্ন উল্লেখ করেন, মালিকি সরকার কিছু পরিবর্তনের কথা বলে থাকলেও তার সম্পূর্ণটাই ছিল লোকদেখানো। তাই প্রথমে আন্দোলনকারীর সংখ্যা ১০ হাজার হলেও ধীরে ধীরে তা কমে ১ হাজারে আসে। আন্দোলনকারীর সংখ্যা বেশি দেখানোর জন্য একটি বাদে স্থানীয় সব মসজিদ শুক্রবারের নামাজের জন্য বন্ধ রাখা হতো। যাতে সব মুসল্লি এক জায়গায় জড়ো হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে এই আন্দোলন কীভাবে সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয় বা আদৌ হয় নাকি বা এর সঙ্গে আইএসআইএসের উত্থানের সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা না থাকা ককবার্নের এই বইটির একটি দুর্বলতা। কারণ, তিনি শিয়া-সুন্নি বিভেদকে আইসিসের উত্থানের পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ডিসেম্বর ২০১২ সালে যে সুন্নি আন্দোলন শুরু হয়, শুরুতে তা ছিল শান্তিপূর্ণ। ২০১৩ সালের এপ্রিলে হাউইজার শান্তি ক্যাম্পে মালিকির নেতৃত্বে যে নৃশংস আক্রমণ চলে, তাতে ৫০ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু ঘটে এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস বিদ্রোহের রূপ নেয়। মালিকির বিরুদ্ধে যে জনরোষ ওঠে, তা আইসিসের পক্ষে সুবিধা বয়ে আনে। আঞ্চলিক আরও ৭-৮টা বিদ্রোহী দল আইসিসকে সমর্থন করে (৪৭)। যদিও লেখক মালিকিকে সম্পূর্ণরূপে দোষারোপ করেন না ইরাকে আইসিসের উত্থানের জন্য, তবে তিনি মনে করেন, এই সমস্যা বর্ধিতকরণে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। মালিকি হয়তো আইসিসের উত্থানের কিছু অবশ্যম্ভাবী সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করেছেন। আর তাই আইসিস বাগদাদ থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহর ফালুজা দখলের পর আলবার দখল করতে সক্ষম হয় (৪৮-৪৯)।
শিয়া-সুন্নি বিভেদ নিয়ে প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন। বর্ণনাগুলো কখনো মাইক্রো বা কখনো ম্যাক্রো স্তরে করা। তিকরিত ও ফালুজা দখলে জঙ্গি তত্পরতার সূক্ষ্ম বিবরণ তিনি দিয়েছে, যা খুবই মাইক্রো পর্যায়ের। তিনি কোনো মতবাদের আলোকে আলোচনা করেননি, যার ফলে বইটি কখনো কখনো অসংগতিপূর্ণ মনে হয়। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ইরাকে অনেক কিছু দেখেছেন, যার ফলে কোনো কোনো বিষয়ের একটু বেশি গভীরে পৌঁছে গেছেন, যা কখনো কখনো তাঁর যুক্তি তুলে ধরার খাতিরে আদিখ্যেতা মনে হয়েছে।
বিভিন্ন বহিঃশক্তির অবস্থান
ককবার্ন মনে করেন আমেরিকা, ইউরোপ ও তাদের আঞ্চলিক মিত্র তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আইসিসের উত্থানের মূল কারণ। ২০১২ সাল থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে আসাদ ক্ষমতা ছাড়বেন না। সিরিয়ার ১৫টা প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে ১৪টাই ছিল আসাদের নিয়ন্ত্রণে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে সাহায্য করে আসছে রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহ। তারপরও জেনেভার শান্তি আলোচনায় তাঁকে মাত্র একটি শর্তই আরোপ করা হয়, তা হলো ক্ষমতা থেকে অপসারণ। আর যেহেতু আসাদ ক্ষমতা ছাড়বেন না, তাই এমতাবস্থায় আদর্শ অবস্থা হলো আইসিসের বিস্তার। আমেরিকা ও মিত্রশক্তিরা ইরাক ও সিরিয়ার সুন্নি জনগণকে আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। ইরাক ও সিরিয়ায় আল-কায়েদা ধরনের দলগুলোর সহিংসতাই কেবল শঙ্কার শেষ নয়। অসহিষ্ণু ও সনাতনি ওয়াহাবি আদর্শের প্রচার যেভাবে শুরু হয়েছে, তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ১৬ বিলিয়ন মুসলমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যা পৃথিবীর জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। তাতে যে অমুসলমানরা এই ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধের লেলিহান শিখা থেকে মুক্তি পাবে, তা নয়। বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া জিহাদি আদর্শ, যা বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করছে, তার প্রভাববলয় থেকে মুসলিম-অমুসলিম কেউই রক্ষা পাবে না।
ককবার্ন মনে করেন, ৯-১১ জঙ্গি হামলা-পরবর্তী মার্কিন নীতি আল-কায়েদার ভবিষ্যত্ নির্ধারণ করে। টুইন টাওয়ার ঘটনার সব আলামত সৌদি আরবের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে। ওসামা বিন লাদেন সৌদি বনেদি পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা ছিলেন সৌদি বাদশাহর কাছের মানুষ। আল-কায়েদার অর্থ আসত আরব উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে। হামলাকারী ১৭ জনের ১৪ জনই ছিল সৌদি (৫৬)। মার্কিন নথিপত্রেও বারবার উঠে এসেছে যে আল-কায়েদা ও অন্য জিহাদি দলগুলোকে সৌদি আরব ও আরব রাজতন্ত্রগুলো আর্থিকভাবে মদদ দিয়ে আসছে। ১৯৯০-এর প্রথমার্ধ থেকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায় আনতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এমনকি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানবিষয়ক মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি রিচার্ড হলব্রুক বলেছেন, ‘আমরা হয়তো ভুল দেশে ভুল শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।’
সৌদি আরব ও অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশের দাবি, সিরিয়া থেকে আসাদ সরকারের অপসারণের ফলে আইএসের উত্থান। ককবার্ন এ-ও বলেন যে মার্কিন ৯-১১-পরবর্তী নীতি দ্বিধাপূর্ণ। যতক্ষণ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব ও পাকিস্তানকে ইসলামি উগ্রবাদ প্রচারের জন্য দায়ী না করবে, ততক্ষণ জিহাদবিরোধী আন্দোলন সামান্যই সফল হবে। ককবার্ন বলেন, The movement against which they are aimed have not been defeated but rather have grown stronger (৫৯)। আমেরিকা ও ব্রিটেনের যৌথ প্রচেষ্টায় গোয়েন্দা-ব্যবস্থার ব্যাপক বিস্তার ও ৯-১১-পরবর্তী বিপুল অর্থের বিনিময়েও আল-কায়েদা ও তাদের সমর্থিত দলগুলোর বিস্তার কমানো সম্ভব হয়নি। বরং তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
২০০১-পরবর্তী ‘War on terror’-এর কারণে বিশ্বরাজনীতির যে পটপরিবর্তন হয়ে আসছে তার ভয়াবহতা ২০১৪-তে মসুল দখলের আগ পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি (৫৯)। ককবার্ন ইরাকে শিয়া-সুন্নি বিরোধ ও মালিকি সরকারের দুর্নীতিকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখলেও গার্ডিয়ান পত্রিকার আলোচনায় ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনকে ‘অবৈধ’ বলা হয় ও এই আগ্রাসনকে আল-কায়েদা বিস্তারের মূল কারণ বলে উল্লেখ করেন। ইরাকের বঞ্চিত সুন্নিরা প্রথমে আইসিসে যোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে আইসিস রোধ করতে এর নেতাদের মার্কিনরা কেনার চেষ্টা চালায়।
২৮ মে ২০১৪ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, আমেরিকার আসল শত্রু এখন আর সংঘবদ্ধ আল-কায়েদা নয়, বরং অসংঘবদ্ধ আল-কায়েদা এবং তাদের জোটবদ্ধ দলগুলো। যেহেতু সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই এই যুদ্ধরত জঙ্গিদের আমেরিকার ওপর আক্রমণের সম্ভাবনাও বেড়েছে। এর প্রতিকার হিসেবে ওবামা প্রশাসন আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সরকারবিরোধী সর্বাপেক্ষা উত্তম বিকল্পকে সমর্থন করার নীতি বেছে নিয়েছে। তাই ওবামা আসাদবিরোধীদের আধুনিক সমরশাস্ত্র ও অস্ত্রে প্রশিক্ষিত করে তুলতে ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে কংগ্রেসের কাছে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যাশা করেন। এই ঘোষণার ছয় মাসের মাথায় তাঁরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি স্বীকার করেন যে আসাদবিরোধী শক্তিরা আসলে আইসিস ও আল-নুসরা দ্বারা পরিচালিত। তবে আল-কায়েদা ও তাদের প্রতিনিধিদলগুলোর সঙ্গে মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্ত বিরোধী মিত্রদের বাস্তব অর্থে কোনো পার্থক্য নেই। ককবার্ন সিরিয়ার এক প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশের (নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি) এক গোয়েন্দার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, যখন আসাদবিরোধী দলগুলোকে অত্যাধুনিক অস্ত্র পাঠানো হয়, তখন আইসিস খুবই খুশি থাকে। কারণ, তারা ভয় দেখিয়ে বা অর্থের বিনিময়ে সব সময়ই তাদের থেকে সেসব অস্ত্র নিয়ে নেয় (৩)। লেখক বলেন, ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে আইসিসের মসুল দখলের আগে, ইউরোপীয় বিমান তাদের বাগদাদযাত্রা বন্ধ করে দেয়। কারণ, তাদের ভয় ছিল সে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে বিমানবিধ্বংসী মিসাইল আছে, যা আসাদবিরোধীদের দেওয়া হয়েছিল।
ককবার্ন ৯-১১-পরবর্তী মার্কিন নীতিকে অসত্ বা অযৌক্তিক বলে মনে করেন। কারণ, সিরিয়া ও ইরাকে বিদেশি জিহাদিদের ওবামা সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করেন, যাদের এই অঞ্চলে প্রবেশ করার একমাত্র পথ তুরস্ক-সিরিয়ার ৫১০ মাইল লম্বা সীমান্ত পথ। সৌদি আরব, তুরস্ক ও জর্ডান হয়তো এখন তাদের তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভয়ে নিজেরাই কাতর, তবে এই দানব নির্মূলে তারা সামান্যই অবদান রাখতে পারছে (৭)। তাই ধারণা করা যেতে পারে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে তাদের সিরিয়ায় বিমান হামলা বা যুদ্ধে লিপ্ত করার কারণ এই দেশগুলোর সিরিয়ায় জিহাদিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা।
ককবার্ন মনে করেন, সৌদি আরবের ভূমিকা আইসিসের উত্থানের পেছনে অনেকটা ভুল বা কম গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। শুধু তেল বা অর্থপ্রাচুর্যের কারণেই এই রাজতন্ত্র প্রভাবশালী নয়, বরং তারা তাদের সনাতনী বা রক্ষণশীল ইসলামি আদর্শ, যা মেয়েদের অধিকার খর্ব ও শিয়া ও সুফি মুসলমানদের অমুসলিম হিসেবে দেখে এবং মনে করে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সঙ্গে তাদের হত্যা করা উচিত। আইসিস ও আল-কায়েদা আদর্শগতভাবে ওয়াহাবি মতবাদের সঙ্গে অনেক সহমত পোষণ করে। তাদের সমালোচনাকারীদের দেশত্যাগ করতে হয়, নতুবা হত্যা করা হয়।
মুসলিম দেশগুলোতে সৌদি আরব ওয়াহাবি আদর্শের প্রবর্তন করার জন্য দেশে দেশে মসজিদ বানিয়ে ও ইসলাম প্রচারকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে। ককবার্নের মতে, তাতে সাম্প্রদায়িক বিরোধ শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বেড়েই চলছে। যার ফলে তিউনিসিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে অদ্ভুত এক হিংস্রতা (৬)। তথাপি জর্জ বুশ কখনোই সৌদি আরবকে ৯-১১ ঘটনা বা সন্ত্রাসবাদে মদদ দানকারী হিসেবে দেখেনি। এমনকি ৯-১১ কমিশন রিপোর্টে ২৮ পৃষ্ঠাজুড়ে হামলাকারীদের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে বর্ণনা আছে, যা মূল রিপোর্ট থেকে কেটে ফেলা হয়েছে এবং কখনো তা প্রকাশ করা হয়নি (৫৭)। ২০০৯ সালে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল, যা উইকিলিকস প্রকাশ করে, সেখানে বলা আছে, সুন্নি জঙ্গি দলগুলোর মূল অর্থদানকারী হলো সৌদি আরব (৫৭)। তারপরও পশ্চিমা সরকারগুলো সৌদি ধর্মপ্রচারকদের শিয়াবিরোধী হিংসাত্মক ধর্ম প্রচারে বাধা দেয়নি। যুদ্ধশিশু আইসিস বা বর্তমান জঙ্গিবাদের এক অভিভাবক সৌদি আরব হলে অপরজন পাকিস্তান। তালেবান বা জিহাদিদের মদদদানে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ বারবার এলেও পশ্চিমা সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা নিতে বিরত থেকেছে।
সিরিয়া ও ইরাকে যে সশস্ত্র সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে, তা সালাফি জিহাদি ও প্রথাগত ধর্মীয় অনুশাসনের পবিত্র যুদ্ধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পশ্চিমা সরকারগুলো সিরিয়া, ইরাক বা বিশ্বজুড়ে শিয়া হত্যা নিয়ে চিন্তিত না-ও হতে পারে, তবে আল-কায়েদার আদর্শে উদ্বুদ্ধ সুন্নি আন্দোলন, যা ৯-১১-পূর্ববর্তী আল-কায়েদার সীমানা ছাড়িয়ে অনেক বড় পরিসরে বিস্তৃত হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায় আছে।
সিরিয়া যুদ্ধে সৌদি সম্পৃক্ততা শুধু আসাদ সরকারকে সরাতে অর্থ ও অস্ত্রাদি দিয়ে সাহায্য করার মধ্যেই সীমিত নয়। তারা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে শুরু থেকে সশস্ত্র বিরোধের কথা বলে আসছে, তা কোনো সরকার কর্তৃক হোক কিংবা দল কর্তৃক। ওয়াহাবি আদর্শ, সৌদি শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়। তাদের আদর্শ ও আল-কায়েদার আদর্শ সম্পূর্ণ অভিন্ন না হলেও খুব বেশি অমিল নেই (৭৭)। ওয়াহাবি আদর্শ সম্পূর্ণরূপে অন্যান্য ইসলামি আদর্শ বা চেতনাসহ যেকোনো ধর্মকে অস্বীকার করে। এই ওয়াহাবি প্রচারণা শিয়া-সুন্নি বিভেদকে অনেক গাঢ় করে তুলেছে। Directorate General for External Policies of the European Parliament ২০১৩ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়, সালাফি বা ওয়াহাবি আদর্শে উদ্বুদ্ধ বিদ্রোহী দলগুলোকে অস্ত্র প্রদান করা হয়। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব সেই ১৯৮০ সাল থেকেই এই দলগুলোকে অর্থ দান করে যাচ্ছে। তারা ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৬ বিলিয়ন পাউন্ড সমপরিমাণ অর্থ খরচ করেছে ওয়াহাবি অ্যাজেন্ডা প্রচার করতে। যার ফলে জিহাদি যোদ্ধা তৈরি হয়েছে।
১৯৮০ সালে এক জোট গঠিত হয় সৌদি আরব, পাকিস্তান ও আমেরিকার, যা এখনো অবধি অক্ষত রয়েছে। এই জোটের মধ্য দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার আধিপত্য বিস্তার হয়, যার মধ্যে পরবর্তী আল-কায়েদার বীজ নিহিত থাকে। পঞ্চম অধ্যায়ে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মালিকির ফ্রান্স ২৪-কে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারের কথা উল্লেখ করেন ককবার্ন। মালিকি স্পষ্টভাবে সৌদি আরব ও কাতারকে দোষারোপ করেন ইরাকে সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা বিস্তারের জন্য। তিনি আরও বলেন, রিয়াদ ও দোহা সরাসরি এই জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে, এমনকি তাদের জন্য যুদ্ধাস্ত্রও কিনছে। তিনি বইয়ের অনেক অংশে সৌদি আরব ও পাকিস্তানকে জঙ্গিবাদ উত্থানে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে মদদ দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো তথ্যসূত্র ব্যবহার করেননি।
ককবার্ন মনে করেন, ‘War on terror’ সফল হয়নি, কারণ মার্কিনদের জঙ্গি নির্মূল পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না, তারা এই সমস্যার দুই মূল ইন্ধনদাতা সৌদি আরব ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমেরিকা তাদের এই পুরোনো ও গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের কোনোভাবেই খেপাতে চায়নি। সৌদি আরব আমেরিকার একটি বড় অস্ত্রবাজার। এ ছাড়া সৌদি বাদশাহরা তাদের অর্থ দিয়ে আমেরিকান রাজনীতিকদের ক্রয় করে রেখেছেন। ১৮০ মিলিয়ন জনসংখ্যা পারমাণবিক ক্ষমতাধর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পেন্টাগনের সঙ্গে ভালো সখ্য আছে (৫৮)।
তবে বর্তমানে জঙ্গিবাদে মদদদানকারী এই রাষ্ট্রগুলোর কার্যকলাপে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। [তুরস্কের সহায়তায় সিরিয়া সীমানার কোবানি থেকে আইএস অপসারণের মধ্য দিয়ে।] সৌদি আরবও তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সপ্তম অধ্যায়ে ককবার্ন উল্লেখ করেছেন যে সৌদিদের এভাবে প্রকাশ্যে সিরিয়ায় জিহাদিদের সহায়তা করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। তার কারণ, তারা ১৯৮০ সালে আফগানিস্তান থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে ভীত, যেভাবে যুদ্ধপরবর্তী তালেবান, আল-কায়েদা ও জিহাদিদের জন্ম হয়। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান জেমস ক্লেপার বলেন, সিরিয়াতে বিদেশি যোদ্ধাদের মধ্যে সাত হাজার মানুষ আরব দেশগুলো থেকে এসেছে। সৌদিরা জঙ্গিবাদে সহায়তা করলেও, তারা তাদের ভূখণ্ডে জিহাদিদের উত্থানকে ভীত চোখে দেখে। তাদেরও ভয় আছে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে জিহাদিরা যখন নিজ দেশে ফিরে আসবে, তখন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধাস্ত্র, অর্থ, মেধা ও শ্রম ব্যবহার করবে। তাই বাদশাহ আবদুল্লাহ সৌদিদের বিদেশি ভূখণ্ডে যুদ্ধ করা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করেন ও গোয়েন্দাপ্রধান বাদশাহ বন্দরকে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। সেন্টার ফর একাডেমিক শিয়া স্টাডিজের ইউসুফ আল খোই মনে করেন, এই ফতোয়া যথেষ্ট নয়। সৌদি শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে সুফি, শিয়া, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের পিশাচ বলে শেখানো হয়, তার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। আরব দেশের মধ্যেও সিরিয়া নীতি নিয়ে বিরোধ শুরু হতে থাকে। সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার থেকে তাদের দূত সরিয়ে নেয়, কারণ, কাতার মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে ও সিরিয়ায় জিহাদি দলগুলোকে আর্থিক সাহায্য দেয় (১০৬)। ককবার্ন উল্লেখ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সিরিয়ায় জিহাদিদের অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য। আবার সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান বাদশাহ বন্দর-বিন সুলতান, যিনি ওয়াশিংটনে সৌদি দূত ছিলেন ও আসাদ সরকারবিরোধী প্রচারণার মূল হোতা, সিরিয়াতে সেনা অভ্যুত্থান না করার জন্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তিরস্কার করেন। নাইফ আল আজমি, যিনি একাধারে দুটি মন্ত্রণালয়—বিচার ও ইসলামি সম্পর্কের মন্ত্রী, মার্কিন চাপের মুখে পদত্যাগ করেন। কারণ, আজমি সিরিয়ায় জিহাদি অর্থায়নে বহুল পরিচিত নাম। এমনকি আল-নুসরা ফ্রন্টের অর্থায়ন পোস্টারে তাঁর ছবিও দেখা গিয়েছিল।
সম্ভবত সৌদি আরবের এই বিস্তৃত জঙ্গিবাদের প্রভাব বুঝতে অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়েছে। ককবার্ন এক জিহাদি টুইটারের কথা উল্লেখ করেন (লেখক নাম উল্লেখ করেননি), যেখানে একটি ছবিতে লেখা আছে, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা আরব অঞ্চলে প্রবেশ করব। যেভাবে আমরা আজ লেভান্তে, কাল আমরা আল-কুরায়াত ও আরার-এ (সৌদি আরবে দুই শহর) প্রবেশ করব’ (১০৭)।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকা
ইরাক ও সিরিয়ায় জিহাদিরা যে ভেতরে ভেতরে এত শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, তা গণমাধ্যম ও রাজনীতিকেরা উপেক্ষা করে চলছিলেন। তবে একটি বড় কারণ হলো পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা কেবল আল-কায়েদা ও ‘কোর’ বড় জিহাদি শক্তি বলে মনে করত। তাদের সবার দৃষ্টি সব সময়ই ছিল আল-কায়েদার ওপর । আর এভাবে তারাও গর্বসহকারে তাদের War on terror-এর সাফল্য নিয়ে খুশি ছিল। পশ্চিমাদের ধারণা ছিল, আল-কায়েদার সমর্থন ও জোট ছাড়া কোনো জিহাদি শক্তি বড় কোনো হুমকি হতে পারবে না। তাই আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি আইএসআইএসের নৃশংসতাকে সমালোচনা করাতে তারা মনে করে, আইসিসের আল-কায়েদার সমর্থন নেই।
আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আমেরিকানরা সৌদি আরবের সঙ্গে একটি ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্ট’ তৈরি করে, যার অবস্থান হবে জর্ডানে। এই ফ্রন্ট দামাসকাসে আসাদের বিরুদ্ধে উত্তর ও পূর্বে আল-কায়েদা ধরনের দলগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করবে। ‘ইয়ারমুক ব্রিগেড’, যারা সৌদি আরব থেকে বিমানবিধ্বংসী মিসাইল পায়, এই ফ্রন্টের নেতৃত্ব দেয়। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায় যে আল-নুসরা, আল-কায়েদার সহযোগী দল, এই ব্রিগেডের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এই দুই দল তাদের যুদ্ধাস্ত্র ভাগাভাগি করে, অর্থাত্ ওয়াশিংটন আসলে তাদের শত্রুদেরই যুদ্ধাস্ত্র প্রদান করছে। ইরাকি সরকারও নিশ্চিত করেছে যে তারা আইসিস থেকে যে যুদ্ধাস্ত্র জব্দ করেছে, সেগুলো বিদেশি শক্তি হতে প্রেরিত, যা সিরিয়ায় আল-কায়েদাবিরোধী শক্তির কাছে পাঠানো হয়েছিল। তবে এই সংবাদগুলো পশ্চিমা গণমাধ্যমে খুব বেশি দেখা যায় না। পশ্চিমাদের যেকোনো শত্রুকে আল-কায়েদা নামকরণ করে সব বিরোধী শক্তিগুলোকে এক কাতারে ফেলে একই পদ্ধতিতে তা মোকাবিলা করার প্রবণতা আছে, যা সব গণমাধ্যম যেন কায়মনোবাক্যে মেনে নিয়েছে। সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যখন ইরাকে হামলা চালানো হয়, তখনো বলা হয়, সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে ৯-১১ পরিকল্পনাকারীদের সম্পর্কের কথা। যদিও বাস্তবে এই বক্তব্যের কোনো সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। সাদ্দাম হোসেনকে নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য ফাঁসি দেওয়া হলেও, ইরাক আক্রমণ যে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল ও এই ভুলের জন্য যে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল, বাস্তুহারা হলো, তার জন্য কাউকে দোষী করা হলো না, কেউ শাস্তি পেল না। কেবল সুবিধামতো অনেক বছর পর যখন আর কোনোভাবেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন কেবল স্বীকার করে নিল, ইরাক আক্রমণ ভুল সিদ্ধান্ত ছিল! এই পুরো বিষয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম, যা মধ্যপ্রাচ্য সংবাদের মূল ও অনেকটা একমাত্র সূত্র কিছুই বলল না। এমনকি ককবার্নের মতো বিচক্ষণ সাংবাদিক, যিনি তাঁর লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন মার্কিন ভুল নীতির কথা, তিনি একবারও এই ভুলের কৈফিয়ত চাননি বা কাউকে দায়ী করেননি। পশ্চিমারা নিজেদের ভুল লুকোতে আল-কায়েদাকে শক্তিশালী শত্রু হিসেবে বারবার তুলে ধরেছে এবং ককবার্নসহ বেশির ভাগ সাংবাদিক সেই প্রচারণারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
ককবার্ন তাঁর লেখায় অনুসন্ধিত্সু সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা ও পর্যবেক্ষণের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি এই যুদ্ধ ও আইসিসের পেছনে অধ্যবসায়, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। অনেক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, তিনি আইসিসের উত্থান ও বিস্তার সম্পর্কে সবার আগেই তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর বিশ্লেষণ প্রায় সব সময়ই নির্ভুল হয়। তিনি তাঁর লেখায় অনেক জায়গায় পশ্চিমা শক্তির নীতিকে দায়ী করেছেন আইসিসের উত্থানের পেছনে, যা তাঁর লেখাকে অনেকটা পক্ষপাতিত্বহীন করে তুলেছে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে তিনি খুবই সাবধানতার সঙ্গে এড়িয়ে গিয়েছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্মমভাবে উপেক্ষা করেছেন। ককবার্ন তাঁর বইতে আইসিসের উত্থান নিয়ে অনেক ক্ষুদ্র বিষয়ের বিস্তর বিবরণ দিয়েছেন, যা হয়তো আসল কারণ থেকে পাঠকের দৃষ্টি সরিয়ে আনার প্রয়াস। তিনি আইসিসের বিবরণে ইরাকের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন অথচ তিনি আবু ঘারিবের কথা উল্লেখ করেননি।
আইসিস তাদের অস্তিত্ব ও নৃশংসতার জানান দিতে এক ভিডিও বার্তা ছাড়ে, যাতে দেখা যায়, তারা ২১ জন মিসরীয় খ্রিষ্টানের শিরশ্ছেদ করা হচ্ছে। প্রত্যেকে কমলা রঙের জাম্পস্যুট পরিহিত, পেছনে কয়েদিদের মতো হাত বাঁধা। এমনই কমলা রঙের জাম্পস্যুট পরিহিত, হাত বাঁধা কয়েদিদের ওপর আমেরিকানদের নির্মম অত্যাচারের ছবি দেখা গিয়েছে ২০০৪ সালে। এই আবু ঘারিবের অত্যাচারিত বন্দীদের কথা ভুলে গেলে বা উপেক্ষা করলে আইসিসের উদ্দেশ্য ও নৃশংসতা সম্পর্কে বোঝা যাবে না। আইসিসের জিহাদি বা জঙ্গি বা যোদ্ধা তাদের যা-ই বলা হোক না কেন, তারা প্রতিশোধ নিতে ব্রত। আইসিসের অনেকেই আবু ঘারিব বা ক্যাম্প বুকা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত। বরং বলা যায়, ক্যাম্প বুকায় আমেরিকার চোখের সামনে মানুষ আইসিসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। একই জায়গায় চরমপন্থী ও সাধারণ বন্দীদের রাখা হয়েছিল। এই ক্যাম্পেই বাগদাদি ছিল, যিনি ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর ক্যাম্পের সহযোগীদের তাঁর দলে ভেড়ান।৩ আইসিসের উত্থান নিয়ে তিনি কেবল ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধ উল্লেখ করেছেন। তুরস্ক, জর্ডান ও মার্কিন নীতি বা সাহায্য দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা মুসলিম নিপীড়ন আইএসের উত্থানকে কীভাবে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে, তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
ইরাকের দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন অথচ মালিকি ক্ষমতায় আসার পরও ২০১১ সাল পর্যন্ত মার্কিন বাহিনী ইরাকে অবস্থান করেছে এবং নতুন সরকারের শাসনব্যবস্থায় সম্পূর্ণ হস্তক্ষেপ করেছে, তারপরও এত দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও আইসিসের উত্থান, তার দায়ভার কেবল ইরাকের ওপরই। আইসিসকে সাহায্যের পেছনে সৌদি আরবের অবদানের কথা একভাবে বলা হলেও, তাদের বিরুদ্ধে কেন আমেরিকা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, সেই ব্যাপারে বইটিতে মার্কিন নীতির আলোচনা নেই।
আইএসআইএসের উত্থান সম্পর্কে তাঁর বিশদ বিবরণ প্রশংসনীয়। কীভাবে আইএসআইএস একের পর এক অঞ্চল দখল করে সিরিয়া পর্যন্ত গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তর এলাকা দখল করে নিয়েছে, তা ককবার্নের অনুসন্ধানমূলক এই বই পড়লে স্পষ্ট হবে। তবে এখানে তিনি একটি বড় অংশ একেবারেই বাদ দিয়ে গিয়েছেন। তা হলো আইসিসের আদর্শ। তবে আইসিসের উত্থান সম্পর্কে তাঁর বর্ণনায় কিছুটা মনে হতে পারে যে এটি একটি Home grown বা স্বদেশীয় ব্যাপার, যা আমেরিকার ভুল নীতির ফলে সৃষ্ট শূন্যস্থানের সুযোগে সৃষ্টি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মদদে বিস্তৃতি লাভ করেছে। আইসিস কেবল একটি দল নয়, আইসিস একটি আদর্শ। আফগানিস্তানের তালেবানদের থেকেও এর ভয়াবহতা বেশি। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থে, অভ্যন্তরীণ, আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক কারণে তাদের ব্যবহার করছে। তাদের একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি দল হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা থেকে থাকলেও, তারা কেবল এই পরিচয়ে সন্তুষ্ট নয়। কারণ, তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে তাদের দলে মানুষকে ভেড়াতে হবে, যা তারা তাদের মতাদর্শের প্রচারের মাধ্যমে করে। তাতে বিশ্বজুড়ে তাদের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ছে, যা শক্ত হাতে বন্ধ করার প্রয়োজন আরও অনেক আগেই ছিল। বইটিতে ককবার্ন সৌদি আরব, পাকিস্তান ও তুরস্ককে দায়ী করেছেন জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার জন্য এবং সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ক্ষমতা দখলের কারণ উল্লেখ করেছেন। তবে আমেরিকা কেন তার এই মিত্র রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, সেই সত্যের ওপর আলোকপাত নেই। বইটি যেখানে আইএসের উত্থান ও সুন্নি আন্দোলনের কথা বলেছেন, সেখানে ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে এই দল বা আদর্শের কোনো উল্লেখ না থাকা আইসিসের ক্ষমতার সরলীকরণ।
তথ্যসূত্র:
১. https://www.versobooks.com/books/1830-the-rise-of-islamic-state
২. ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দ্য ইকোনমিস্ট প্রতিবেদন, Rolling into town: How the rise of Islamic State is changing history of the middle East bvGg http://www.economist.com/news/books-and-arts/21644117- how-rise-islamic-state-changing-history-middle-east-rolling-town
৩. https://www.theguardian.com/world/2014/dec/11/-sp-isis-the-inside-story
দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট: আইসিস অ্যান্ড দ্য নিউ সুন্নি রেভল্যুশন —
প্যাট্রিক ককবার্ন, ভার্সো, লন্ডন/নিউইয়র্ক ২০১৪/২০১৫, পৃষ্ঠা ১৯২
পটভূমি
দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট: আইসিস অ্যান্ড দ্য নিউ সুন্নি রেভল্যুশন বইটি প্যাট্রিক ককবার্নের অন্যান্য বইয়ের মতোই আলোচিত একটি বই। মধ্যপ্রাচ্যে আইসিসের উত্থানের কারণগুলো লেখক বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন বইটিতে। তিনি ৯-১১-পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভুল নীতিকে দায়ী করেছেন আইসিসের উত্থানের মূল কারণ হিসেবে। এর সঙ্গে গালফ রাষ্ট্রগুলোর আইসিসকে অর্থনৈতিক মদদদান ও ইরাক-সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও রাজনীতি কীভাবে আইসিসের উত্থানের জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল, লেখক তার বিবরণ দিয়েছেন বইটিতে।
১৯২ পৃষ্ঠার বইটিতে ৯টি অধ্যায় আছে। ২০ পৃষ্ঠার মুখবন্ধের পর প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে পুরো বইটির সারসংক্ষেপ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে মসুল দখলের মধ্য দিয়ে আইসিসের শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক উল্লেখ করেছেন আঞ্চলিক শক্তিগুলো কীভাবে তাদের নিজেদের স্বার্থে আইসিসকে মদদ দিয়ে তাদের নৃশংসতা উসকে দেয়। জিহাদিদের উত্থান, নেতৃত্ব ও অন্যান্য জিহাদি দলের সঙ্গে আইসিসের সম্পর্কের কথা চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন ককবার্ন। পঞ্চম অধ্যায়ে বলা হয়, কীভাবে জিহাদিরা ইরাকে একের পর এক শহর দখল করতে থাকে ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে ককবার্ন লিখেছেন, কীভাবে জিহাদিরা সিরিয়ার আন্দোলন নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে। সৌদি আরব আইসিসকে অনড় সমর্থন ও মদদ দিয়ে এসেছে ইরাক ও সিরিয়াতে শিয়া পৃষ্ঠপোষক সরকার দমনের জন্য। আইসিস শুধু একটি ত্রাস সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী নয়, বরং একটি আদর্শ, যা বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর নাগরিক দলে দলে আইসিসে যোগ দিচ্ছে। এই ‘নির্ভীক’ আইসিস জিহাদিরা যখন যুদ্ধ শেষে নিজ নিজ দেশে ফিরে আসবে, তখন তারা নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রতী হবে। এমতাবস্থায় আইসিসের মদদদাতা সৌদি আরব তাদের বিভিন্ন নীতিগত পরিবর্তন এনে এই দানব প্রতিহত করার চেষ্টা করছে, যার বর্ণনা সপ্তম অধ্যায়ে ককবার্ন দিয়েছেন। অষ্টম অধ্যায়ে আইসিস যুদ্ধে পক্ষপাতী ও দায়িত্বহীন পশ্চিমা গণমাধ্যমের নেতিবাচক আলোচনা করেছেন ককবার্ন। শেষ অধ্যায়ে লেখক আবারও আইসিসের উত্থানের সারসংক্ষেপ উল্লেখ করে আরব বসন্ত-পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সম্ভাব্য অবস্থান ও নীতিগত পরিবর্তনই নির্ধারণ করবে আইসিসের ভবিষ্যত্।
ফরেন পলিসি জার্নালের মতে, ককবার্নের বইটি আইসিস বিষয়ে জানার জন্য যথার্থ। বইটি এই দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িত বিভিন্ন অংশীদারের ভূমিকা পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে। মধ্যপ্রাচ্যে এই যুদ্ধ যতই অগ্রসর হচ্ছে, ততই যেন এর প্রকৃতি আরও ভয়াবহ হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক সাংবাদিক ও রাজনীতিবিষয়ক লেখক সাইমম হার্শের মতে ককবার্ন বর্তমানে ইরাকবিষয়ক সবচেয়ে ভালো সাংবাদিক। নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতে, বইটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বর্ণনার প্রাচুর্যে ভরা। দ্য অবজারভার-এর মতে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও সংকট সম্পর্কে লেখা বইগুলোর মধ্যে খুব কম বই বইটির মতো তথ্যসমৃদ্ধ।
ব্রিটিশ জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ডের বিচারকদের মতে, প্যাট্রিক ককবার্ন আইসিসের আবির্ভাব সম্পর্কে শুরু থেকেই সোচ্চার। আইসিস বিষয়ে এত গভীরতা, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন ও অন্তর্দৃষ্টিমূলক লেখা যখন তিনি লিখছিলেন, তখন আর কেউ এই আসন্ন হুমকির ভয়াবহতা সম্পর্কে সোচ্চার ছিলেন না। তাঁদের মতে, এমআই-৬ ব্রিটিশ ব্রিগেডকে বাদ দিয়ে প্যাট্রিক ককবার্নকে নিয়োগ দেওয়া উচিত। মার্কিন সাংবাদিক, সমাজকর্মী, লেখক ও প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সাবেক রাজনৈতিক সহযোগী, সিডনি স্টোন ব্লুমেন্থাল হিলারি ক্লিনটনকে লেখা এক ই-মেইলে প্যাট্রিক ককবার্নকে ইরাক বিষয়ে সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ সাংবাদিক বলে উল্লেখ করেছেন।১
ককবার্নের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রতিফলন ঘটেছে বইটিতে। আইসিস বিষয়ে যাদের জানার আগ্রহ আছে, তাদের জন্য বইটি চিন্তার খোরাক জোগায়। বইটিতে ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যে বিশদ আলোচনা আছে, তা এই বিষয়ে আগ্রহী পাঠক ও লেখকের জন্য নির্দেশক বই হিসেবে ব্যবহূত হতে পারে। তবে পুরো বইয়ে আইসিস উত্থানের কারণগুলো বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্নভাবে বর্ণনা করা আছে, যা কখনো পুনরাবৃত্তিমূলক ও কখনো প্রয়োজনাতিরিক্ত। লেখার ক্ষেত্রে বইটি কাঠামোহীন। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল ও ইরাকে আইসিসের উত্থান ও এই বিষয়ে তথ্য বিস্তারের আবশ্যকতা বিষয়ে পশ্চিমা রাজনীতিক ও গণমাধ্যম উদাসীন। সেই শূন্যস্থান পূরণের উদ্দেশ্যে ককবার্ন এই আলোচনামূলক বইটি লিখেছেন। বইটি মূলত তাঁর ইরাকে আইসিস বিষয়ে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। বইটিতে অন্য কোনো রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র ব্যবহার করা হয়নি। সে ক্ষেত্রে বইটির প্রকৃতি ভিন্ন হতে পারত, বইটি বর্ণনামূলক না হয়ে, তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা বিষয়ে সাক্ষাত্কারমূলক বা আত্মজীবনীমূলক বই হলে পাঠকের পড়ার ক্ষেত্রে হয়তো আর একটু স্বস্তিদায়ক হতো। বইটির স্বীকৃতি অংশে লেখক বলেছেন, বইটির বিভিন্ন অধ্যায় বিভিন্ন সময়ে, কখনো ২০১৪ সালে নিউইয়র্কের আর্ট ফাউন্ডেশনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় বা ইনডিপেনডেন্ট ও লন্ডন রিভিউ অব বুকস-এর জন্য প্রবন্ধ লেখার সময় লেখা হয়েছে। তাই হয়তো ধারণা করা যায়, বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ে লেখার মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব আছে। সে ক্ষেত্রে সম্পাদনার অপ্রতুলতা ধরা পড়ে বইটিতে। বইটির আর একটি বড় দুর্বলতা এখানে আইসিসের আদর্শ, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য বা চরিত্র নিয়ে কোনো আলোচনা করা হয়নি। বইটি ২০১৪ সালে আইসিসের মসুল দখলের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এবং বিভিন্ন সময়ে ২০০৪ থেকে ২০১৪ সালের বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করেছে। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধের উদ্দেশ্য ও কারণ বা যুদ্ধের প্রকৃতি বর্ণনা ছাড়াই যুদ্ধরত দলের উত্থানের কারণ সম্পর্কে বর্ণনা কিছুটা অসম্পূর্ণ বোধ হয়।
লেখক পরিচিতি
প্যাট্রিক ককবার্ন একজন আইরিশ নাগরিক, যিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও ১৯৯১ সাল থেকে ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাংবাদিক। ককবার্নের জন্ম ও বেড়ে ওঠা আয়ারল্যান্ডে। তাঁর বাবা-মা উভয়ই সুপরিচিত সমাজতান্ত্রিক লেখক ও সাংবাদিক ছিলেন। তিনি অক্সফোর্ডের ট্রিনিটি কলেজ থেকে লেখাপড়া করেছেন ও পরবর্তী সময়ে বেলফাস্টের কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব আইরিশ স্টাডিজে গবেষণা ছাত্র হিসেবে ছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি জেনেট এলিজাবেথকে বিয়ে করেন, যিনি কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন।
ককবার্ন ইরাকের বর্তমান ইতিহাসের ওপর তিনটি বই লিখেছেন।Out of the Ashes: The Resurrection of Saddam Hussein (1999), যা ২০০২ সালেSaddam Hussein: An American Obsession নামে ব্রিটেন থেকে পুনঃপ্রকাশিত হয়। তাঁর লেখাThe Occupation: War and Resistance in Iraq (2006) বইটি ২০০৬ সালে ন্যশনাল বুক ক্রিটিক সার্কেল পুরস্কার পায়। তাঁর লেখা অন্য বইগুলো হলো ২০০৮ সালেMuqtada: Muqtada al-Sadr, the Shia Revival I the Struggle for Iraq, ২০১৪ সালেThe Jihadis Return: Isis and the New Sunni Uprising, যা ৯টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, ২০১৫ সালেThe Rise of Islamic State: Isis and the New Sunni Revolution ও ২০১৬ সালেChaos and Caliphate: Jihadis and the West in the struggle for the Middle East। এ ছাড়া ২০০৫ সালে তিনি আত্মজীবনীমূলক লেখা লিখেছেন, The Broken Boy।
কাজের প্রশংসা ও সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অর্জন করেছেন বিভিন্ন পুরস্কার। ২০০৫ সালে মার্থা গেলহর্ন পুরস্কার, ২০০৬ সালে দ্য জেমস কেমেরন পুরস্কার, ২০০৯ সালে অরওয়েল পুরস্কার, ২০১৩ সালে এডিটরিয়াল ইন্টেলিজেন্স কমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে বর্ষসেরা বিদেশি বিবরণদাতা, ২০১৪ সালে ব্রিটিশ জার্নালিজম পুরস্কারে বর্ষসেরা আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা ও ২০১৪ সালে দ্য প্রেস অ্যাওয়ার্ডে বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন।
আইসিসের উত্থান
আইসিসের উত্থান জানতে হলে ফিরে যেতে হবে আশির দশকে, ১৯৭৯ সালে, যখন আফগান মুজাহিদিনদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও পাকিস্তানের আইএসআই সাহায্য করেছিল সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে। সাফল্যের সঙ্গে সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধজয় তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে এবং এই মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী সময়ে তালেবানে পরিণত হয়। এই যুদ্ধ থেকে দুজন নেতার আবির্ভাব হয়, যারা ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত অপসারণের পর সৌদি আরব পাড়ি জমায়। একজন ওসামা বিন লাদেন, অপরজন আবু মুসাব আল জারকাওয়ি। আদর্শগতভাবে দুজনের মধ্যে ছিল ভিন্নতা। লাদেন সেখানে আল-কায়েদার জন্ম দেন ও জারকাওয়ি আল-তাউহিদ ওআল জিহাদ নামে ভিন্ন আর একটি দল গঠন করেন। তারপর তাঁরা দুজনেই আবার আফগানিস্তান ফেরত যান, যার কিছুদিন পরই ৯-১১ হামলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করলে ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তান ও আবু মুসাব আল জারকাওয়ি ইরাকে পালিয়ে যান। ২০০৪ সালে ইরাকে মার্কিন হামলায় সাদ্দামের পতনের পর অনেক ক্ষুব্ধ ইরাকি সেনাসদস্য ও সুন্নি মুসলমান বিভিন্ন বিদ্রোহী দলগুলোতে যোগদান করেন। তখন জারকাওয়ির দল শক্তিশালী হয়ে ওঠে ও ইরাকে শিয়াদের বিরুদ্ধে ও মালিকি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। আল-কায়েদা তখন জারকাওয়ির দলের সঙ্গে জোট গঠন করে, তখন এর নাম হয় আল-কায়েদা ইন ইরাক (একিউআই)। ২০০৬ সালে মার্কিন হামলায় জারকাওয়ির মৃত্যু হয় ও আল-কায়েদা ইন ইরাক নেতৃত্বশূন্য হয়। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাক ত্যাগ করার ঘোষণা দেন। ডিসেম্বরে সাদ্দামের ফাঁসি হয়। ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন দিন দিন আমেরিকানদের তাদের সরকারের ওপর হতাশ করে তোলে। সরকারকে তারা চাপের মুখে ফেলে ইরাক যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। ইরাকে মার্কিন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অপ্রত্যাশিত ছিল। সাদ্দাম ও জারকাওয়ির মৃত্যু ইরাকের চলমান সহিংসতা কমাতে পারেনি। মার্কিনদের পক্ষে ইরাকের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব সমাধান করা যে অসম্ভব ও এই দ্বন্দ্ব দিনে দিনে যে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে, সেটাও তাদের জ্ঞাত ছিল। তাই মার্কিনদের জন্য ইরাক ত্যাগ ছিল আবশ্যক।
২০১১ সালে মার্কিন বাহিনী ইরাক ত্যাগ করে। একই বছর আরবজুড়ে নামে বসন্ত। তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া, মরক্কোসহ একের পর এক আরব রাষ্ট্রগুলোতে যখন অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন হচ্ছিল, তার প্রচেষ্টা সিরিয়াতেও হয়। তবে সিরিয়ার শাসক শক্ত হাতে তাঁর শাসনের ভবিষ্যত্ নির্ধারণ করেছেন। যার ফলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সিরিয়ার এই যুদ্ধই মূলত আইসিসের আসল জীবনীশক্তি। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সব বিশ্বশক্তি একে অন্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অনুশীলনে ব্যস্ত। আর এই সুযোগেরই ফসল আইসিস।
সৌদিদের প্রচণ্ড রকমের শিয়া বিস্তারভীতি রয়েছে, যদিও ৫৭টি মুসলমান দেশের মধ্যে মাত্র ৪টি দেশে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও অল্প কিছু দেশে সংখ্যালঘিষ্ঠতা আছে। যেকোনো মুসলমান দেশে রাষ্ট্রপ্রধান শিয়া হলে সৌদি আরবের ভীতি যেন আরও অনেক বেশি বেড়ে যায়। পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারিকে সৌদিদের ব্যাপক অপছন্দের কারণ তাদের ধারণা, তিনি শিয়া। সৌদি রাজা আবদুল্লাহ অনেকবার আমেরিকাকে বলেছেন ইরান আক্রমণের জন্য। একই কারণে ইরাকের মালিকি সরকার সৌদিদের অপ্রিয়। আরব-সিরিয়া সম্পর্ক সব সময়ই বিভিন্ন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রকাশ্যে আসাদবিরোধী দলগুলোকে সাহায্যের মধ্য দিয়ে এই সম্পর্ক ছিন্ন হয়। আরব বসন্ত যখন সিরিয়ায় হানা দেয় ২০১১ সালে, আসাদ তখন তাঁর হাজতে থাকা সব জিহাদিকে মুক্তি দিয়ে দেন। জারকাওয়ির মৃত্যুর পর আবু বকর আল-বাগদাদি তাঁর দলের নেতৃত্ব দেন ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক’ বা ‘আইএসআই’ নামে।
২০১২ সালে বাগদাদির এক সহযোগী সিরিয়াতে গিয়ে ‘জাভাত আল-নুসরা’ নামে নতুন দল গঠন করেন আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। ২০১৩ সালে বাগদাদি সব আল-কায়েদা ও জিহাদি দলের ওপর তাঁর নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ও সিরিয়া বা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক ও লেভান্টের’ ঘোষণা করেন। তখন ‘জাভাত আল-নুসরা’র সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে।
২০১৪ সালের গ্রীষ্মে মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট’ (আইএসআইএল বা আইএসআইএস বা আইসিস) মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পটভূমি ও মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। ১০ জুন ইরাক, মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্ব হঠাত্ করে জানতে পারে, মসুল ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আইএসআইএস (আইএসআইএল/আইসিস) নামে এক উগ্র ইসলামি দলের দখলে চলে গেছে। এর বেশ কিছু মাস পর খবর পাওয়া গেল যে ইসলামপন্থী ও সব আল-কায়েদা সম্বন্ধযুক্ত দল বাগদাদের নিকটস্থ শহর ফালুজা থেকে তুরস্ক-সিরিয়া সীমানা নিকটবর্তী শহর রাকা পর্যন্ত দখল করেছে। আইসিসের এই নব্য দখলকৃত অঞ্চলকে তারা ‘খিলাফত’ বলে দাবি করে। আইসিস যোদ্ধাদের ককবার্ন জিহাদি বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সামরিক নীতিতে দক্ষ এই জিহাদিরা ইরাক, সিরিয়া ও কুর্দিদের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিতভাবে জয়লাভ করে, ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তর অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ইরান-ইরাক সীমান্ত থেকে ইরাকি কুর্দিস্তান ও আলেপ্পোর বহিরাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। এই অঞ্চল ওসামা বিন লাদেনের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের থেকে আকারে কয়েক শ গুণ বড়, যাকে ককবার্ন ব্রিটেন বা মিশিগান অঙ্গরাজ্যের থেকেও আকারে বড় বলে চিহ্নিত করেছেন। সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর রাকা দখলের মধ্য দিয়ে মার্চ ২০১৩ সিরিয়া আইসিসের অধীন হতে শুরু করে। জানুয়ারি ২০১৪ সালে আইসিস ফালুজা দখল করে, যা বাগদাদ থেকে মাত্র ৪০ মাইল পশ্চিমে। কয়েক মাসের মধ্যেই তারা মসুল ও তিকরিত দখল করে।
সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ আইসিসের পুঁজি। আইসিসের উত্থান ও টিকে থাকার একটি বড় কারণ সিরিয়ার যুদ্ধ বলে মনে করেন ককবার্ন, যা তিনি বইটির চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। ককবার্ন শুরু করেছেন ২০১৪ সালে আইসিসের ধারণ করা একটি ভিডিওচিত্রের মধ্য দিয়ে। সেখানে বিদেশি জিহাদিরা সম্ভবত সিরিয়ার কোনো অঞ্চলে তাদের পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে জিহাদের প্রতি তাদের দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞা দেখায়। পাসপোর্টগুলোর রং দেখে বোঝা যায়, কিছু জিহাদি ছিল সৌদি, জর্ডানিসহ আরও অনেক জাতীয়তার। প্রত্যেকে যখন তাদের পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুনের শিখায় ছুড়ে মারছিল, তখন তারা নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হচ্ছিল। এক কানাডীয় ইংরেজি ও আরবি ভাষায় কানাডা ও সব মার্কিন মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা করে বলেন, ‘আমরা আসছি, আমরা তোমাদের ধ্বংস করে দেব।’ এক জর্ডানি বলেন, ‘আমরা আবু মুসাব আল-জারকাওয়ির উত্তরসূরি, আমরা তোমাদের মেরে ফেলব।’ সৌদি, মিসরীয় ও চেচেন প্রত্যেকেই একই প্রতিজ্ঞা করে। মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র দেখলে দেখা যাবে যে পুরো ইউফ্রেটাস উপত্যকা, পশ্চিম ইরাক থেকে নিয়ে পূর্ব সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্ত পর্যন্ত আইসিসের বা ‘জাভাত-আল নুসরা’ (জান), যাকে মার্কিন বাহিনী ‘কোর আল-কায়েদা ইন পাকিস্তান’ বা‘Core al-qaeda in Pakistan’ বলে আখ্যায়িত করে, তাদের দখলে।
আইএসআইএলে ২০১০ থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন আবু বকর আল-বাগদাদি, যিনি আবু দুআ নামেও পরিচিত। তাঁর আদর্শ মূল আল-কায়েদা থেকেও বেশি সাম্প্রদায়িক ও নৃশংস। আয়মান আল জাওয়াহিরির পাকিস্তানে তাঁর ঘাঁটি ছিল। আবু বকর আল-বাগদাদি আলোচনায় আসা শুরু করেন যখন তিনি ২০১০ সালে আল-কায়েদা ইরাকের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ববর্তী নেতা মার্কিন ও ইরাকি বাহিনীর হামলায় মৃত্যুবরণ করেন। আল-কায়েদা ইন ইরাকের সাংগঠনিক অবস্থা খারাপ হতে থাকলে তা বিলুপ্ত হতে থাকে। আল-বাগদাদির নেতৃত্ব গ্রহণ ২০১১-তে সিরিয়ায় সুন্নি আন্দোলনের অস্তিত্বের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
সিরিয়াতে দ্রুত গৃহযুদ্ধ অবসানের আশা ক্ষীণ। হয়তো এক ইরাকের স্বপ্নও ক্ষণস্থায়ী। এর শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি অঞ্চলের মধ্যেকার বিভেদ বেড়ে চলেছে দিন দিন। তাই ককবার্ন মনে করেন, আইএস সমস্যা দ্রুত সমাধানের আশাও ক্ষীণ। কারণ, আইসিস শুধু নিজ দেশে গড়ে ওঠা একটি ক্ষমতালোভী দল নয়। আইসিসকে বিভিন্ন শক্তি নিজেদের সুবিধার্থে জন্ম দিয়েছে, লালন করেছে ও সুযোগে ব্যবহার করছে। ইরাকে যেমন শিয়া সরকারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তাদের দরকার, তেমনি সিরিয়াতে বাশার সরকারকে নামাতেও তাদের দরকার। আবার আসাদ সরকারেরও আইসিসকে দরকার সিরিয়ায় সহিংসতা জিইয়ে রাখার জন্য, যাতে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো আইসিসকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আইসিসকে দরকার মুলসিম দেশগুলোর মধ্যে সময়-সুযোগমতো ব্যবহার করতে। আইসিস যখন বিদেশি নাগরিকদের শিরশ্ছেদের নৃশংস চিত্র দেখিয়ে পৃথিবীকে ভয় দেখাচ্ছিল, তখন বিদেশি নাগরিক ও সাংবাদিকেরা ভয়ে ইরাক-সিরিয়ার পথ মাড়ানো বন্ধ করল। তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় সুবিধা হলো যে তাদের এক দশকের ভুল নীতির চর্চা ও অনাবৃতকরণ কমে গেল ও আইসিস বিষয়ে খবর পাওয়ার সূত্র খুবই সংকীর্ণ হয়ে গেল। তাতে গণমাধ্যম এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হলো।
যেভাবে আফগানিস্তানে তালেবানদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে পরে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল আমেরিকা। তবে আইসিস তালেবান মডেল থেকে অনেক ভিন্ন। এখন তারা অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি হিংস্র। তাদের ব্যাপ্তি পৃথিবীব্যাপী। যে আদর্শের বলে আইসিস গঠন করা হয়েছে, আইসিসের সদস্য সংগ্রহ চলছে, তাতে আইসিস এখন শুধু একটি সন্ত্রাসী দল নয়, আইসিস এখন একটি আদর্শে পরিণত হয়েছে। আর এই আদর্শ এখন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে।
ককবার্নের এই বইটির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা এখানে আইসিসের আদর্শ ও উত্থানের সূচনা সম্পর্কে কোনো আলোচনা নেই। তাই ইকোনমিস্ট বইটির পর্যালোচনায় বলে যে বাগদাদির খিলাফতের ডাক হঠাত্ করে এত নৃশংসতা ও বিস্তার কীভাবে লাভ করল, তার উত্স খুঁজতে গিয়ে এর আদর্শ সম্পর্কে একেবারেই কোনো আলোচনা পাওয়া যায় না বইটিতে।২
আইসিসের উত্থানের কারণ
আইসিসকে লেখক বলেন যুদ্ধশিশু (পৃ. ৮)। ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধ ও ২০১১ সালে সিরিয়া যুদ্ধের বদৌলতে এই সহিংস দলের জন্ম। সনাতন ধর্মীয় আদর্শ ও সামরিক দক্ষতাই এদের সম্বল। ককবার্ন উল্লেখ করেন, পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমের মতে, ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নুর-ই-আল-মালিকির সাম্প্রদায়িক নীতি ইরাকের অন্তর্দ্বন্দ্বকে আরও চলমান করেছে। অতঃপর সিরিয়া যুদ্ধ ইরাকের পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। সিরিয়ায় ইরাকি জিহাদিরা একটি নতুন যুদ্ধক্ষেত্র পায় তাদের ক্ষমতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করার। আইসিসকে এই যুদ্ধের প্রতিটি খেলোয়াড় নিজের সুবিধামতো ব্যবহার করছে। তাই এর উত্থানের কারণ বহুমুখী। বইয়ের মুখবন্ধে ককবার্ন তাঁর এক সুন্নি মেয়েবন্ধুর ই-মেইলের কথা উল্লেখ করেছেন:
The bombardment was carried out by the government. The air strikes focused on wholly civilian neighborhoods. May be they wanted to target two ISIS bases. But neither round of bombardment found its target… The bombing hurt civilians only... The government bombardment did not hit any of the ISIS men… because of this bombardment youngsters are joning ISIS in tens if not in hundreds because this increases hatred towards the government (XVII).
এখানে প্রতীয়মান হয়, সাধারণ জনগণ আইসিসকে ঘৃণা করলেও ইরাকি সরকারি বাহিনীর আগ্রাসী পদক্ষেপে কীভাবে দিনে দিনে সরকারবিরোধী আক্রোশ আইসিসের প্রতি ঘৃণার থেকেও বড় হয়ে ওঠে।
ককবার্ন উল্লেখ করেন, ৬ জুন ২০১৪ ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তর শহর মসুল দখল করা ছিল আইসিসের উল্লেখযোগ্য বিজয়। ১৩ জুন আইসিস যোদ্ধারা ৬০ হাজার সৈন্যের ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়, যেখানে ইরাকি সামরিক ও পুলিশ বাহিনী ছিল যৌথভাবে। দুই বিপরীত বাহিনীর যোদ্ধাসংখ্যায় বিশাল পার্থক্য থাকলেও তা কেবল সংখ্যাই মাত্র। এই অবিস্মরণীয় বিজয়ের পেছনের আসল কারণ দুর্নীতি। সংখ্যা বড় হলেও বাস্তবে এর এক-চতুর্থাংশ উপস্থিত ছিল। বাকিরা তাদের বেতনের প্রায় অর্ধেক তাদের অফিসারদের দিয়ে লম্বা ছুটি কাটাত।
মসুল সব সময় নিরাপত্তাহীন ছিল। আইসিসের আগে আল-কায়েদা ইরাকে দুই মিলিয়ন সুন্নি মুসলিমের এই শহরে তত্পর ছিল। তখন তারা ব্যবসায়ীদের থেকে জোরপূর্বক চাঁদা আদায় করে চলত। লেখার এই অংশে ককবার্নের সাংবাদিকতার বিস্তর পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও বর্ণনা করে ইরাকের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি এক তুর্কি ব্যবসায়ীর উদাহরণ দেন, যিনি মসুলে নির্মাণকাজের চুক্তি নিয়েছিলেন। এক আইসিস নেতা তাঁর কাছে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার চাঁদা চেয়েছেন। তিনি বাগদাদ সরকারকে এ ব্যাপারে অবগত করেও কোনো ফল পাননি। আইসিসের আর একটি বড় সুবিধা ছিল টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস উপত্যকায় তাদের অবস্থান। ভৌগোলিকভাবে এই অঞ্চলে তাদের অবস্থানের কারণে তারা উত্তর-পশ্চিম ইরাক ও সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলের ওপর দখল রাখতে পেরেছে। তাই এই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল মসুল ও তিকরিত দখল করে নিয়েছিল বাগদাদকে বাদ দিয়ে। সময়টা ছিল ২০১৪ জুন থেকে আগস্ট, তারা ইরাকের কুর্দিস্তানে প্রবেশ করে এবং সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার কুর্দিশ ছিটমহল কোবানিতে প্রবেশ করে।
ইরাকে দুর্নীতি ছিল চরম। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ পাওয়া যেত না। এমনকি বিচারক রায় দিয়ে দিলেও ঘুষ ছাড়া জেল থেকে বের হওয়া যায় না। আবার যে কেউ যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারে, কারণ, হয়তো সেই কর্মকর্তা ১০ থেকে ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে তাঁর কাজ পেয়েছিলেন। লেখক ইরাকের দুর্নীতির বর্ণনা প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধ্যায়ে দিয়েছেন। পঞ্চম অধ্যায়ে অনেক বিশদভাবে খুবই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রভাবে বর্ণণা করেছেন, যা খুব বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয় না বইটির মূল বিষয়বস্তু সাপেক্ষে।
সামরিক বাহিনীতে দুর্নীতি ছিল সকল স্তরে। একজন আর্মি জেনারেল দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বিভাগীয় কমিশনার হয়ে যেতে পারেন। ককবার্ন তাঁর এক ব্যবসায়ী বন্ধুর কথা উল্লেখ করেন, যিনি তাঁর ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন, কারণ, পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে বিক্রয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে এত বেশি ঘুষ দিতে হয় যে পণ্যের বিক্রয়মূল্য অনেক বেড়ে যায় এবং তাতে লোকসানের মুখ দেখতে হয় (৬৫)। তথাপিও লেখক বলেছেন অর্থনীতি দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। লেখকের মতে, The frequent demand for bribes has not in itself crippled the sate or the economy. The highly autonomous Kurdistan Regional Government is deemed extremely corrupt, but its economy is booming and its economic management is praised as a model for the country.
তবে তিনি এই প্রশংসিত অর্থনৈতিক মডেলের কেবল উল্লেখ করেছেন, কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব
ইরাকে শিয়াশাসিত সরকার কর্তৃক সুন্নিগোষ্ঠীর প্রান্তিকীকরণ ইরাকের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বৃদ্ধির মূল কারণ। দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শাসন করার জন্য মালিকিকে ক্ষমতায় বসালেও তাঁর শাসন সাদ্দামের শাসনের মতোই সাম্প্রদায়িক, দুর্নীতিগ্রস্ত, অকার্যকর ও পাশবিক। ককবার্ন আইএসের আদর্শগত দিকটিতে ও তাদের বর্বরোচিত শাসনের ওপর কোনো আলোকপাত করেননি, তবে তিনি আইএসের উত্থানের পেছনে প্রতিহিংসাপরায়ণ শিয়া শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র সুন্নি বিরোধিতাকে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন।
ইরাকি সামরিক বাহিনী যখন সমূলে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তখন শেষ দিনে ইরাকি জনগণ ব্যারাকের ভেতরে প্রবেশ করে সৈন্যদের ওপর পাথর মারতে থাকে। ইরাকি সৈন্যকে ইরাকি সুন্নি জনগণ ইরানপুষ্ট মালিকির ছেলে মনে করে তাদের জারজ বলে গাল দেয়। মসুলে ইরাকি সামরিক বাহিনী বিদেশি শক্তি হিসেবে গণ্য হওয়ায় জনরোষের শিকার হয়। ইরাকি বাহিনী জনগণের ভয়ে তাদের অস্ত্র ও ইউনিফর্ম খুলে রেখে পালিয়ে যায় মসুল থেকে।
ককবার্ন এক সৈন্যের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, I saw women and children with military weapons; local people offered the soldiers dishdashes to replace their uniforms so that they could flee. (১৬)। মহিলা ও বাচ্চারাও অস্ত্র হাতে তাদের ধাওয়া করে। কিছু মানুষ তাদের সাহায্য করে, যাতে তারা পোশাক পরিবর্তন করে পালিয়ে যেতে পারে। তিকরিত ও বাইজিতেও একই অবস্থার সম্মুখীন হয় তারা। তিকরিতে যেসব সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, তাদের শিয়া ও সুন্নি দুই ভাগে ভাগ করা হয়। শিয়া সৈন্যদের ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয় এবং এই দৃশ্য ধারণ করে অন্য সৈন্যদের ভয় দেখানো হয় (১৭)। সাম্প্রদায়িকতার বিরোধ আরও গাঢ় হয় যখন শিয়া মাজারগুলো বুলডোজার দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয় (১০৩)।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে সুন্নি বাণিজ্যমন্ত্রীর দেহরক্ষী রাফি-আল-ইসাওয়ায়িকে সরকার গ্রেপ্তার করে। তবে উত্তর ও মধ্য ইরাকে সুন্নি-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হয়। ইরাকে ৩৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ সুন্নি। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, সুন্নি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। ককবার্ন উল্লেখ করেন, মালিকি সরকার কিছু পরিবর্তনের কথা বলে থাকলেও তার সম্পূর্ণটাই ছিল লোকদেখানো। তাই প্রথমে আন্দোলনকারীর সংখ্যা ১০ হাজার হলেও ধীরে ধীরে তা কমে ১ হাজারে আসে। আন্দোলনকারীর সংখ্যা বেশি দেখানোর জন্য একটি বাদে স্থানীয় সব মসজিদ শুক্রবারের নামাজের জন্য বন্ধ রাখা হতো। যাতে সব মুসল্লি এক জায়গায় জড়ো হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে এই আন্দোলন কীভাবে সহিংস আন্দোলনে পরিণত হয় বা আদৌ হয় নাকি বা এর সঙ্গে আইএসআইএসের উত্থানের সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা না থাকা ককবার্নের এই বইটির একটি দুর্বলতা। কারণ, তিনি শিয়া-সুন্নি বিভেদকে আইসিসের উত্থানের পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ডিসেম্বর ২০১২ সালে যে সুন্নি আন্দোলন শুরু হয়, শুরুতে তা ছিল শান্তিপূর্ণ। ২০১৩ সালের এপ্রিলে হাউইজার শান্তি ক্যাম্পে মালিকির নেতৃত্বে যে নৃশংস আক্রমণ চলে, তাতে ৫০ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু ঘটে এবং শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংস বিদ্রোহের রূপ নেয়। মালিকির বিরুদ্ধে যে জনরোষ ওঠে, তা আইসিসের পক্ষে সুবিধা বয়ে আনে। আঞ্চলিক আরও ৭-৮টা বিদ্রোহী দল আইসিসকে সমর্থন করে (৪৭)। যদিও লেখক মালিকিকে সম্পূর্ণরূপে দোষারোপ করেন না ইরাকে আইসিসের উত্থানের জন্য, তবে তিনি মনে করেন, এই সমস্যা বর্ধিতকরণে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। মালিকি হয়তো আইসিসের উত্থানের কিছু অবশ্যম্ভাবী সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করেছেন। আর তাই আইসিস বাগদাদ থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহর ফালুজা দখলের পর আলবার দখল করতে সক্ষম হয় (৪৮-৪৯)।
শিয়া-সুন্নি বিভেদ নিয়ে প্রথম, দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে লেখক আলোচনা করেছেন। বর্ণনাগুলো কখনো মাইক্রো বা কখনো ম্যাক্রো স্তরে করা। তিকরিত ও ফালুজা দখলে জঙ্গি তত্পরতার সূক্ষ্ম বিবরণ তিনি দিয়েছে, যা খুবই মাইক্রো পর্যায়ের। তিনি কোনো মতবাদের আলোকে আলোচনা করেননি, যার ফলে বইটি কখনো কখনো অসংগতিপূর্ণ মনে হয়। সাংবাদিক হিসেবে তিনি ইরাকে অনেক কিছু দেখেছেন, যার ফলে কোনো কোনো বিষয়ের একটু বেশি গভীরে পৌঁছে গেছেন, যা কখনো কখনো তাঁর যুক্তি তুলে ধরার খাতিরে আদিখ্যেতা মনে হয়েছে।
বিভিন্ন বহিঃশক্তির অবস্থান
ককবার্ন মনে করেন আমেরিকা, ইউরোপ ও তাদের আঞ্চলিক মিত্র তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আইসিসের উত্থানের মূল কারণ। ২০১২ সাল থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে আসাদ ক্ষমতা ছাড়বেন না। সিরিয়ার ১৫টা প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে ১৪টাই ছিল আসাদের নিয়ন্ত্রণে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে সাহায্য করে আসছে রাশিয়া, ইরান ও হিজবুল্লাহ। তারপরও জেনেভার শান্তি আলোচনায় তাঁকে মাত্র একটি শর্তই আরোপ করা হয়, তা হলো ক্ষমতা থেকে অপসারণ। আর যেহেতু আসাদ ক্ষমতা ছাড়বেন না, তাই এমতাবস্থায় আদর্শ অবস্থা হলো আইসিসের বিস্তার। আমেরিকা ও মিত্রশক্তিরা ইরাক ও সিরিয়ার সুন্নি জনগণকে আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে। ইরাক ও সিরিয়ায় আল-কায়েদা ধরনের দলগুলোর সহিংসতাই কেবল শঙ্কার শেষ নয়। অসহিষ্ণু ও সনাতনি ওয়াহাবি আদর্শের প্রচার যেভাবে শুরু হয়েছে, তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ১৬ বিলিয়ন মুসলমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যা পৃথিবীর জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ। তাতে যে অমুসলমানরা এই ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধের লেলিহান শিখা থেকে মুক্তি পাবে, তা নয়। বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া জিহাদি আদর্শ, যা বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করছে, তার প্রভাববলয় থেকে মুসলিম-অমুসলিম কেউই রক্ষা পাবে না।
ককবার্ন মনে করেন, ৯-১১ জঙ্গি হামলা-পরবর্তী মার্কিন নীতি আল-কায়েদার ভবিষ্যত্ নির্ধারণ করে। টুইন টাওয়ার ঘটনার সব আলামত সৌদি আরবের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে। ওসামা বিন লাদেন সৌদি বনেদি পরিবারের সদস্য। তাঁর বাবা ছিলেন সৌদি বাদশাহর কাছের মানুষ। আল-কায়েদার অর্থ আসত আরব উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে। হামলাকারী ১৭ জনের ১৪ জনই ছিল সৌদি (৫৬)। মার্কিন নথিপত্রেও বারবার উঠে এসেছে যে আল-কায়েদা ও অন্য জিহাদি দলগুলোকে সৌদি আরব ও আরব রাজতন্ত্রগুলো আর্থিকভাবে মদদ দিয়ে আসছে। ১৯৯০-এর প্রথমার্ধ থেকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতায় আনতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এমনকি আফগানিস্তান ও পাকিস্তানবিষয়ক মার্কিন বিশেষ প্রতিনিধি রিচার্ড হলব্রুক বলেছেন, ‘আমরা হয়তো ভুল দেশে ভুল শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।’
সৌদি আরব ও অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশের দাবি, সিরিয়া থেকে আসাদ সরকারের অপসারণের ফলে আইএসের উত্থান। ককবার্ন এ-ও বলেন যে মার্কিন ৯-১১-পরবর্তী নীতি দ্বিধাপূর্ণ। যতক্ষণ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরব ও পাকিস্তানকে ইসলামি উগ্রবাদ প্রচারের জন্য দায়ী না করবে, ততক্ষণ জিহাদবিরোধী আন্দোলন সামান্যই সফল হবে। ককবার্ন বলেন, The movement against which they are aimed have not been defeated but rather have grown stronger (৫৯)। আমেরিকা ও ব্রিটেনের যৌথ প্রচেষ্টায় গোয়েন্দা-ব্যবস্থার ব্যাপক বিস্তার ও ৯-১১-পরবর্তী বিপুল অর্থের বিনিময়েও আল-কায়েদা ও তাদের সমর্থিত দলগুলোর বিস্তার কমানো সম্ভব হয়নি। বরং তারা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।
২০০১-পরবর্তী‘War on terror’-এর কারণে বিশ্বরাজনীতির যে পটপরিবর্তন হয়ে আসছে তার ভয়াবহতা ২০১৪-তে মসুল দখলের আগ পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি (৫৯)। ককবার্ন ইরাকে শিয়া-সুন্নি বিরোধ ও মালিকি সরকারের দুর্নীতিকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখলেও গার্ডিয়ান পত্রিকার আলোচনায় ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনকে ‘অবৈধ’ বলা হয় ও এই আগ্রাসনকে আল-কায়েদা বিস্তারের মূল কারণ বলে উল্লেখ করেন। ইরাকের বঞ্চিত সুন্নিরা প্রথমে আইসিসে যোগ দেয়। পরবর্তী সময়ে আইসিস রোধ করতে এর নেতাদের মার্কিনরা কেনার চেষ্টা চালায়।
২৮ মে ২০১৪ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেন, আমেরিকার আসল শত্রু এখন আর সংঘবদ্ধ আল-কায়েদা নয়, বরং অসংঘবদ্ধ আল-কায়েদা এবং তাদের জোটবদ্ধ দলগুলো। যেহেতু সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই এই যুদ্ধরত জঙ্গিদের আমেরিকার ওপর আক্রমণের সম্ভাবনাও বেড়েছে। এর প্রতিকার হিসেবে ওবামা প্রশাসন আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সরকারবিরোধী সর্বাপেক্ষা উত্তম বিকল্পকে সমর্থন করার নীতি বেছে নিয়েছে। তাই ওবামা আসাদবিরোধীদের আধুনিক সমরশাস্ত্র ও অস্ত্রে প্রশিক্ষিত করে তুলতে ২০১৪ সালের জুনের মধ্যে কংগ্রেসের কাছে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রত্যাশা করেন। এই ঘোষণার ছয় মাসের মাথায় তাঁরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি স্বীকার করেন যে আসাদবিরোধী শক্তিরা আসলে আইসিস ও আল-নুসরা দ্বারা পরিচালিত। তবে আল-কায়েদা ও তাদের প্রতিনিধিদলগুলোর সঙ্গে মার্কিন সাহায্যপ্রাপ্ত বিরোধী মিত্রদের বাস্তব অর্থে কোনো পার্থক্য নেই। ককবার্ন সিরিয়ার এক প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশের (নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি) এক গোয়েন্দার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, যখন আসাদবিরোধী দলগুলোকে অত্যাধুনিক অস্ত্র পাঠানো হয়, তখন আইসিস খুবই খুশি থাকে। কারণ, তারা ভয় দেখিয়ে বা অর্থের বিনিময়ে সব সময়ই তাদের থেকে সেসব অস্ত্র নিয়ে নেয় (৩)। লেখক বলেন, ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে আইসিসের মসুল দখলের আগে, ইউরোপীয় বিমান তাদের বাগদাদযাত্রা বন্ধ করে দেয়। কারণ, তাদের ভয় ছিল সে জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে বিমানবিধ্বংসী মিসাইল আছে, যা আসাদবিরোধীদের দেওয়া হয়েছিল।
ককবার্ন ৯-১১-পরবর্তী মার্কিন নীতিকে অসত্ বা অযৌক্তিক বলে মনে করেন। কারণ, সিরিয়া ও ইরাকে বিদেশি জিহাদিদের ওবামা সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করেন, যাদের এই অঞ্চলে প্রবেশ করার একমাত্র পথ তুরস্ক-সিরিয়ার ৫১০ মাইল লম্বা সীমান্ত পথ। সৌদি আরব, তুরস্ক ও জর্ডান হয়তো এখন তাদের তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের ভয়ে নিজেরাই কাতর, তবে এই দানব নির্মূলে তারা সামান্যই অবদান রাখতে পারছে (৭)। তাই ধারণা করা যেতে পারে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতকে তাদের সিরিয়ায় বিমান হামলা বা যুদ্ধে লিপ্ত করার কারণ এই দেশগুলোর সিরিয়ায় জিহাদিদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা।
ককবার্ন মনে করেন, সৌদি আরবের ভূমিকা আইসিসের উত্থানের পেছনে অনেকটা ভুল বা কম গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। শুধু তেল বা অর্থপ্রাচুর্যের কারণেই এই রাজতন্ত্র প্রভাবশালী নয়, বরং তারা তাদের সনাতনী বা রক্ষণশীল ইসলামি আদর্শ, যা মেয়েদের অধিকার খর্ব ও শিয়া ও সুফি মুসলমানদের অমুসলিম হিসেবে দেখে এবং মনে করে খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সঙ্গে তাদের হত্যা করা উচিত। আইসিস ও আল-কায়েদা আদর্শগতভাবে ওয়াহাবি মতবাদের সঙ্গে অনেক সহমত পোষণ করে। তাদের সমালোচনাকারীদের দেশত্যাগ করতে হয়, নতুবা হত্যা করা হয়।
মুসলিম দেশগুলোতে সৌদি আরব ওয়াহাবি আদর্শের প্রবর্তন করার জন্য দেশে দেশে মসজিদ বানিয়ে ও ইসলাম প্রচারকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছে। ককবার্নের মতে, তাতে সাম্প্রদায়িক বিরোধ শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে বেড়েই চলছে। যার ফলে তিউনিসিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে অদ্ভুত এক হিংস্রতা (৬)। তথাপি জর্জ বুশ কখনোই সৌদি আরবকে ৯-১১ ঘটনা বা সন্ত্রাসবাদে মদদ দানকারী হিসেবে দেখেনি। এমনকি ৯-১১ কমিশন রিপোর্টে ২৮ পৃষ্ঠাজুড়ে হামলাকারীদের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে বর্ণনা আছে, যা মূল রিপোর্ট থেকে কেটে ফেলা হয়েছে এবং কখনো তা প্রকাশ করা হয়নি (৫৭)। ২০০৯ সালে তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ই-মেইল, যা উইকিলিকস প্রকাশ করে, সেখানে বলা আছে, সুন্নি জঙ্গি দলগুলোর মূল অর্থদানকারী হলো সৌদি আরব (৫৭)। তারপরও পশ্চিমা সরকারগুলো সৌদি ধর্মপ্রচারকদের শিয়াবিরোধী হিংসাত্মক ধর্ম প্রচারে বাধা দেয়নি। যুদ্ধশিশু আইসিস বা বর্তমান জঙ্গিবাদের এক অভিভাবক সৌদি আরব হলে অপরজন পাকিস্তান। তালেবান বা জিহাদিদের মদদদানে পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার প্রমাণ বারবার এলেও পশ্চিমা সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ব্যবস্থা নিতে বিরত থেকেছে।
সিরিয়া ও ইরাকে যে সশস্ত্র সরকারবিরোধী আন্দোলন চলছে, তা সালাফি জিহাদি ও প্রথাগত ধর্মীয় অনুশাসনের পবিত্র যুদ্ধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পশ্চিমা সরকারগুলো সিরিয়া, ইরাক বা বিশ্বজুড়ে শিয়া হত্যা নিয়ে চিন্তিত না-ও হতে পারে, তবে আল-কায়েদার আদর্শে উদ্বুদ্ধ সুন্নি আন্দোলন, যা ৯-১১-পূর্ববর্তী আল-কায়েদার সীমানা ছাড়িয়ে অনেক বড় পরিসরে বিস্তৃত হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে ঘোর দুশ্চিন্তায় আছে।
সিরিয়া যুদ্ধে সৌদি সম্পৃক্ততা শুধু আসাদ সরকারকে সরাতে অর্থ ও অস্ত্রাদি দিয়ে সাহায্য করার মধ্যেই সীমিত নয়। তারা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে শুরু থেকে সশস্ত্র বিরোধের কথা বলে আসছে, তা কোনো সরকার কর্তৃক হোক কিংবা দল কর্তৃক। ওয়াহাবি আদর্শ, সৌদি শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়। তাদের আদর্শ ও আল-কায়েদার আদর্শ সম্পূর্ণ অভিন্ন না হলেও খুব বেশি অমিল নেই (৭৭)। ওয়াহাবি আদর্শ সম্পূর্ণরূপে অন্যান্য ইসলামি আদর্শ বা চেতনাসহ যেকোনো ধর্মকে অস্বীকার করে। এই ওয়াহাবি প্রচারণা শিয়া-সুন্নি বিভেদকে অনেক গাঢ় করে তুলেছে।Directorate General for External Policies of the European Parliament ২০১৩ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়, সালাফি বা ওয়াহাবি আদর্শে উদ্বুদ্ধ বিদ্রোহী দলগুলোকে অস্ত্র প্রদান করা হয়। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব সেই ১৯৮০ সাল থেকেই এই দলগুলোকে অর্থ দান করে যাচ্ছে। তারা ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৬ বিলিয়ন পাউন্ড সমপরিমাণ অর্থ খরচ করেছে ওয়াহাবি অ্যাজেন্ডা প্রচার করতে। যার ফলে জিহাদি যোদ্ধা তৈরি হয়েছে।
১৯৮০ সালে এক জোট গঠিত হয় সৌদি আরব, পাকিস্তান ও আমেরিকার, যা এখনো অবধি অক্ষত রয়েছে। এই জোটের মধ্য দিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার আধিপত্য বিস্তার হয়, যার মধ্যে পরবর্তী আল-কায়েদার বীজ নিহিত থাকে। পঞ্চম অধ্যায়ে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মালিকির ফ্রান্স ২৪-কে দেওয়া একটি সাক্ষাত্কারের কথা উল্লেখ করেন ককবার্ন। মালিকি স্পষ্টভাবে সৌদি আরব ও কাতারকে দোষারোপ করেন ইরাকে সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা বিস্তারের জন্য। তিনি আরও বলেন, রিয়াদ ও দোহা সরাসরি এই জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে, এমনকি তাদের জন্য যুদ্ধাস্ত্রও কিনছে। তিনি বইয়ের অনেক অংশে সৌদি আরব ও পাকিস্তানকে জঙ্গিবাদ উত্থানে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে মদদ দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো তথ্যসূত্র ব্যবহার করেননি।
ককবার্ন মনে করেন, ‘War on terror’ সফল হয়নি, কারণ মার্কিনদের জঙ্গি নির্মূল পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না, তারা এই সমস্যার দুই মূল ইন্ধনদাতা সৌদি আরব ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমেরিকা তাদের এই পুরোনো ও গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের কোনোভাবেই খেপাতে চায়নি। সৌদি আরব আমেরিকার একটি বড় অস্ত্রবাজার। এ ছাড়া সৌদি বাদশাহরা তাদের অর্থ দিয়ে আমেরিকান রাজনীতিকদের ক্রয় করে রেখেছেন। ১৮০ মিলিয়ন জনসংখ্যা পারমাণবিক ক্ষমতাধর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পেন্টাগনের সঙ্গে ভালো সখ্য আছে (৫৮)।
তবে বর্তমানে জঙ্গিবাদে মদদদানকারী এই রাষ্ট্রগুলোর কার্যকলাপে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। [তুরস্কের সহায়তায় সিরিয়া সীমানার কোবানি থেকে আইএস অপসারণের মধ্য দিয়ে।] সৌদি আরবও তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সপ্তম অধ্যায়ে ককবার্ন উল্লেখ করেছেন যে সৌদিদের এভাবে প্রকাশ্যে সিরিয়ায় জিহাদিদের সহায়তা করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। তার কারণ, তারা ১৯৮০ সালে আফগানিস্তান থেকে পাওয়া শিক্ষা থেকে ভীত, যেভাবে যুদ্ধপরবর্তী তালেবান, আল-কায়েদা ও জিহাদিদের জন্ম হয়। মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান জেমস ক্লেপার বলেন, সিরিয়াতে বিদেশি যোদ্ধাদের মধ্যে সাত হাজার মানুষ আরব দেশগুলো থেকে এসেছে। সৌদিরা জঙ্গিবাদে সহায়তা করলেও, তারা তাদের ভূখণ্ডে জিহাদিদের উত্থানকে ভীত চোখে দেখে। তাদেরও ভয় আছে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে জিহাদিরা যখন নিজ দেশে ফিরে আসবে, তখন রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধাস্ত্র, অর্থ, মেধা ও শ্রম ব্যবহার করবে। তাই বাদশাহ আবদুল্লাহ সৌদিদের বিদেশি ভূখণ্ডে যুদ্ধ করা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা করেন ও গোয়েন্দাপ্রধান বাদশাহ বন্দরকে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দেয়। সেন্টার ফর একাডেমিক শিয়া স্টাডিজের ইউসুফ আল খোই মনে করেন, এই ফতোয়া যথেষ্ট নয়। সৌদি শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে সুফি, শিয়া, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের পিশাচ বলে শেখানো হয়, তার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। আরব দেশের মধ্যেও সিরিয়া নীতি নিয়ে বিরোধ শুরু হতে থাকে। সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার থেকে তাদের দূত সরিয়ে নেয়, কারণ, কাতার মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন করে ও সিরিয়ায় জিহাদি দলগুলোকে আর্থিক সাহায্য দেয়(১০৬)। ককবার্ন উল্লেখ করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সিরিয়ায় জিহাদিদের অর্থায়ন বন্ধ করার জন্য। আবার সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান বাদশাহ বন্দর-বিন সুলতান, যিনি ওয়াশিংটনে সৌদি দূত ছিলেন ও আসাদ সরকারবিরোধী প্রচারণার মূল হোতা, সিরিয়াতে সেনা অভ্যুত্থান না করার জন্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তিরস্কার করেন। নাইফ আল আজমি, যিনি একাধারে দুটি মন্ত্রণালয়—বিচার ও ইসলামি সম্পর্কের মন্ত্রী, মার্কিন চাপের মুখে পদত্যাগ করেন। কারণ, আজমি সিরিয়ায় জিহাদি অর্থায়নে বহুল পরিচিত নাম। এমনকি আল-নুসরা ফ্রন্টের অর্থায়ন পোস্টারে তাঁর ছবিও দেখা গিয়েছিল।
সম্ভবত সৌদি আরবের এই বিস্তৃত জঙ্গিবাদের প্রভাব বুঝতে অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়েছে। ককবার্ন এক জিহাদি টুইটারের কথা উল্লেখ করেন (লেখক নাম উল্লেখ করেননি), যেখানে একটি ছবিতে লেখা আছে, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা আরব অঞ্চলে প্রবেশ করব। যেভাবে আমরা আজ লেভান্তে, কাল আমরা আল-কুরায়াত ও আরার-এ (সৌদি আরবে দুই শহর) প্রবেশ করব’ (১০৭)।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের ভূমিকা
ইরাক ও সিরিয়ায় জিহাদিরা যে ভেতরে ভেতরে এত শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, তা গণমাধ্যম ও রাজনীতিকেরা উপেক্ষা করে চলছিলেন। তবে একটি বড় কারণ হলো পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা কেবল আল-কায়েদা ও ‘কোর’ বড় জিহাদি শক্তি বলে মনে করত। তাদের সবার দৃষ্টি সব সময়ই ছিল আল-কায়েদার ওপর । আর এভাবে তারাও গর্বসহকারে তাদেরWar on terror-এর সাফল্য নিয়ে খুশি ছিল। পশ্চিমাদের ধারণা ছিল, আল-কায়েদার সমর্থন ও জোট ছাড়া কোনো জিহাদি শক্তি বড় কোনো হুমকি হতে পারবে না। তাই আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি আইএসআইএসের নৃশংসতাকে সমালোচনা করাতে তারা মনে করে, আইসিসের আল-কায়েদার সমর্থন নেই।
আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আমেরিকানরা সৌদি আরবের সঙ্গে একটি ‘দক্ষিণাঞ্চলীয় ফ্রন্ট’ তৈরি করে, যার অবস্থান হবে জর্ডানে। এই ফ্রন্ট দামাসকাসে আসাদের বিরুদ্ধে উত্তর ও পূর্বে আল-কায়েদা ধরনের দলগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করবে। ‘ইয়ারমুক ব্রিগেড’, যারা সৌদি আরব থেকে বিমানবিধ্বংসী মিসাইল পায়, এই ফ্রন্টের নেতৃত্ব দেয়। বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায় যে আল-নুসরা, আল-কায়েদার সহযোগী দল, এই ব্রিগেডের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এই দুই দল তাদের যুদ্ধাস্ত্র ভাগাভাগি করে, অর্থাত্ ওয়াশিংটন আসলে তাদের শত্রুদেরই যুদ্ধাস্ত্র প্রদান করছে। ইরাকি সরকারও নিশ্চিত করেছে যে তারা আইসিস থেকে যে যুদ্ধাস্ত্র জব্দ করেছে, সেগুলো বিদেশি শক্তি হতে প্রেরিত, যা সিরিয়ায় আল-কায়েদাবিরোধী শক্তির কাছে পাঠানো হয়েছিল। তবে এই সংবাদগুলো পশ্চিমা গণমাধ্যমে খুব বেশি দেখা যায় না। পশ্চিমাদের যেকোনো শত্রুকে আল-কায়েদা নামকরণ করে সব বিরোধী শক্তিগুলোকে এক কাতারে ফেলে একই পদ্ধতিতে তা মোকাবিলা করার প্রবণতা আছে, যা সব গণমাধ্যম যেন কায়মনোবাক্যে মেনে নিয়েছে। সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যখন ইরাকে হামলা চালানো হয়, তখনো বলা হয়, সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে ৯-১১ পরিকল্পনাকারীদের সম্পর্কের কথা। যদিও বাস্তবে এই বক্তব্যের কোনো সত্যতা প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। সাদ্দাম হোসেনকে নিজ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্য ফাঁসি দেওয়া হলেও, ইরাক আক্রমণ যে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল ও এই ভুলের জন্য যে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল, বাস্তুহারা হলো, তার জন্য কাউকে দোষী করা হলো না, কেউ শাস্তি পেল না। কেবল সুবিধামতো অনেক বছর পর যখন আর কোনোভাবেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন কেবল স্বীকার করে নিল, ইরাক আক্রমণ ভুল সিদ্ধান্ত ছিল! এই পুরো বিষয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম, যা মধ্যপ্রাচ্য সংবাদের মূল ও অনেকটা একমাত্র সূত্র কিছুই বলল না। এমনকি ককবার্নের মতো বিচক্ষণ সাংবাদিক, যিনি তাঁর লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন মার্কিন ভুল নীতির কথা, তিনি একবারও এই ভুলের কৈফিয়ত চাননি বা কাউকে দায়ী করেননি। পশ্চিমারা নিজেদের ভুল লুকোতে আল-কায়েদাকে শক্তিশালী শত্রু হিসেবে বারবার তুলে ধরেছে এবং ককবার্নসহ বেশির ভাগ সাংবাদিক সেই প্রচারণারই প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।
ককবার্ন তাঁর লেখায় অনুসন্ধিত্সু সাংবাদিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর লেখা ও পর্যবেক্ষণের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি এই যুদ্ধ ও আইসিসের পেছনে অধ্যবসায়, একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। অনেক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, তিনি আইসিসের উত্থান ও বিস্তার সম্পর্কে সবার আগেই তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর বিশ্লেষণ প্রায় সব সময়ই নির্ভুল হয়। তিনি তাঁর লেখায় অনেক জায়গায় পশ্চিমা শক্তির নীতিকে দায়ী করেছেন আইসিসের উত্থানের পেছনে, যা তাঁর লেখাকে অনেকটা পক্ষপাতিত্বহীন করে তুলেছে। তবে কিছু কিছু বিষয়ে তিনি খুবই সাবধানতার সঙ্গে এড়িয়ে গিয়েছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নির্মমভাবে উপেক্ষা করেছেন। ককবার্ন তাঁর বইতে আইসিসের উত্থান নিয়ে অনেক ক্ষুদ্র বিষয়ের বিস্তর বিবরণ দিয়েছেন, যা হয়তো আসল কারণ থেকে পাঠকের দৃষ্টি সরিয়ে আনার প্রয়াস। তিনি আইসিসের বিবরণে ইরাকের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন অথচ তিনি আবু ঘারিবের কথা উল্লেখ করেননি।
আইসিস তাদের অস্তিত্ব ও নৃশংসতার জানান দিতে এক ভিডিও বার্তা ছাড়ে, যাতে দেখা যায়, তারা ২১ জন মিসরীয় খ্রিষ্টানের শিরশ্ছেদ করা হচ্ছে। প্রত্যেকে কমলা রঙের জাম্পস্যুট পরিহিত, পেছনে কয়েদিদের মতো হাত বাঁধা। এমনই কমলা রঙের জাম্পস্যুট পরিহিত, হাত বাঁধা কয়েদিদের ওপর আমেরিকানদের নির্মম অত্যাচারের ছবি দেখা গিয়েছে ২০০৪ সালে। এই আবু ঘারিবের অত্যাচারিত বন্দীদের কথা ভুলে গেলে বা উপেক্ষা করলে আইসিসের উদ্দেশ্য ও নৃশংসতা সম্পর্কে বোঝা যাবে না। আইসিসের জিহাদি বা জঙ্গি বা যোদ্ধা তাদের যা-ই বলা হোক না কেন, তারা প্রতিশোধ নিতে ব্রত। আইসিসের অনেকেই আবু ঘারিব বা ক্যাম্প বুকা থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত। বরং বলা যায়, ক্যাম্প বুকায় আমেরিকার চোখের সামনে মানুষ আইসিসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। একই জায়গায় চরমপন্থী ও সাধারণ বন্দীদের রাখা হয়েছিল। এই ক্যাম্পেই বাগদাদি ছিল, যিনি ছাড়া পাওয়ার পর তাঁর ক্যাম্পের সহযোগীদের তাঁর দলে ভেড়ান।৩ আইসিসের উত্থান নিয়ে তিনি কেবল ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধ উল্লেখ করেছেন। তুরস্ক, জর্ডান ও মার্কিন নীতি বা সাহায্য দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা মুসলিম নিপীড়ন আইএসের উত্থানকে কীভাবে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে, তা তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
ইরাকের দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন অথচ মালিকি ক্ষমতায় আসার পরও ২০১১ সাল পর্যন্ত মার্কিন বাহিনী ইরাকে অবস্থান করেছে এবং নতুন সরকারের শাসনব্যবস্থায় সম্পূর্ণ হস্তক্ষেপ করেছে, তারপরও এত দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও আইসিসের উত্থান, তার দায়ভার কেবল ইরাকের ওপরই। আইসিসকে সাহায্যের পেছনে সৌদি আরবের অবদানের কথা একভাবে বলা হলেও, তাদের বিরুদ্ধে কেন আমেরিকা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, সেই ব্যাপারে বইটিতে মার্কিন নীতির আলোচনা নেই।
আইএসআইএসের উত্থান সম্পর্কে তাঁর বিশদ বিবরণ প্রশংসনীয়। কীভাবে আইএসআইএস একের পর এক অঞ্চল দখল করে সিরিয়া পর্যন্ত গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তর এলাকা দখল করে নিয়েছে, তা ককবার্নের অনুসন্ধানমূলক এই বই পড়লে স্পষ্ট হবে। তবে এখানে তিনি একটি বড় অংশ একেবারেই বাদ দিয়ে গিয়েছেন। তা হলো আইসিসের আদর্শ। তবে আইসিসের উত্থান সম্পর্কে তাঁর বর্ণনায় কিছুটা মনে হতে পারে যে এটি একটিHome grown বা স্বদেশীয় ব্যাপার, যা আমেরিকার ভুল নীতির ফলে সৃষ্ট শূন্যস্থানের সুযোগে সৃষ্টি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মদদে বিস্তৃতি লাভ করেছে। আইসিস কেবল একটি দল নয়, আইসিস একটি আদর্শ। আফগানিস্তানের তালেবানদের থেকেও এর ভয়াবহতা বেশি। বিভিন্ন দেশ তাদের নিজেদের স্বার্থে, অভ্যন্তরীণ, আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক কারণে তাদের ব্যবহার করছে। তাদের একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি দল হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা থেকে থাকলেও, তারা কেবল এই পরিচয়ে সন্তুষ্ট নয়। কারণ, তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে তাদের দলে মানুষকে ভেড়াতে হবে, যা তারা তাদের মতাদর্শের প্রচারের মাধ্যমে করে। তাতে বিশ্বজুড়ে তাদের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ছে, যা শক্ত হাতে বন্ধ করার প্রয়োজন আরও অনেক আগেই ছিল। বইটিতে ককবার্ন সৌদি আরব, পাকিস্তান ও তুরস্ককে দায়ী করেছেন জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার জন্য এবং সে ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ক্ষমতা দখলের কারণ উল্লেখ করেছেন। তবে আমেরিকা কেন তার এই মিত্র রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না, সেই সত্যের ওপর আলোকপাত নেই। বইটি যেখানে আইএসের উত্থান ও সুন্নি আন্দোলনের কথা বলেছেন, সেখানে ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে এই দল বা আদর্শের কোনো উল্লেখ না থাকা আইসিসের ক্ষমতার সরলীকরণ।
তথ্যসূত্র:
১. https://www.versobooks.com/books/1830-the-rise-of-islamic-state
২. ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দ্য ইকোনমিস্ট প্রতিবেদন, Rolling into town: How the rise of Islamic State is changing history of the middle East bvGg http://www.economist.com/news/books-and-arts/21644117- how-rise-islamic-state-changing-history-middle-east-rolling-town
৩. https://www.theguardian.com/world/2014/dec/11/-sp-isis-the-inside-story