ভারতবর্ষের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মন
ভারতবর্ষের বেশির ভাগ রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিষেক ঘটেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে, এটা স্বীকৃত ঘটনা। তারা যা ভেবেছে, যা বলেছে এবং যা করেছে, আন্দোলনের দলিলগুলো সেসবেরও দলিল। এমনকি অন্যরা শরিক হওয়ার পরও আন্দোলনের নেতৃত্ব এই শ্রেণির হাতেই ধরা ছিল। আন্দোলনের আরজিনামা, যুক্তি, দাবিদাওয়া ও হুমকি-ধমকি থেকেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার পরিণতির ব্যাখ্যা মিলবে; তা ঠিক নয়। কিন্তু আমরা যদি এসব রাজনৈতিক আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে চাই, তাহলে ভিনদেশি সরকারের সঙ্গে মধ্যবিত্তের সত্যিকার সম্পর্কের পাশাপাশি কী জাতীয় শিক্ষা তাঁরা পেয়েছিলেন, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। কেননা, তাঁদের দেওয়া শিক্ষার জোরেই তো এই শ্রেণি ‘শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি’ হয়ে উঠতে পেরেছিল এবং সেই শিক্ষার দোহাই দিয়েই এরা নেতৃত্বের দাবিদার হওয়াকে জায়েজ করেছিল। ব্রিটিশ শাসনের মৌলিক কিছু দিকের বিরোধিতাই ছিল আন্দোলনগুলোর সারবস্তু। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও পরিহাসের বিষয় এটাই যে আন্দোলনের বনিয়াদি চিন্তাভাবনাগুলো ছিল ওই সরকারেরই দান। সমগ্র আন্দোলনে লম্বা সময় ধরে ভারতবর্ষের অখণ্ডতার অলঙ্ঘনীয় বিশ্বাস কাজ করে গেছে। কিন্তু এমন চিন্তা তো ছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ প্রশাসনের আইনি এখতিয়ার বাড়ানোর ফল। ব্রিটিশরা যদি ১৮৪৯ সালে পাঞ্জাব জয় না করত, তাহলে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আন্দোলনের আওতায় পাঞ্জাব আসত কি না সন্দেহ। একইভাবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের তরফে ১৯৩০-৩১ সালে বার্মাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার দাবির পক্ষেও কোনো যৌক্তিকতা ছিল না।
বাস্তবতা হলো, আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের যে অবস্থা, তাতে জনগণকে একীভূত জাতীয় এককের চেয়ে একই মহাদেশের অধিবাসী বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ বলে মনে হতো। ভারতবর্ষে ব্রিটেনের হস্তক্ষেপ এখানকার অর্থনৈতিক বিকাশকে শুধু পরিবর্তিত ও বাধাগ্রস্তই করেনি, একই সঙ্গে তাদের ওপর একটা রাজনৈতিক ঐক্যও চাপিয়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ রাজনৈতিক ঐক্য আনয়নকারী অর্থনৈতিক ভিত্তি অর্জিত হওয়ার অনেক আগেই ভারত একক রাজনৈতিক ইউনিটে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক বিকাশের এই উল্টোমুখী যাত্রার মধ্যেই কিন্তু—তা সে রাজনৈতিক দলের বিকাশের বেলায়ই হোক বা অন্য কোনো ব্যাপারে—ভারতীয় রাজনীতির বিসাদৃশ্যগুলো কমবেশি শনাক্ত করা সম্ভব। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তন এই বিচিত্র, আলাদা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈরী উপাদানগুলোকে ছাঁচে গড়া রাজনৈতিক ঐক্যের কাঠামো জোড়া লাগাতে পারেনি। ঐক্যের নীতিটা কিন্তু ভারতবর্ষের অধিবাসীদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা থেকে উঠে আসেনি। বরং এটা এসেছে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর বিশ্বাস থেকে। ভারতীয় ঐক্যের ধারণা একটা মাত্রা পর্যন্ত এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যে আগ্রহী ইউরোপীয়দের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা থেকে উদ্ভূত হলেও বিশদ বাস্তবতা তৈরি হয়েছে শাসনযন্ত্রের অর্থাৎ যাদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে আইনকানুন বজায় রাখা হতো, তাদের চাহিদার ভিত্তিতে। প্রথমত ও প্রধানত যে প্রশাসনযন্ত্রের মাধ্যমে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্পষ্ট হয়, তা এত বিশাল ছিল বলেই পরিস্থিতির মধ্যে শেষ পর্যন্ত আলাদা প্রভাব নিয়ে টিকে ছিল। ভারতের ঐক্যের চূড়ান্ত কারণ হয়ে থাকতে পারে বাজারের ঐক্য। কিন্তু ভারতকে জোড়া লাগানো হয়েছিল যেসব গিট্টু দিয়ে, সেসবের রোজকার বিবর্তনের মধ্যে প্রশাসনযন্ত্রের প্রয়োজনই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল।
অন্যভাবে বললে, শুরুতে রাজনৈতিক একত্ব চাপিয়ে দিয়েছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং তাদেরই হাতে বেড়ে ওঠা সর্ববিরাজিত প্রশাসনযন্ত্র একে হৃষ্টপুষ্ট করে তুলেছিল। এমনকি আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্তও দেশীয় মধ্যবিত্তরা ওই যুগের সামাজিক–অর্থনৈতিক ময়দানে একটানা প্রভাবশালী হয়ে উঠছিল। অর্থনৈতিক কাঠামোতে গ্রামের প্রাধান্য তখনো বজায় ছিল। যদিও পণ্যের কেনাবেচা ও বিলিবণ্টনের দরকারে উঠতি ও ধনবান মধ্যশ্রেণির রমরমা ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে বড় বড় শহরের উত্থান হচ্ছিল। মূলত বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদনকারী কারিগরদের অনেক শ্রেণি উৎপাদনী ক্ষেত্রেও পরিবর্তন বয়ে আনছিল। অর্থনৈতিক জীবনের এই রূপান্তর মধ্যশ্রেণির গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়।
ইউরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের বাণিজ্যের ধরন ও মাত্রা দেখলেই ভারতবর্ষের অর্থনীতির পরিবর্তনশীল চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ১৭৫৭ সালের বিপর্যয়ের পেছনে জগৎ শেঠ পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই কিন্তু ধনবান শ্রেণির রাজনৈতিক প্রতিপত্তির উদাহরণ। পুরোপুরি সামন্তবাদী অর্থনীতিতে এমনটা একেবারেই সম্ভব হতো না। কিন্তু মধ্যবিত্তের সামাজিক মর্যাদা ও ভূমিকা বদলের দুটি কারণ থাকতে পারে, ১. ইউরোপের সঙ্গে ভারতের ব্যবসার ধরনে পরিবর্তন, ২. মূলত বাজারের জন্য উৎপাদনে নিয়োজিত কারিগর শ্রেণিগুলোর অবস্থার লাগাতার পতন।১ ব্রিটিশদের ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রাক্কালে জগৎ শেঠ পরিবারের অবনতি ও পতনের ঘটনা পুরোনো মুদ্রা ব্যবসায়ী ধনী পরিবারগুলোর বিলুপ্তি এবং নতুন শ্রেণির উত্থানেরই লক্ষণসূচক ঘটনা। তখন থেকেই ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ও চরিত্র দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকা রাজনৈতিক কাঠামোর শর্তাধীন হয়ে পড়ে; দেশের প্রয়োজনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না।
ভারতীয় অর্থনীতির সামাজিক ভিত্তিতে যে রদবদল ঘটে চলছিল, তা আরও চমৎকারভাবে বোঝা সম্ভব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে একের পর এক দেশীয় রাজ্যের পতনের ঘটনায়। এ ঘটনার আংশিক ব্যাখ্যা তো অবশ্যই কোম্পানির সেনাদের উচ্চতর সামরিক সক্ষমতার মধ্যে মেলে কিন্তু এর অন্য আরেকটি বড় দিকও রয়েছে। যেখানে ভারতীয় একজন রাজন্যের অধীনে থাকা সৈন্যদের প্রায় ছয় মাসের বেতন বকেয়া থাকত, সেখানে কোম্পানির সেনারা যুদ্ধের ময়দানে নামলেই পেত বেতনের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যেখানেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যুদ্ধ করতে গেছে, সেখানেই কোনো ব্যতিক্রম ছাড়াই ঘটনাস্থলে স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে স্থানীয় বেনিয়া শ্রেণিকে তারা পক্ষে পেয়েছে। ১৭৫৭ সালের আগে থেকেই এরা কোম্পানির বাণিজ্যকেন্দ্রের সঙ্গে নিবিড় ব্যবসায়িক সম্পর্কের মধ্যে ঢুকেছে। সামাজিক সংগ্রামের বেলায় জাতিগত ভিন্নতা ছাপিয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক প্রয়োজন। সামন্ততান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থানীয় বেনিয়া শ্রেণির কাছে ঠিক ততটাই গৌণ ছিল, যতটা ছিল ভিনদেশি বুর্জোয়া ব্যবসায়ীদের জন্যও।
স্থানীয় বেনিয়া শ্রেণির মধ্যে ইংরেজ হানাদাররা খুঁজে পেল তাদের সহজাত মিত্র। এদের সঙ্গে নিয়ে তারা দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলল। কিন্তু তখনো স্থানীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির গতানুগতিক বিকাশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গড়ে তোলা কাঠামোর কোনো চাহিদাই মেটাতে পারত না বলে একটা পর্যায়ে শ্রেণিটিকে তারা তৈরি করে নেয়। সে সময় ইংরেজরা ভারতবর্ষে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত, তা ছিল আকারের দিক থেকে একেবারেই সীমিত। তাদের মূল দৃষ্টি ছিল রাজনৈতিক কাঠামোর দিকে। রাজনৈতিক কাঠামোর চাহিদাতেই মিত্রের দরকার হয় তাদের। আসলে যে শক্তি ব্রিটিশকে ক্ষমতা দখলে মদদ জুগিয়েছিল, সেই সামাজিক শক্তিকে বিকশিত হতে দিলে নিশ্চিতভাবেই স্থানীয় বুর্জোয়াদের উত্থান ঘটত। এবং সেই শ্রেণি হয়তো শেষ পর্যন্ত ভারতে ইংরেজ বেনিয়া বুর্জোয়াদের জায়গা নিয়ে নিত, অর্থাৎ তাদের প্রতিস্থাপন করত। এমন আত্মবিনাশী ভূমিকা ইংরেজরা নেবে, সে আশা অবাস্তব। দেশের রাজনৈতিক শাসক হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তার বেনিয়া চরিত্র ঢেকে ফেলতে শুরু করলে রাজনৈতিক কাঠামোর গুরুত্ব আরও বাড়ে। অবশ্য এই সব সম্পর্ককে বিশেষ দিকে চালিত করার মতো কোনো নীলনকশা তাদের ছিল না। তবে স্থানীয় বেনিয়াদের সঙ্গে সম্পর্কের আদল থেকেই এই সম্পর্কের রাজনৈতিক চরিত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। শিক্ষাদানের ব্যাপারে—ইংরেজি ভাষার শিক্ষা—কোম্পানির অবদান মোটামুটি। তবে তা করা হয়েছিল ইতিমধ্যে খানিকটা ইংরেজি জানা স্থানীয় নাগরিকের চাহিদা মেটাতে। আদতে অল্প কিছু মানুষকে ইংরেজিতে শিক্ষা দিতে গিয়ে গণশিক্ষাকে অবহেলা করা মোটেই দুর্ঘটনা বলা যাবে না।২
শুধু উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিতরাই প্রশাসনযন্ত্রের চাহিদা মেটাতে সক্ষম বলেই খরুচে হওয়া সত্ত্বেও মানুষ ‘উচ্চ’ শিক্ষার পেছনে ছোটা বন্ধ করেনি। রেললাইন বসানোর প্রস্তাব যখন প্রথম উঠল—এটি অর্থনৈতিক উদ্যোগই ছিল—তখনো কিন্তু বিশুদ্ধ অর্থনৈতিক বিবেচনার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে কৌশলগত বিবেচনা।৩ নিঃসন্দেহে রেললাইন ভারতবর্ষের বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে বিশ্ববাজারের প্রভাবের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে। তাহলেও বাস্তবে একে দেখা হয়েছে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ভারতবর্ষে আইনকানুন বজায় রাখার সহজ উপায় হিসেবে। আইনকানুন বজায় রাখার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য থাকতে পারে, হতে পারে তা অর্থনৈতিক বা অন্য কিছু। তবে ভারতবর্ষের আমলাদের চোখে, প্রশাসনযন্ত্রের কাছে এটা ছিল স্বতঃসিদ্ধ একটা বিষয়। বাস্তবে অন্তত তিনটি আলাদা গোষ্ঠী তিনটি আলাদা কারণে রেলপথের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। প্রথম দলটি ছিল বিনিয়োগকারীরা—এদের সবাই ছিল ইংরেজ। এদের মূল উৎসাহ ছিল অর্থনৈতিক ফায়দা তোলা (লন্ডন ‘নগরী’র স্বার্থের সঙ্গে এদের এক করে দেখা যেতে পারে)। ভারতবর্ষের রপ্তানিকারকেরা ছিল দ্বিতীয় দল। এদের মূল আগ্রহ ছিল ভূখণ্ডের আনাচ-কানাচ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে বিদেশে রপ্তানি করা, কেননা এটাই ছিল ভারতবর্ষের বৈদেশিক বাণিজ্যের মূল খোরাক। কার্যত কলকাতা ও বম্বে শহরের আড়তগুলোর ব্যবস্থাপনা সংস্থাগুলো রপ্তানিকারকদের পুরো দলটিকে কাছে টেনে নিয়েছিল। অবশ্য উভয় পক্ষই ব্রিটিশ হলেও তাদের স্বার্থ মোটেও এক ছিল না। নিঃসন্দেহে, তৃতীয় দলটি ছিল ভারতবর্ষের আমলাতান্ত্রিক সরকার। তাত্ত্বিকভাবে, ভারত সরকার ব্রিটিশ সরকারের অধীন শাখা হওয়া সত্ত্বেও আমলাতন্ত্র আগাগোড়া তৃতীয় একটা পক্ষ হিসেবে কাজ করে গেছে, যদিও এর কাজ ছিল প্রথম দুই পক্ষের ফারাক কমিয়ে আনা। ভারত সরকারের এমন এক নীতি ছিল যে তারা একবার এই গোষ্ঠীকে আরেকবার ওই গোষ্ঠীকে সমর্থন করত। তবে সরকারের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। কিন্তু রেললাইন বসানোর অগ্রগতি ও অন্য কিছু উপাদান ভারতে নিত্যদিন অনেক মানুষের মিছিল বয়ে আনল। রেলব্যবস্থায় কাজ করার চেয়ে এদের মূল নজর সেই ভিত্তিকাঠামোর দিকে, যার ওপর ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল। অথচ রেললাইন এবং সমজাতীয় অন্যান্য কর্মকাণ্ডের ফল দৃশ্যমান হতে তখনো অনেক দেরি। তাহলেও ইঙ্গ-ভারতীয় সম্পর্কের বদল শুধু এসবের মধ্য দিয়েই সম্ভব হতে পারত।৪ ইতিমধ্যে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কাঠামোর প্রভাবে ভারতের রাজনৈতিক চেতনার সূচনা চোখে পড়ার মতো অনেক উপাদান সামনে চলে আসে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চেতনা ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ব্যবসা ও শিল্পে উৎসাহী স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণির বুর্জোয়াদের যতো না অবদান, তার চাইতে অনেক বেশি অবদান ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর। গোষ্ঠীটি ইংরেজি শিক্ষাকে ভারতের আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে কাজে লাগিয়েছিল।
এই শ্রেণির উৎপত্তির ধরন যাচাই করলে এদের শক্তি ও দুর্বলতা এবং এদের মাধ্যমে শুরু হওয়া আন্দোলনগুলোকে বোঝা যেতে পারে। সে যুগের সমকালীন ইংরেজদের রাজনৈতিক ও অন্য সব চিন্তাভাবনার সঙ্গে এদের পরিচয় ছিল বটে, কিন্তু সেসব চিন্তাপদ্ধতির সঙ্গে এদের কোনো পদ্ধতিগত সম্পর্ক ছিল না। এঁদের জানাশোনা ছিল পরের মুখে ঝাল খাওয়ার মতো। আসল জিনিস নয়, এঁরা পেতেন মূলের প্রতিফলন। একেবারে খাঁটি সত্য কথাটি বলবার সময়ও কিন্তু এঁদের মধ্যে নিষ্ঠার অভাব দেখা গেছে, কারণ সে সত্যের শিকড় তো তাঁদের অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল না। শোনা যায়, রাজা রামমোহন রায় ইউরোপের জুলাই বিপ্লবের (১৮৪৮ সালের দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব-সম্পাদক) উদযাপন করেছিলেন কলকাতায় বসে, ওই বিপ্লবের সম্মানে বাংলার গভর্নর জেনারেলের দেওয়া ডিনারের দাওয়াতে গিয়ে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্ত একজন প্রজার এভাবে ইউরোপের বিপ্লব উদ্যাপন করাকে ‘লোকদেখানো’ এবং বেমানান বলেই মনে হয়। মূলত ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষা দেওয়ার খরুচে যে প্রকল্পের মাধ্যমে মধ্যবিত্ত তৈরি করা হলো, ভৌগোলিকভাবে তার সুযোগ যেভাবে বণ্টিত হলো, তাতে করে এ ধরনের শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ মোটামুটি সংকুচিতই হয়ে গেল। ইংরেজি শিক্ষা হয়ে উঠেছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশের পূর্বশর্ত। কাজে কাজেই তা সবার জন্য অবারিত ছিল না। শিক্ষার বিষয়বস্তু যা ছিল তা এই সংখ্যালঘু শ্রেণিটির সঙ্গে বিশালসংখ্যক সাধারণ মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলায় কোনো কাজে আসেনি। সমকালীন ইউরোপীয় চিন্তার ছায়ায় এঁরা বিকশিত হতে থাকলেন। একই সঙ্গে আপন পরিপার্শ্বের মধ্যে হয়ে গেলেন পরদেশির মতো। এই পরদেশি চরিত্র তখনই ঢাকা পড়ল যখন দীর্ঘমেয়াদি বস্তুগত পরিবর্তনের ফলে সামাজিক অর্থনীতির মধ্যে এঁরা একটা ভিত্তি পেয়ে গেলেন। তবে ওই সব সীমাবদ্ধতার জন্য এই শ্রেণি যেভাবেই ভুগে থাকুক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চৈতন্যের জাগরণ আনা (অর্থাৎ, দেশের রাজনৈতিক কাঠামো বদলানোর সচেতন দাবি) এবং রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করার কৃতিত্বটি এই শ্রেণিরই। রাজনৈতিকভাবে সচেতন অংশের দাবির পেছনে অন্যান্য উপাদানের কতটা সে প্রশ্ন অবশ্য আরও জটিল।
আঠারো শতকের শেষ দশকে ভারতের ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালের সপ্তম প্রবিধান আইন জারি করে। বাংলার ভূমি রাজস্ব আদায়ের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই আইন দিয়ে কখনো কখনো ওই সময়ের ব্রিটিশ সরকারের চরিত্র ব্যাখ্যা করতে দেখা যায়। এই আইনে জমিদারদের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল বলে তখনকার সরকার ‘সামন্তবাদী শ্রেণি’র প্রতি পক্ষপাতী বলে যুক্তি দেওয়া হয়। বলা হয়, যেহেতু তারা তখনো প্রস্তুত অবস্থায় ছিল না; তাই সরকার শ্রেণিটিকে তৈরি করে নিয়েছে। এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যের কিছু উপাদান থাকলেও, কোম্পানি শাসনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মালমসলা জোগানো কিন্তু এই আইনের আসল উদ্দেশ্য ছিল না। মূলত কমতে থাকা ভূমি রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কারণ ভূমি রাজস্বই ছিল কোম্পানির আঞ্চলিক আয়ের প্রধান উৎস। তা হলেও এই আইনের ফলে যে সামন্ত অভিজাততন্ত্র গড়ে ওঠে, তারা ইংল্যান্ডের অভিজাতদের চেয়ে অনেক আলাদা। এই যুগে কোম্পানি প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কারবারের জন্য ভূস্বামীদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি নির্ভরশীল ছিল ভাসা-ভাসা ইংরেজি জানা উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর। ব্যবসায়িকই হোক বা প্রশাসনিকই হোক, কোম্পানির বিভিন্ন রকম দপ্তরে কাজ করতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুরুষেরা, জমিদারের বংশধরেরা না। বাস্তবতা হলো, এই নতুন লোকেরা কোম্পানির দপ্তরের বরাতে সহজেই বনেদি জমিদার শ্রেণিতে উত্তরিত হতে পারত।৫ জমিদার শ্রেণির সদস্য হওয়ার আগে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের একজন লবণের দেওয়ান। এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন মাসে ৫০ রুপি মাইনা পাওয়া পাতিবাবু। উল্লাপাড়ার রাজ পরিবারের পত্তনকারীরা ছিলেন ৫০ রুপিরও কম বেতন পাওয়া লোক। কোম্পানির নথিপত্রে এমন কারো নাম পাওয়া যায় নি যিনি ১৭৯৩ সালের আগে থেকেই জমিদার ছিলেন আবার কোম্পানির আশির্বাদও পেয়েছিলেন। কোম্পানি যেমন বেসামরিক প্রশাসনে জমিদারদের প্রতি পক্ষপাত দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি সামরিক প্রশাসনে নিয়োগের বেলায়ও তাদের দিকে তাকায়নি। কোম্পানির দেশিয় সেনাবাহিনী ছিল বিশাল প্রতিষ্ঠান, তবু সেখানে বনেদি পরিবারের সন্তানদের কোনো জায়গা হয়নি। কোনো শ্রেণিকে লালন-পালন করার প্রমাণ যদি কোম্পানির থেকে থাকে, সেটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি; যারা ইংরেজি শিক্ষা চালু করার প্রচেষ্টাকে ভেবেচিন্তে আলিঙ্গন করেছিল ।
বাংলার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দ্যেশ্য যাই থাকুক, এর ফলে এমন এক সময়ে এক ধরনের জমিদার শ্রেণি তৈরি হলো যখন কোম্পানি আরো বেশি বেশি করে পাতি ব্যক্তিদের দিকে ঝুঁকছে। যথাযথ ও সোজা-সাপটাভাবে কোম্পানির ‘নীতি’ ব্যাখ্যা করার অসুবিধা হলো, একই সঙ্গে ভারতে দখলদারি পরিচালনা ও একে লাভজনক রাখার এই জটিল উদ্যোগ চালাতে গিয়ে একই সময়ে তাদের পরস্পরবিরোধী নীতিকৌশল নিতে হয়েছিল। এর ফলে যে চিত্র তৈরি হলো তার মধ্যে স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর পটভূমি গড়ে উঠেছিল এমন সব শক্তির কার্যক্রমে যাদের অভিমুখ ও তাল-লয় এক ছিল না। জমিদার শ্রেণি তৈরি চলতে থাকার পাশাপাশি আরো গভীর ও ধারাবাহিক পদক্ষেপে চলতে থাকলো মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরির কাজ। পাশাপাশি চলতে থাকলো জমিদারি তালুকের ধারণা—সরকারকে কমবেশি সামান্য কিছু খাজনা দেওয়ার মাধ্যমে—এবং জমিদারি হাতবদল সহজ করার আইন ও বিধিমালা। এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধীরে ধীরে জমিদারি সম্পত্তির মালিকানায় ঢুকতে থাকলো। অন্যভাবে বললে, জমিদারদের সঙ্গে অন্যসব শ্রেণির মধ্যকার বিভাজন রেখাটি ধীরে ধীরে তবে কার্যকরভাবে মুছে যেতে গেলো। যে মানুষটি ছিলেন জমিদার, তিনিই আবার পেশাজীবী ও ব্যাংকার, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভারতে তাদের ঋণদাতা মহাজনই বলতো। এ হেন বহুবিধ সামর্থ্যের মানুষদের হাতে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিসীমা স্বাভাবিকভাবে অস্পষ্টই হয়।
সামাজিক অর্থনীতির প্রভাবক উপাদানগুলির থেকে ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলি আলাদা হলেও, ওই উপাদানগুলিই ছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির গড়ে তোলা রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি। ইংরেজি শিক্ষায় প্রবেশাধিকার পাওয়া এই শ্রেণিটির সামাজিক সম্পর্কের ধরন এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ যে এটাই তাদের সমাজতাত্ত্বিক তাৎপর্য ঠিক করে দেয়। এই শ্রেণির সদস্যরা যে পরিবেশে বাস করতো এবং প্রাত্যহিক জীবন চালাতো সেটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই শ্রেণির রাজনৈতিক ভূমিকা যাচাই করতে গিয়ে এদের শিক্ষার বিষয়বস্তুর দিকেও নজর দেওয়া দরকার। ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষার জন্য আন্দোলনের ইতিবৃত্ত বিভিন্ন প্রকাশনায় দেখানো হয়েছে। মামুলি বা মহান, সরকারি বা বেসরকারি, মিশনারি বা সাধারণ, ভারতীয় বা ইউরোপীয়—সবার নাম এখন ভালোই জানা হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে কী শেখানো হতো এবং এই নয়া শিক্ষা রাজনৈতিক বিকাশের, বিশেষ করে রাজনৈতিক আন্দোলনে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছিল, সে বিষয়ে লেখালেখি কিন্তু তুলনায় কমই হয়েছে।
বিকাশের পথে এই শিক্ষার বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিচারের আগে মনে রাখা দরকার, ১৮ শতকের তৃতীয় ভাগে কোম্পানিশাসিত ভারতবর্ষে সামাজিক অবস্থান উন্নত করার সব পথই ছিল কোম্পানির প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল। বড় বড় ব্যবসায়ী ও কারবারিা কিন্তু ভারতীয় সমাজে প্রতাপশালী গোষ্ঠী ছিলেন না। এমনকি ভূস্বামী শ্রেণিও নয়। কেননা সামন্ত অভিজাত শ্রেণিতে প্রবেশাধিকার পেতে হলে কোম্পানির প্রভাবশালী কর্মচারিদের সঙ্গে খাতির থাকতে হতো। কোম্পানির বাড়তে থাকা ভারতীয় কর্মচারী শ্রেণিগুলিই ছিল ভারতীয় সমাজের ‘স্বাভাবিক’ নেতা। এরা যে কোম্পানিতে ছোট চাকুরি করতো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও ভারতীয়দের মধ্যে শ্রেণি হিসেবে এরাই ছিল সবচাইতে ক্ষমতাধর আর বিত্তবান। এদের নিয়োগের নীতি ও পদ্ধতি এবং শিক্ষা পাওয়ার ধরন ও বিষয়সূচিই আসন্ন মধ্যবিত্তের বৃদ্ধিবৃত্তিক জলবায়ু ঠিক করে দিয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতীয়দের মধ্যে থেকে নিযুক্ত বড় পদধারীরা অধিকাংশই ছিলেন আইনি কর্মকর্তা, কাজি আর পন্ডিত। এরা ইয়োরোপীয় বিচারকদের সহকারি হিসেবে তাদের কাছে হিন্দু ও মুসলিম আইন ব্যাখ্যা করতেন। কলকাতার মুসলিম কলেজ আর বেনারসের হিন্দু কলেজ তো বানানোই হয়েছিল কোম্পানিকে হিন্দু ও মুসলিম আইন জানা কর্মচারির যোগান দিতে।৬ হিন্দু ও মুসলিম আইন ছাড়াও রাজস্ব প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা যখন আরো বড় আকারে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল, তখন ওইসব আইনে প্রশিক্ষিত কর্মচারির চাহিদাও কমে আসতে শুরু করল। ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা—এটা থাকলে দৈনন্দিন কাজকর্ম ও ইয়োরোপিয় বড় কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগে সুবিধা হয়—ছোটখাটো কিন্তু লোভনীয় চাকুরির যোগ্যতা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। এই সন্ধিক্ষণে, ১৭৯৩ সালের দিকে মিশনারিরা ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের নতুন একটা কারণ যোগ করলো। ১৮৬৪ সালে সরকারি চাকুরির বেলায় ইংরেজি বিদ্যা একমাত্র যোগ্যতা বলে গণ্য হওয়ার আগে কলকাতার মুসলিম কলেজ এবং বেনারসের হিন্দু কলেজ থেকে যেসব শিক্ষিত মানুষজন সরকারি চাকুরি করতে পারত, তাদের সংখ্যা ১৮৩১ সাল থেকে লক্ষণীয়ভাবে কমে আসছিল। এসব প্রতিষ্ঠানে তারা আসলে কী কী বিষয়ে শিক্ষা পেত?
মেকলে’র [(মেকলে, টমাস বেবিংটন (১৮০০-১৮৫৯) ব্রিটিশ অভিজাত, রাজনীতিবিদ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সরকারের শিক্ষানীতি প্রণয়নে তাঁর ভূমিকা ব্যাপক। ভারতীয় দণ্ডবিধি প্রণয়নেরও রূপকার তিনি। ১৮২০-এর দশক ও তার পরে কোম্পানি সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে শিক্ষানীতি নিয়ে বিতর্ক চলে। সেই বিতর্কের বিবরণীই মেকলে মিনিট’স বলে খ্যাত-সম্পাদক)] বহুল উদ্ধৃত সেই অনুচ্ছেদ দেখায়, ভবিষ্যতের কর্মচারী তৈরির জন্য কোম্পানি যে শিক্ষার পেছনে টাকা ঢেলেছে, সময়ের প্রয়োজনের কাছে তা কতটা অকিঞ্চিৎকর। হিন্দু আর মুসলিম আইন শেখানোর যে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হয়েছিল, বাস্তবে সম্পূর্ণ আলাদা আরেক গুচ্ছ আইন পরে এদের জায়গা নিয়ে নেয়।৭ নতুন এসব আইন ব্যাখ্যার জন্য এমন লোকের দরকার ছিল, যাদের ইংরেজি ভাষাজ্ঞান হতে হবে মুসলিম বা হিন্দু আইনে পাণ্ডিত্যের চেয়ে আরও মানসম্পন্ন ও সারবান। হিন্দু ও মুসলিম আইনের সব খুঁটিনাটি জানা লোকদের সামাজিক বিলুপ্তি তখন অনিবার্য হয়ে উঠল। এরা আর ভারতবর্ষের উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশ হয়ে উঠতে পারল না। ইংরেজি জ্ঞান রাতারাতি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পাসপোর্ট হয়ে উঠলে পরে এই মানুষগুলো মুশকিলে পড়ে গেল। ভাবনাচিন্তা ছাড়াই তাঁরা বুঝে গেলেন, এই শিক্ষা শুধু তাঁদেরই নয়, তাঁদের সন্তানদের জন্যও ভালো নয়। প্রাচ্যবাদী বনাম প্রতীচ্যবাদীদের মধ্যে বিতর্ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আগেই প্রাচ্যীয় ভাষায় শিক্ষাদান সে সময়কার সমাজের চাহিদার কাছে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। বাংলা সরকারের ‘দ্বৈততা’র কথা মুর্শিদাবাদের লোকজন বিশ্বাসই করত না। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত পদ তখন দখল করে রেখেছিল ইংরেজরা, প্রাচ্যের কোনো ভাষার ওপর তাদের কোনো দখলই ছিল না।
নিচু পদের যেসব কর্মচারী খাজনা আদায় বা বিচারিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের সংস্পর্শে আসতেন, তাঁদেরও প্রাচ্যের ভাষা শেখার কোনো জরুরত দেখা দেয়নি। তত দিনে ইংরেজি শিক্ষায় পৃষ্ঠপোষকতার পক্ষে মিশনারিদের খোলাখুলি প্রচারের বয়সও অনেক হয়ে গেছে।
ইংরেজি ভাষার পক্ষে মিশনারিদের সংগঠিত প্রচারকাজ শুরু হয় ১৭৯৩ সালে তাদের আগমনের সময় থেকেই। তবে তারও অনেক আগে থেকেই, অন্তত কলকাতায় ইংরেজি শেখানো ও পড়ানো চলে আসছিল। কলকাতাসহ ভারতের অন্যান্য বন্দরনগরীতে কিন্তু আগে থেকেই ইংরেজি জানা মানুষ ছিলেন। তাঁরা ইংরেজ বণিক ও দেশীয় ব্যবসায়ী শ্রেণির ভেতর মধ্যস্থতা করার মতো যথেষ্ট ভালো ইংরেজি জানতেন। ১৭৫৭ সাল থেকেই ইংরেজি জ্ঞানের বাণিজ্যিক মূল্য হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করে। ১৭৫৭ থেকে ১৮১৬ সালের মধ্যে কলকাতা শহরে শুধু ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার জন্য অনেকগুলো স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।৮ ১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্টের মাধ্যমে দরকারি জ্ঞানের শিক্ষা দেওয়ার দায়ভার যখন কোম্পানির ওপর বর্তাল, তখন ইংরেজি ভাষার জ্ঞানের বিস্তর চাহিদা ছিল।৯ কোম্পানির যেসব কর্মচারী প্রাচ্যবাদী চিন্তাধারার পক্ষে ছিলেন, তাঁরা ইংরেজিতে নির্দেশনাদানের ব্যপারটা ভালোভাবে নেননি। সে কারণেই, ইংরেজিতে শিক্ষা দেওয়ার প্রাথমিক দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল দুটি দলের ওপর। অবশ্য লর্ড বেন্টিংকের আমলে কোম্পানির প্রাচ্যবাদী কর্মচারী দলটি পুরোপুরি হার মানতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থাৎ, ১৭৯৩ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত, ইংরেজিতে শিক্ষাদানের বিষয়বস্তু কী হবে, তা নির্ধারণ কোম্পানি করেনি, করেছে কিছু বেসরকারি ব্যক্তি। ১৭৯৩ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত সময়টাকে আবার দুই ভাগ করা যায়, ক) ১৭৯৩-১৮১৪ এবং খ) ১৮১৪-৩৩। প্রথম পর্যায়ে শুধু মিশনারিরাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে ইংরেজি শেখানোতে নিয়োজিত ছিল। আদতে, প্রথম ক্ষেত্রে ইংরেজি জ্ঞান ব্যবহার করা হয়েছিল মূলত হিন্দুদের খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার সুবিধার জন্য।১০ এটাই মূল কারণ যে জন্য কোম্পানির দেশীয় কর্মচারীরা এ ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। আঠারো শতকের শেষ দিকে কোম্পানির মুখ্য কর্মচারীদের জীবনাচরণে খ্রিষ্টীয় বৈশিষ্ট্য আলাদা করে দেখা যেত না। মাঠপর্যায়ের অধিকর্তারাও আসলেই বিশ্বাস করতেন, ধর্মান্তরকরণে কোম্পানির অতি উৎসাহ ইতিমধ্যে গড়ে তোলা রাজনৈতিক কাঠামোকে গুরুতরভাবে বিপদে ফেলবে। ইংরেজি ভাষার জ্ঞান শুধু একটা লক্ষ্য সাধনেরই উপায় ছিল—একটা মাত্রা পর্যন্ত জনগণের নৈতিক উজ্জীবনের মাধ্যমে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার পথ সুগম করা। মূলত ইংরেজির সহায়তায় অথবা ইংরেজির মাধ্যমে দেওয়া শিক্ষার বিষয়বস্তু এই মূল গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যের সঙ্গে জড়িত ছিল। ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার প্রথম সচেতন উদ্যোগ তাই মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিল।
দ্বিতীয় পর্বের শুরু ১৮১৪ সালে, যে বছর রামমোহন রায় কলকাতায় স্থায়ী হলেন। এ বছরকে ইংরেজি ভাষার প্রতি কলকাতা শহরের স্থানীয়দের মধ্যকার ক্ষুদ্র অথচ ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সমর্থনের বছর হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। মিশনারিদের পাশাপাশি রামমোহন রায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই দলটি ইংরেজির মাধ্যমে শিক্ষার প্রশ্নটিকে জোরালোভাবে সামনে নিয়ে এল। ১৮১৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট আইনে স্থানীয় জনগণের শিক্ষার জন্য বার্ষিক এক লাখ রুপি খরচ করা নিয়ে বিতর্ক চলল। যদিও রামমোহনের অনুসারী ও মিশনারি দুই দলই ইংরেজি শিক্ষাকে লক্ষ্য হিসেবে নিলেও তাঁদের কাঙ্ক্ষিত পদ্ধতি ছিল আলাদা। মিশনারিরা সীমাহীন উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা নিয়ে যে লক্ষ্যে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে তদবির করে গিয়েছিল, তার ফল হলো বিপরীত। সংস্কারের জন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আন্দোলন ছিল মিশনারিদের ধর্মান্তর করার বাড়াবাড়ির মোক্ষম জবাব। অবশ্য সমাজের দীর্ঘমেয়াদি বিকাশের বৃহত্তর প্রশ্নটি বিবেচনায় নিলে এর বেশ একটা দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি দেখা যায়। ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন আগাগোড়া ধর্মনিরপেক্ষ প্রশ্ন না থেকে তা কার্যত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ভেতরে ধর্মচেতনা পুনরুজ্জীবিত করায় ব্যবহৃত হলো। শতাব্দীর একেবারে শেষভাগেও তা ফুরিয়ে গেল না। রামমোহন রায় ইংরেজি শিক্ষা চালু করার পুরোধা হিসেবে ক্রমবর্ধমান (শিক্ষিত) স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতে ইউরোপীয় জ্ঞান ও চিন্তার চাহিদা মেটানোর দরকারি সংযোগ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্মজীবনের পুরোটা সময় তিনি ধর্মের পেছনেই ব্যয় করলেন। এটা যে শুধু রামমোহন রায়ের বেলাতেই হয়েছে তা কিন্তু নয়। চার্লস গ্রান্ট* (*গ্রান্ট ছিলেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান। তিনি ভারতে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে ধর্মান্তর ও সমাজসংস্কারের ব্যাপারে মিশনারিদের পক্ষে ছিলেন-সম্পাদক) ও মিশনারিরা ইংরেজি শিক্ষাকে ধর্মান্তরের বাহন মনে করলেও এটা ঘটাল হিন্দুত্ববাদ সংস্কার। ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভের শুরু থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগ পর্যন্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে মেধাবী মানুষেরা কেবল ধর্মীয় প্রশ্ন নিয়েই মেতে থাকলেন।
ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা ছিল ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা। বহুদিন ধরে এই একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সব গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী জোগানো হয়েছে, অন্ততপক্ষে ইংরেজি পড়ুয়াদের অনেকেই এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের তালিকা দেখলে মনে হবে এটি যেন এই কলেজের ছাত্রদেরই তালিকা। কলেজটির প্রতিষ্ঠার হেতু ও ধরন দেখায় যে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তন বলতে আমরা যা বুঝি, তা আসলে মিশনারিদের ধর্মান্তরিত করার বাসনার সঙ্গেই জড়িত। ১৮১৫ সালে এ দেশেরই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি (রামমোহন রায়) বাড়িতে কয়েকজন বন্ধুকে দাওয়াত করেছিলেন। সেখানে আলাপের মধ্যে দেশের মানুষের নৈতিক অবস্থার উন্নতির সেরা উপায়টি কী হতে পারে, তা উঠে আসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রামমোহন রায় বেদান্ত পদ্ধতি অনুসারে ধর্মীয় মতবাদ শিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি কিছুটা সংশোধন করে হেয়ার সাহেব* (*ডেভিড হেয়ার (১৭৭৫–১৮৪২) ছিলেন একজন স্কটিশ ঘড়ি নির্মাতা ও ব্যবসায়ী। তিনি কলকাতার অনেক বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন-সম্পাদক) একটা কলেজ প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন।১১ অর্থাৎ হিন্দু কলেজ ছিল ব্রাহ্মসভারই একটি বিকল্প। মূলত মিশনারিদের ধর্মান্তর করানোর জোশের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার পদক্ষেপ নেওয়ার দরকারেই এটা গড়ে ওঠে। ‘এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য হলো সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের সন্তানদের ইংরেজি ও ভারতীয় ভাষায় শিক্ষিত করে ইউরোপ ও এশিয়ার সাহিত্য ও বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞানদান করা।’১২ কলেজটির জন্ম হয়েছে ‘স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নৈতিক উন্নতি সাধনের’ আকাঙ্ক্ষা থেকে। অথচ এত আগেও কিন্তু ‘স্থানীয়’ বলতে হিন্দু ছাড়া আর কাউকে বোঝানো হয়েছে বলে দেখা যায় না। রাজনীতির মাঠে হিন্দু ও মুসলমানদের একত্রে কাজ না করার যে ব্যর্থতা, হন্যে হয়ে তার ব্যাখ্যামূলক নীতি খুঁজত খুঁজতে এ ও হিউম ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ (ভাগ করো শাসন করো) নীতি আবিষ্কার করলেন। অথচ এর দরকার হতো না যদি তিনি শিক্ষিত ভারতীয়দের মনের দিকে তাকাতেন। কোনো রকম সরকারি প্রচেষ্টা ছাড়াই এরা হিন্দু ও মুসলিম পরিচয়ের আলাদা খুপরিতে নিজেদের আটকে ফেলেছিল।১৩ ওই শতাব্দীর প্রথম দিকে, ধর্মীয় ভিত্তিতে জনগণকে বিভক্ত করার প্রবণতা স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু পুরো শতকজুড়ে যেভাবে এই প্রবণতার বিস্তার ও আধিপত্য ঘটেছে, তার পরিণাম ছিল ভয়ানক।
ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে, একাধিক ধর্মের অনুসারী থাকা আরও সর্বনাশা জটিলতার পূর্বলক্ষণ হয়ে ওঠে। মিশনারিদের প্রথম অভিযানের অভিঘাত এমন সংস্কারকদের তৈরি করেছে, যাঁরা ব্রাহ্মসমাজ ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু পরে এটি তৈরি করল ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদীদের, হিন্দুধর্মের আরও বেশি গোঁড়া রক্ষকদের। কিন্তু সংস্কার বা পুনরুত্থান, পরিণতি যা–ই হোক না কেন, সন্দেহাতীতভাবে ওই যুগের মূল আগ্রহ—চিন্তার সারবস্তু—ছিল ধর্ম। ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে হিন্দু সংস্কার বা পুনরুত্থানবাদই হোক অথবা মুসলমান সংস্কার বা পুনরুত্থানবাদই হোক, সম্প্রদায়গত ছাড়া তা আর কিছু হতে পারত না।
সমাজ যদি এই দুইয়ের কোনো একটি ধর্মের অনুসারীদের নিয়েও গঠিত হতো; তাহলেও হয়তো এই ধর্মীয় প্রবণতা সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশের দিকে যেত। কিন্তু ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে, একাধিক ধর্মের অনুসারী থাকা আরও সর্বনাশা জটিলতার পূর্বলক্ষণ হয়ে ওঠে। মিশনারিদের প্রথম অভিযানের অভিঘাত এমন সংস্কারকদের তৈরি করেছে, যাঁরা ব্রাহ্মসমাজ ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু পরে এটি তৈরি করল ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদীদের, হিন্দুধর্মের আরও বেশি গোঁড়া রক্ষকদের। কিন্তু সংস্কার বা পুনরুত্থান, পরিণতি যা–ই হোক না কেন, সন্দেহাতীতভাবে ওই যুগের মূল আগ্রহ—চিন্তার সারবস্তু—ছিল ধর্ম। ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে হিন্দু সংস্কার বা পুনরুত্থানবাদই হোক অথবা মুসলমান সংস্কার বা পুনরুত্থানবাদই হোক, সম্প্রদায়গত ছাড়া তা আর কিছু হতে পারত না। হিন্দু সংস্কার ও পুনরুত্থানবাদের পক্ষে মুসলমান সংস্কার ও পুনরুত্থানবাদের সমান্তরালে চলা খুবই সম্ভব ছিল। প্রকৃতপক্ষে, উনিশ শতকের প্রায় পুরোটাজুড়েই তারা কেউ কারও পা না মাড়িয়ে সমান্তরাল পথে চলেছে। ভারতে মুসলমান সংস্কার ও পুনরুত্থানবাদ তাদের হিন্দু প্রতিপক্ষের চেয়ে সামান্য কিছুটা পুরোনো। খ্রিষ্টান মিশনারিদের আক্রমণের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে মিশনারিরা তাদের মহান ব্রত নিয়ে নেমে পড়ার আগেই সংস্কার পূর্ণ বিকশিত আন্দোলনের চেহারা নিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ, এই পুরো সময়জুড়ে ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম নিজেদের আবিষ্কার করে যাচ্ছিল—দুই ধর্মের খাঁটি অনুসারীরা নিজেদের হৃদয় হাতড়ে যুগের জ্বলন্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতভেদ থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। মানুষ সত্যিই সত্যিই ‘গোঁড়া’ হয়ে গেলেও পাশাপাশি বসবাস করায় গুরুতর কোনো সমস্যা হয়নি। আসল সমস্যা শুরু হলো যখন পুনরুত্থানবাদের দশা নিস্তেজ হয়ে আরও সেক্যুলার মানসকাঠামোর জন্য জায়গা ছেড়ে দিল। এর কারণ হচ্ছে তত দিনে ধর্মীয় বিষয়–আশয় আর রোজকার আলোচনার বিষয় হিসেবে ছিল না, সেসব আলোচনার বিষয়বস্তু তত দিনে মোটামুটি মেনে নেওয়া হয়েছে এবং তা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এই শতকের প্রায় তিন-চতুর্থাংশজুড়ে তীব্র আলোচনার ফলে চিন্তার এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যা একান্তই পুরোপুরি হিন্দু নয়তো পুরোপুরি মুসলিম। যখন খাঁটি রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মসূচির নায়কেরা দৃশ্যপটে এলেন, তারা তখন একটিমাত্র ভিত্তি থেকেই নিলেন না—খ্রিষ্টধর্ম যেভাবে ইংরেজ চিন্তাধারার সাধারণ ভিত হিসেবে কাজ করেছে—তারা নিলেন দুর্ভাগ্যজনকভাবে পরস্পরবিচ্ছিন্ন দুটি ভিত্তি থেকে।
যদি হিন্দু সংস্কার বা পুনরুত্থানবাদ মুসলমানদের অনুরূপ ঘটনার চেয়ে আলাদা হতো, তাহলে ভারতের জন্য পরে তা আরও বড় মাপের সমস্যা সৃষ্টি করত। বাস্তবে এরা পরস্পরবিচ্ছিন্ন থাকার পাশাপাশি কখনো-সখনো সাংঘর্ষিকও ছিল বটে। মুসলিম সংস্কারবাদের অর্থ ছিল হিন্দু ধর্মের সংস্পর্শে যেসব চর্চা ও চিন্তার অভ্যাস ইসলামে ঢুকে গিয়েছিল, সেগুলো থেকে ধর্মকে মুক্ত করা।১৪ হিন্দু সংস্কারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল ধর্মান্তরিতদের আবার হিন্দু ধর্মের ছায়াতলে ফিরিয়ে আনার পথ ও পন্থা খুঁজে বের করা।১৫ এবং যদিও ধর্মান্তরকরণের মিশনারি জোশ ঠেকানোর লক্ষ্যেই হিন্দু সংস্কারবাদের জন্ম হয়েছিল, তবু উদ্দেশ্য পূরণের সোনালি পন্থা হিসেবে উভয়ই কিন্তু শিক্ষার ওপর ভরসা রেখেছিল। শিক্ষার (ইংরেজি) বিস্তারে আগ্রহী মিশনারিরা উভয় পক্ষের সঙ্গেই হাতে হাত রেখে কাজ করেছে। মাঠপর্যায়ে কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার আগপর্যন্ত শিক্ষা খাতে মিশনারিরাই ছিল মুখ্য চরিত্র।১৬ মিশনারিদের প্রভাবের চর্চা দেখা যায় অল্প কিছু মানুষের প্রচেষ্টার মধ্যে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কেরি, ওয়ার্ড ও মার্শম্যান। (উইলিয়াম) কেরি ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার অধ্যাপক। শতাব্দীর শুরুর দিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে তিনিই ছিলেন মূল ব্যক্তি। সেই শুরুর সময়ে, বাংলার একজন লেখকের পক্ষে আগাম গ্রাহক জোগাড় করা ছাড়া বই প্রকাশ করা অসম্ভবই ছিল। চর্চাটা ছিল এ রকম: সম্ভাব্য লেখককে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের যথাযথ অধ্যাপকের আগ্রহ জাগাতে হতো যেন তিনি প্রতিষ্ঠানটির কাছে বইটির শখানেক কপি কেনার সুপারিশ করেন।১৭ একসঙ্গে অনেকগুলো কপি কেনার প্রতিশ্রুতি প্রকাশনার ভাগ্য ঠিক করে দিত। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে বাংলায় ছাপা হওয়া বইগুলোকে মূলত ড. উইলিয়াম কেরির কাছে প্রকাশযোগ্য মনে হতে হতো। মার্শম্যান বাংলায় ও ইংরেজিতে প্রকাশিত অন্তত তিনটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবে তাঁর প্রভাব জাহির করতেন। তিনি সমাচার দর্পণ (বাংলায়), দ্য ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া (ইংরেজিতে) এবং পরে সরকারি গেজেটের সম্পাদক ছিলেন। বাংলা পত্রিকাটি সম্পাদনার সময় তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্বর, মেজাজ ও বিন্যাসের রূপদানকারী একদল লেখকের (ভারতীয়) সহায়তা পেয়েছিলেন। এটাই তাঁর আসল গুরুত্ব।১৮ অর্থাৎ, সূচনাকালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ওপর মূলত শ্রীরামপুরের মিশনারিদেরই দাপট ছিল। যে জনগণ আগেভাগেই গোষ্ঠীগতভাবে গঠিত হয়েছে, তারা মানুষকে মূলত হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টান পরিচয়েই চিনে আসছে, তাদের মধ্যে সম্প্রদায়গত মানসিকতা ছড়ানোয় এই মিশনারি গোষ্ঠীর অবদান কতটা? এই গোষ্ঠীরই মুখপাত্র সমাচার দর্পণ বাঙালিকে সুসভ্য করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছে, ‘যখন এটি (ফারসি ভাষা বিলোপ করার প্রবিধান) ঘোষিত হবে, প্রথমত ও প্রধানত ‘যবনদের’ (মুসলমানদের বর্ণনা করায় প্রবল রকম ঘৃণাসূচক একটি শব্দ, এটা অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ‘হুন’ শব্দ ব্যবহারের মতো) ঔদ্ধত্য কমিয়া আসিবে, যা আমাদিগের জন্য অনেক উপকারী হইবে। বাংলা ভাষা চালু হইলে পরে মুসলমানগণ বিতাড়িত হইবে কারণ তারা কস্মিনকালেও বাংলা পড়িতে বা লিখিতে পারিবে না।’১৯
শুরুর দিকে ভাষা ও সাহিত্যকে সাজিয়ে দেওয়ায় এই গোষ্ঠীর কাজ যতটা মূল্যবান, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেনেসাঁর সূচনা করায়। তাঁরা আদতে কী অর্জন করেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাঁদের কাজ অন্যদের যেভাবে অর্জনের পথ দেখিয়েছে সেখানে তাঁদের অবদান চিরস্থায়ী। ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশের সময় মিশনারিরা খুব দ্রুত মাঠ ছেড়ে চলে গেলেও তাঁরা যাঁদের কাজে নেমে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, সেসব মানুষই হয়ে উঠেছিলেন পরের প্রজন্মের দিশারি। তাঁদের এই ইতিহাস চলমান। এ সময়ের সাহিত্যের অন্তর্নিহিত মূল্য খুব কম, আর দেশীয় ভাষার সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব আরও কম। কিন্তু মিশনারিরা যে বিতর্ক উসকে দিয়েছিল; দুই সম্প্রদায়ই তাতে দারুণ উৎসাহী ছিল।
১৮৩২ সালের সংবাদমাধ্যমের কথা বলা মানে ধর্মীয় চিন্তার শাখা-প্রশাখা নিয়ে কথা বলা। চারটি অ-মিশনারিদের বাংলা পত্রিকাকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: ক) দ্য ব্রাহ্মনিক্যাল ম্যাগাজিন, ‘বিবেচনাহীন ক্রোধে ফেনিয়ে উঠছে…তার সহায় সম্পত্তিকে কোন অপ্রতিরোধ্য শত্রুর আকস্মিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য’; খ) চন্দ্রিকা, ‘মূর্তিপূজার বিশ্বস্ত ভক্তদের গোলিয়াথ’; গ) সংবাদ কৌমুদী: ‘এটা সেই হিন্দুদের স্বীকৃত অঙ্গ যারা আলোকিত ইউরোপীয়দের সঙ্গে নিত্যকার ওঠবসের কারণে মূর্তিপূজাকে আপাতদৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধা করেনি কিন্তু যাদের অনেকেই বাস্তবে এর আচার ও পালনে বাহ্যিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কমই দ্বিধা করত’; ঘ) দ্য ইনকোয়ারার ও জ্ঞান অন্বেষণ ছিল ‘শিক্ষিত হিন্দুদের ছোট একটি দল, যারা তত্ত্ব ও চর্চা, উভয় ক্ষেত্রেই হিন্দুধর্মের পুরো ব্যবস্থাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে।২০ দ্য ইনকোয়ারার ছিল ইংরেজি পত্রিকা, যেমনটা ছিল দ্য রিফর্মার, ‘দেশীয়দের পরিচালিত প্রথম ইংরেজি পত্রিকা’। অর্থাৎ সে সময় সংবাদমাধ্যম ধর্মীয় মতামতের বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত ছিল। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে সংবাদমাধ্যম তখন সেক্যুলার বিষয়ে আগ্রহী ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেক্যুলার মন, যতখানি দেখা দিত আরকি, আসলে ছিল মিশনারিদের প্রচারপত্র সমাচার দর্পণ–এর মতোই, আলাদা কিছু না। দ্য রিফর্মার লিখেছিল, ‘যে চেতনাগত ভিন্নতা গ্রেট ব্রিটেনের মুসলমান ও হিন্দু প্রজাদের পরিচালিত করে, তা থেকেই আমরা প্রথম পক্ষের আনুগত্যহীনতা ও দ্বিতীয় পক্ষের আনুগত্যের সুরাহা করতে পারি…সরকারকেও এ সকল ঘটনা থেকে শিখতে হবে যে যাদের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে তারা হলো মুসলমান প্রজা, যেহেতু এদের অধিকাংশই রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিদ্রোহের প্রতি ঝুঁকে আছে।’২১ বাংলা ভাষা চালু হলে মুসলমানরা বিতাড়িত হয়ে যাবে, সমাচার দর্পণ–এর এই যুক্তিটি সঠিক বলে এখানে ইঙ্গিত করা হচ্ছে না: মুসলমানরা বিতাড়িত হবে অন্য কিছু প্রবণতার জন্য। এটাও দাবি করা হচ্ছে না যে দ্য রিফর্মার-এর পরামর্শে সরকার কান দিয়েছিল। কিন্তু যারা পরে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা করেছিল, এসব থেকে সেসব বুদ্ধিজীবীর মন বোঝার উপযুক্ত সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। রাজনীতির মাঠে একটা টেবিলের চারপাশে বসে হিন্দু ও মুসলমান মিলে অভিন্ন কর্মসূচি ঠিক করতে না পারার অক্ষমতা মূলত শিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই ব্যর্থতা। একসঙ্গে বসতে না পারার ব্যর্থতা শুরুর দিকের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের ধরন ঠিক করে দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই ধারাই বহাল আছে।
বাংলা ভাষাকে আধুনিক ভাষা—আধুনিক সাহিত্যের মাধ্যম—হিসেবে পুষ্ট করায় মিশনারিরা তাদের সমস্ত সমর্থন দিয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়টা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে এই অমূল্য কাজটি এমন কিছু মানুষের করতে হলো, যাদের কিনা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সম্পর্কে অদ্ভুত সব ধারণা ছিল। সুচিন্তিতভাবে বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন ছিল বাংলা ভাষার প্রথম পৃষ্ঠপোষকদের লালিত ধারণাগত প্রভাবের মধ্যে সবচেয়ে কম ক্ষতিকর। এদের পক্ষপাতী মনোভাবের সবচেয়ে স্থায়ী প্রভাব পড়েছিল অন্যভাবে। ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে যাঁরা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন, প্রকৃতপক্ষে সেই গোষ্ঠীর ভেতরকার লোকেরাই দেশের ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আসলে, মিশনারিরা যে কারণে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, দেশীয় ভাষাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার কারণও ছিল সেটাই। ইংল্যান্ডে যিনি ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে কথা বলেছেন সেই গ্র্যান্টের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কেরি, মার্শম্যান এবং বাংলার অন্যরা মনে করতেন, বাইবেল ও অন্যান্য ধর্মতত্ত্বীয় রচনাগুলো দেশীয় ভাষায় সুলভ করা মানে খ্রিষ্টধর্মেরই সেবা করা। খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বকে জনপ্রিয় করার এই প্রচেষ্টাতেই বাংলা ভাষায় প্রথম গদ্য রচনার সূচনা হয়। তবে অবশ্যই এ কাজ শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পাঠ্যবই ও জনপ্রিয় লেখাগুলো পড়লে দেশজ ভাষার উন্নয়নের মহৎ উদ্যোগে জড়িতদের পক্ষপাতী আচরণ আবারও স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। এদের সাহিত্যকর্ম দ্রুত আগুয়ান হতে থাকে। কিন্তু সাহিত্যে এই আন্দোলনের সূচনা ও প্রগতিতে যাঁদের অবদান বেশি; তাঁদের চিন্তাভাবনার ভেতরে অন্য ধর্মানুসারীদের ভবিষ্যতের জন্য অশুভ ইঙ্গিত ছিল। শিক্ষিত মানুষের বিবেকের যে জাগরণ থেকে ধর্মীয় সংস্কারের সূচনা হলো, তা পাকাপাকিভাবে প্রকাশিত হলো ধর্মীয় রচনায়। পুরো জনগোষ্ঠীকে গ্রহণ করার মতো উদারতা এর ছিল না।
১৮৩৫ সাল এবং ১৮৬৫-এ প্রথম উপন্যাসের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাবের মাঝের সময়টাকে দাগিয়ে নেওয়া যায় অসাধারণ সাহিত্যমানের দুটি পত্রিকা ও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কবির যুগ হিসেবে। সংবাদ প্রভাকর নামের পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন অক্ষয় কুমার দত্ত। আগের মতোই, এ যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় বিষয়াদিতে আচ্ছন্ন থাকা। এমনকি সমাজের পুনর্গঠনের কল্পনা করার সময়ও ধর্মীয় নীতিমালার মাধ্যমেই তা উদ্ভাবিত হলো। অর্থাৎ, সে সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখিও ব্যস্ত থেকেছে শুধু জনগণের একটি অংশের জীবন পুনর্গঠনের চিন্তায়। এ যুগের শেষ দিকে এসে মানুষ যখন ধর্মনিরপেক্ষ জায়গা থেকে স্বাধীন রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করার উদ্যোগ নিল, তখনো কিন্তু একটি বিশেষ অংশকে নিয়ে চিন্তা করার বদভ্যাসটি বজায় থাকল। বাস্তবে ১৮৭০-এর দশকে, যে সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনগুলো শুরু হয়, তখনো কিন্তু ধর্মীয় যুগের সমাপ্তি আসেনি। ১৮৭০ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত কালটি ছিল আগের ৭০ বছরের ধর্মীয় গাঁজনের পূর্ণ বিকাশের দুর্দান্ত সময়। এই যুগের দাপুটে ব্যক্তিরা কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনাকারীরা নন, বরং কেশব সেন, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের মতো ধর্ম নিয়ে পড়ে থাকা ব্যক্তিরা। সেক্যুলার এবং পুরোপুরি ধর্মীয় আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র ছিলেন বঙ্কিম। নিজেকে পুরোপুরি ধর্মীয় করে তুলে তিনি এ কাজটি সম্পাদন করেন। তাঁর অসাধারণ সাহিত্যপ্রতিভা ব্যবহৃত হয়েছে এমন সব বিষয়ের আলোচনায়, যা তাঁকে শিক্ষিত শ্রেণির একটি বিশেষ অংশের অনুরাগভাজন করে তোলে। আসলে তিনি আরও একটি ধাপ পার হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রায় সমস্ত সাহিত্যকল্পনার কেন্দ্রবিন্দুতে বিরাজ করেছে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। অর্থাৎ, সে সময়ের ইতিহাসের নির্জলা পাঠ্যবইগুলো যা কমবেশি রেখেঢেকে বলত, উপন্যাসের আদলে তা তিনি স্পষ্ট করে গেছেন।
এই সময়ের লেখালেখির উচ্চাভিলাষ ও সাহিত্যিক মান নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু পুরো সমাজকে ধারণ করে এমন চেতনা এসব লেখায় পুরোপুরি অনুপস্থিত। এ ধরনের লেখা তরুণ বাংলাকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি। শুধু হয়তো হিন্দু তরুণদেরই আলোড়িত করে থাকতে পারে। লেখাগুলো নিছক মুসলমানবিরোধী তা নয়। এসব লেখার সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হলো, একই দেশে বসবাসকারী বিশালসংখ্যক মানুষের সম্পর্কে কোনো কৌতূহল সেখানে দেখা যায় না। এমনকি আগ্রহের পরিধি যখন পুরোপুরি সামাজিক প্রশ্নকে আমলে আনার মতো বড় হচ্ছে, তখনো প্রশ্নগুলো ওতপ্রোতভাবে ধর্মের সঙ্গেই জড়িত থেকেছে। সতীদাহ প্রথা এবং পরের কালে বিধবাবিবাহজনিত সমস্যা নিয়ে রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো লেখকদের হাত দিয়ে উঁচু মানের সাহিত্যিক রচনা তৈরি হয়েছিল। এসব নিয়ে সমাজে প্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়। সমাজ মানে অবশ্যই হিন্দু সমাজ। অন্য কেউ এসব বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি, কেউ তা দেখালেও সেটিকে স্বাগত জানানো হতো না। যেন সামাজিক চিন্তা ধর্মীয় চিন্তারই একটা দিক মাত্র।
এই নতুন ও প্রবল জাগরণের মধ্যে যাদের ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান প্রতিফলিত হয়নি, সেসব মানুষের নিয়ে কী করা হবে, এই প্রশ্ন সে যুগের কারও মনে কখনো জাগেনি বলেই মনে হয়। যা ঘটেছে এখানে তার সমালোচনা করা হচ্ছে না। বরং এমন বিকাশের ফলে যে জটিলতাগুলো সৃষ্টি হওয়ার কথা, সেদিকে নজরপাত করা হচ্ছে মাত্র। যেহেতু রাজনৈতিক তৎপরতা ও রাজনৈতিক চিন্তা সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশের সঙ্গে অনেকটাই জড়িত, সেহেতু সেসবের প্রভাবে রাজনীতি এহেন পঙ্গুত্ব নিয়েই চলতে বাধ্য হলো। একতরফা ও খণ্ডিত চিন্তার বিকাশ ভবিষ্যতের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে বাধ্য।
কিন্তু খণ্ডিত ও ধর্মীয় ধারার বিকাশের চেয়েও গুরুতর বিষয় ছিল সেক্যুলার শিক্ষা। এর মাধ্যমেই তরুণ ভারত পুষ্ট হচ্ছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাস বিষয়ে ইংরেজিতে লেখা মারাত্মক সব পাঠ্যবই অনেক ক্ষতি করে ফেলেছিল। একই জিনিষ দেশীয় ভাষায় লেখা হলে ক্ষতির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে গেল। বিকৃত গল্পগুলো আশ্রয় করে যখন অসামান্য সব কল্পকাহিনি লেখা হলো, তখন ক্ষতি সীমাহীন ও স্থায়ী হয়ে গেল। ঐতিহাসিক স্মৃতি কল্পনার সৃষ্টি দিয়ে আরও পুষ্ট হয়, বিশেষ করে যখন সেই কল্পকাহিনির স্রষ্টা হন বড় মাপের কোনো লেখক। কাঠখোট্টা ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের চেয়ে তার প্রভাব হয় অনেক গুণ বেশি। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক, ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিমান ও সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক বঙ্কিমচন্দ্র ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর প্রায় প্রতিটি লেখায় হিন্দু ও মুসলমানদের ভাবাবেগ উসকে দেওয়ার কাজ বেছে নিলেন। ১৮৬৫ সালে প্রথম রচনা প্রকাশের পর থেকেই কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র বাংলার সর্বাধিক পঠিত লেখক। রামমোহন থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ পর্যন্ত ঊনিশ শতকে যাঁরাই পুরোদমে ধর্মীয় চিন্তা ও অনুশীলনের পুনর্গঠন নিয়ে ভেবেছেন, তাঁদের মধ্যে বঙ্কিমই ছিলেন সৃষ্টিশীল তৎপরতার আঙিনার সবচেয়ে দাপটশালী লেখক। তাঁর ‘বন্দে মাতরম’ গানটি মানুষের চিন্তা ও কল্পনার ওপর তাঁর প্রভাবের অনড় ও স্থায়ী স্তম্ভ হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে। গানটি তাঁর বহুল পঠিত বই আনন্দমঠ-এর অংশ। হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব বিষয়ে সবচেয়ে জ্বালাময় রচনাগুলোর অন্যতম এই বই। রাজনৈতিক ভাবধারা নিয়ে লেখা প্রথম সৃজনশীল—এর সাহিত্যিক মান অতি উত্তম—কাজও এটিই। যুব বাংলা বিপুল উদ্যমে এতে সাড়া দিল। এটা ছিল বিধর্মীদের (মুসলিমদের) বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়া সন্তানদের ‘মা-কে আবাহনের’ (বন্দে মাতরম) রণসংগীত। বইটি এক প্রতিভাধরের সৃষ্টি, মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের মন্ত্র সৃজনে তিনি তাঁর সমস্ত প্রতিভাকে খাটিয়ে নিয়েছেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮২ সালে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার তিন বছর আগে। এমনকি গোড়ার বছরগুলোতেও, কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে জড়ো হওয়া নেতারা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে প্রীতিময় সম্পর্ক অর্জনকে কদর করতেন। বাড়তে থাকা জাতীয় আন্দোলনের এই মূল মঞ্চে এমন সম্পর্ক কামনায় প্রস্তাবের পর প্রস্তাব পাস হয়েছে। সে রকম এক জাতীয় আন্দোলন কেমন করে এমন একটি বই থেকে তার ‘দলীয় সংগীত’ (Theme song) বেছে নিল? কিভাবেই–বা বইটি এত জনপ্রিয় হলো? এমন অনুমান করা অসংগত হয় না যে গল্পটিকে এমন এক পাঠকশ্রেণির কাছে বলা হয়েছিল, যাদের কাছে একে স্বাভাবিক ও সহজাত বলে মনে হয়েছিল। (মার্কিন সিনেমায় ‘কালো মানুষদের’ উপস্থাপনার ধরন ঠিক এই মানসিকতারই ইঙ্গিত দেয়)।
উনিশ শতকের শুরুর দিকের বুদ্ধিবৃত্তিক গাঁজন এবং সাধারণ আত্মানুসন্ধান একই সঙ্গে এগিয়েছে। আঠারো শতকে মোগল প্রশাসনিক ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় কাঠামোর বিলুপ্তি এবং সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যের প্রভাবের পরিণতিতে ঊনিশ শতকের নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাস তৈরি হয়। সারা দেশের জনগণের মধ্যে এই দুই সমান্তরাল প্রক্রিয়া একে অপরের সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ ছাড়াই চলতে থাকে। উনিশ শতকের শুরুর দিকের যাবতীয় প্রচেষ্টার গোড়ায় ধর্ম চলে আসায় উভয় ধারার যৌথতার বদলে সমান্তরাল চলনই অনিবার্য হয়ে ওঠে। যতক্ষণ পর্যন্ত মূল আগ্রহ ধর্মকেন্দ্রিক ছিল অথবা সামাজিক প্রশ্ন ধর্মীয় আচার-আচরণের সঙ্গে জড়িত ছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত দুটি সমান্তরাল ধারা ঐকতান বজায় রেখেছে। এই ঐকতান কিন্তু বিচক্ষণ সহনশীলতার ফল ছিল না, বরং ছিল চরম উদাসীনতার নজির। কিন্তু এই কালপর্বে সেক্যুলার জ্ঞান এমন মাত্রায় বিষাক্ত ইতিহাসবোধ ঢুকিয়ে দিয়েছিল; তা জনগণের একটি অংশকে অপর অংশের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণার দিকে ঠেলে দেয়। এভাবে জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে কঠিন দেয়াল তৈরি হয়ে গেল। বঙ্কিমের মতো প্রতিভাবান এবং অন্যান্য কম প্রতিভাবান লেখকদের হাতে পাঠ্যবইয়ের লেখার পরীক্ষামূলক ও অশৈল্পিক প্রচেষ্টা নান্দনিক সুষমার আদলে সমৃদ্ধ হয়েছিল। সমসাময়িক পুনরুত্থানবাদী হাওয়া এসবের জনপ্রিয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু বইগুলোর বিষয়বস্তুর সমালোচনা তো দূরের কথা যে শিক্ষিত জনতা বরং সেসব বুকে টেনে নিয়েছিল। এই শিক্ষিত জনতাকে তো বঙ্কিম ও তাঁর সমসাময়িকেরা তৈরি করেননি। অর্ধশতাব্দী ধরে গোষ্ঠীগত চিন্তাধারা এবং গোষ্ঠীগত বিকাশের মাধ্যমে যে জমি তৈরি করা হয়েছিল, এসব ছিল তারই ফল। ১৮৭০-এর দশক থেকে খেটেখুটে রাজনৈতিক চিন্তা ও রাজনৈতিক আন্দোলনের যে ঐতিহ্য তৈরি করা হয়েছিল, উনিশ শতকে এসে তার রূপ না ছিল ভারতীয়, না বাঙালি, না মারাঠি; তা ছিল হয় হিন্দু নয়তো মুসলমানি ঐতিহ্য। একজন বাঙালি লেখক, তা তিনি প্রতিভাবানই হোন বা প্রতিভাহীন, রাজপুত বা মারাঠির মধ্যে তাঁর গল্পের নায়ক খুঁজে নিতে পারেন; যদিও মারাঠিদের ব্যাপারে তাঁর একমাত্র স্মৃতি হলো বাংলায় তাদের আক্রমণ ও লুটপাটের ঘটনা। সংযোগটি অবশ্যই ধর্মীয়। ভারতের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ—পাকিস্তান বিতর্কের চেয়েও এটা অনেক পুরোনো—কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে স্বার্থান্বেষী দলগুলোর সাম্প্রদায়িকতার পরিণতি নয়। অপ্রতিরোধ্যভাবে এটা চলে এসেছে—অন্ততপক্ষে শিক্ষিত শ্রেণির ভেতরের একটা ঘটনা হিসেবে—উনিশ শতকের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের হাত ধরে। উনিশ শতকের সমান্তরাল কিন্তু গোষ্ঠীকেন্দ্রিক, একতরফা ও সংকীর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার মধ্যে এটা দেখা যায়। রাজনৈতিক আন্দোলনের চরিত্র এবং তার অন্তর্নিহিত সারবস্তু মূলত উনিশ শতকের বুদ্ধিবৃত্তিক গড়নকেই অনুসরণ করেছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায় লেখা সাহিত্যের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় না থাকলে এটা বোঝা যাবে না। উনিশ শতক থেকে ভারতবর্ষের মানুষের সৃজনশীল ক্রিয়াকলাপ অনেকগুলো সাহিত্যের বিকাশের ভেতর দিয়ে পূর্ণ অভিব্যক্তি খুঁজে পায়। যে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে শিক্ষিত ভারতীয়রা সচেতন রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছিল, তার চিন্তাগত জলবায়ুর জোগান দিয়েছিল দেশজ সাহিত্য।
রাজনৈতিক সভা ও সম্মেলন অথবা সেসবের কার্যবিবরণী পর্যালোচনা থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনের মর্মমূলে কিসের সমাদর চলে, সেখানে পৌঁছানোর পথ মিলবে না। ভারতবর্ষের মুসলমানরা কেন একগুঁয়েভাবে আলাদা রাজনৈতিক পথ বেছে নিল? যাঁরা কেবল এসব উপাদান দিয়ে অথবা সংবাদপত্রের রাজনৈতিক লেখালেখি থেকে ভারতীয় রাজনীতির সারবস্তু ও গতিধারা বুঝতে চান, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁদের কাছে অব্যাখ্যাতই থেকে যাবে। যদিও এসব রাজনৈতিক আন্দোলনে বিপুলসংখ্যক মানুষ গোচরে ও অগোচরে শামিল হয়েছে। কিন্তু আন্দোলনগুলোর চরিত্র নির্ধারিত হয়েছে শিক্ষিত পেশাজীবীদের দ্বারা। ভারতের শিক্ষিত মানুষ গড়ে উঠেছিল একটি নয় বরং দুটি ঐতিহ্যের মাধ্যমে। এবং দুর্ভাগ্যবশত, এ ধারা দুটো একে অন্যের থেকে আলাদাই ছিল। ফলে যখন তারা সর্বজনীন সমস্যা নিয়েও আলোচনা করেছে, এমনকি তখনো তারা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা মানসিক ভিত্তিভূমি থেকে আলোচনা শুরু করেছে। দেশের সাহিত্যের যে অংশটি মুসলমানদের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছিল, তারও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ইসলাম ও সাধারণ মুসলমানদের জীবনের ব্যাপারে বহির্মুখী (extraterritorial)। ১৯২০-এর যে খেলাফত আন্দোলনে গান্ধী দক্ষভাবে সহায়তা করেছিলেন, শুধু এই বহির্মুখী দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে তা ভালোভাবে বোঝা সম্ভব। গান্ধী এই আন্দোলনের তাৎপর্য বুঝতে—জীবন সম্পর্কে কোন দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে তা গড়ে উঠেছিল সেটা বুঝতে—কতটা মর্মান্তিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন তা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এ আন্দোলনের সাফল্য থেকে তিনি কী আশা করেছিলেন সেটা দেখলে। তিনি আসলে বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং রাজনৈতিক সাফল্য তখনি আসবে যখন হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্মের মানুষই আরও ধর্মপরায়ণ হয়ে উঠবে।
আঠারো শতকের শেষের দিকে এবং উনিশ শতকের শুরুতে মুসলিম সমাজের জন্য শাহ ওয়ালীউল্লাহ, শাহ আবদুল আজিজ ও সৈয়দ আহমেদ বেরেলভী ঠিক তাই ছিলেন হিন্দু সমাজের জন্য, যা ছিলেন রাজা রামমোহন রায় এবং তাঁর কাছের অনুসারীরা। এই দুই তরফের মধ্যে পার্থক্য তো বটেই ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবধান অনেক বিরাটও। কিন্তু এই দুই আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গিতে মিলও ছিল অনেক। এরা উভয়েই সমাজ পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল। কিন্তু যে নীতির নিরিখে সমাজকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল, তা ছিল ধর্মীয়
আমরা এ পর্যন্ত দাবি করেছি যে শিক্ষিত ভারতীয়দের মন আলাদা খুপরিতে বেড়ে উঠেছে। বাংলার রেনেসাঁর ইতিহাস হলো বাংলার হিন্দু সমাজে আধুনিক ধ্যানধারণা চালু করার ইতিহাস। সাহিত্যের দলিল-দস্তাবেজ থেকে, বিশেষ করে সৃজনশীল সাহিত্যে নিহিত চিন্তার ইতিহাস থেকে যত দূর খুঁজে পাওয়া যায়, বাংলার অ-হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবনে এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। বাংলার চিন্তার ইতিহাস যদি ভারতবর্ষের চিন্তার ইতিহাস হতো, তাহলে হয়তো এ সমস্যার কোনো না কোনো সমাধান পাওয়া যেত, আরও পরে গিয়ে ভারতবর্ষকেও হতভম্ব হতে হতো না। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এমন কেউ ছিল না, যিনি ভাবতেন যে গোটা ভারত আসলে একটাই সমাজ। সে সমাজ না মুসলমানের না হিন্দুর। তাই যে সময়ে বাংলায় রামমোহন রায় আত্মানুসন্ধানের সূচনা করেছিলেন, তখন অন্য সমাজেও যে একই রকম আত্মানুসন্ধান শুরু হয়েছিল; তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। তবে একটি সমাজ অন্য সমাজ থেকে কতটা দূরে ছিল, তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। উনিশ শতকের প্রথম দিকে যখন বাংলায় মুসলিম জাগরণ ছড়িয়ে পড়েছিল, বাংলার নয়া সংবাদপত্রে তা কখনোই জায়গা করে নিতে পারেনি এবং বিকশিত হওয়া নতুন সাহিত্যে এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।
কিন্তু এই জাগরণ ছিল বাস্তবতা। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তক্ষেপ ছাড়াই, আঠারো শতকজুড়ে দ্রুতগতিতে সমাজের ভাঙন ঘটে চলছিল। সমাজে যখন ভাঙন শুরু হলো, তখন চিন্তাশীল মানুষেরা তাঁদের অন্তরের ভেতর খুঁজে দেখতে শুরু করলেন এবং মূলত দিল্লি শহরকে ঘিরে নতুন জীবনের আলোড়ন শুরু হলো। এই ব্যক্তিরা ঠিক পশ্চিমের প্রভাবে ততটা প্ররোচিত হননি। আঠারো শতকের শেষের দিকে এবং উনিশ শতকের শুরুতে মুসলিম সমাজের জন্য শাহ ওয়ালীউল্লাহ, শাহ আবদুল আজিজ ও সৈয়দ আহমেদ বেরেলভী ঠিক তাই ছিলেন হিন্দু সমাজের জন্য, যা ছিলেন রাজা রামমোহন রায় এবং তাঁর কাছের অনুসারীরা। এই দুই তরফের মধ্যে পার্থক্য তো বটেই ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবধান অনেক বিরাটও। কিন্তু এই দুই আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গিতে মিলও ছিল অনেক। এরা উভয়েই সমাজ পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল। কিন্তু যে নীতির নিরিখে সমাজকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছিল, তা ছিল ধর্মীয়। এর ফলে যে চিন্তার উদয় ঘটেছিল, তা ছিল গোষ্ঠীকেন্দ্রিক। এমনকি এটি যখন সামাজিক এবং পরে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোকে স্পর্শ করেছে, তখনো। ভারতবর্ষের সব জনগণের জন্য এর কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। সৈয়দ আহমদ বেরেলভী এবং তাঁর অনুসারীরা যে ধর্মীয় মতবাদের প্রচারণা করেছিলেন, তা মুসলিম সমাজে গৃহীত হয়নি। এমনকি রাজা রামমোহন রায় এবং তার সাক্ষাৎ শিষ্যদের ব্রাহ্ম ধর্মতত্ত্বও কিন্তু মূলধারার হিন্দু সমাজে গৃহীত হয়নি। সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ও বাংলায় ফরায়েজিদের নেতা হাজি শরীয়তউল্লাহর আন্দোলনের কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব অস্বীকার করা শিক্ষিত মুসলমানদের জন্য বিশেষ বেদনার ছিল। কিন্তু শিক্ষিত মুসলমানরা আন্দোলনের মৌলিক ধারণার সেই উপাদানটিকে অস্বীকারের চেষ্টা করতে পারেনি কিংবা করেনি; যা তাদের গোষ্ঠীকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। মুসলিম চিন্তাধারা এবং মুসলিম সমাজের পুনরুজ্জীবন ও পুনর্গঠনের প্রতি শিক্ষিত মুসলমানরা নিজেদের নিবেদিত করেছিল। ভারতীয় সমাজে তাঁদের সহযাত্রীদের মধ্যে যাঁরা অমুসলিম, তাঁদের প্রতি তাঁরা ঠিক সে রকম উদাসীনতা প্রদর্শন করেছেন, শিক্ষিত হিন্দুরা যেমনটা দেখিয়েছেন তাঁদের ভিন্নধর্মী স্বদেশবাসীদের প্রতি। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের উর্দু সাহিত্যের মূল ভাবধারার মধ্যে ভারতবর্ষের জনসংখ্যার অমুসলিম অংশগুলোর কোনো উল্লেখ বা প্রাসঙ্গিকতা ছিল না।
রাজা রামমোহন রায় যে আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক, যেখানে শাসকশ্রেণি তার পূর্ণ গৌরব ও ক্ষমতা নিয়ে বজায় ছিল। আন্দোলনটি মূলত মিশনারি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা ছিল। ইংরেজি শিক্ষার প্রসার এবং স্থানীয় ভাষার চর্চা এ আন্দোলনের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে যুক্ত ছিল। দীর্ঘ মেয়াদে, শাসকশ্রেণির ভাষাচর্চা স্থানীয় সমাজে এই শ্রেণির মর্যাদা নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছিল। সে কারণেই, দিল্লি এবং এর আশপাশে মুসলমানদের মধ্যে একই রকম আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, যা ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে জড়িত ছিল না, তা–ও কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এটি লক্ষণীয় যে সে যুগে হিন্দুদের সমান্তরালে ইংরেজি শিক্ষার সাধনা ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। ইংরেজির জ্ঞান ছাড়াই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চাকরি পাওয়া যেত; এই বিষয়টি সেই ভাষার জ্ঞান অর্জনের প্রতি মুসলমানদের উদাসীন করে তুলেছিল। কিন্তু এই প্রবণতা বিকাশের পরিণতি কেবল উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে, যখন স্থানীয়দের মধ্যে সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি প্রায় পুরোপুরিভাবে ইংরেজি শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।
এ দুটি আন্দোলনের আলাদা বিকাশের আরও দুটি ফল লক্ষ করা যায়। রাজা রামমোহন রায় যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা কখনোই ক্রমবর্ধমান ইংরেজি-শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বাইরে যায়নি। এর বিজয়যাত্রা ধীর হলেও স্থির ছিল এবং এটি গতিপথ পরিবর্তন করেনি। অধুনা পর্যন্ত (অর্থাৎ, ১৯৪০–এর দশকের শেষের দিকে) শাসকশ্রেণির সঙ্গে আন্দোলনের এবং এর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার সম্পর্ক সামগ্রিকভাবে বন্ধুত্বপূর্ণই ছিল। মেকলের সময় থেকেই শাসকশ্রেণি ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে যথেষ্ট গর্ব অনুভব করত। কারণ, তারা বিশ্বাস করত, নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ সম্পূর্ণরূপে ইংরেজি শিক্ষা প্রসারেরই ফল। শিক্ষিত শ্রেণি জানত যে সমাজে তার সমৃদ্ধি ও মর্যাদা প্রচলিত প্রশাসনব্যবস্থা বজায় থাকার সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা। এই শিক্ষিত শ্রেণির সামাজিক দর্শনের মৌলিক ধ্যানধারণা শাসকশ্রেণিকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারেনি। এমনকি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অর্জন যে নতুন দেশীয় ভাষার বিকাশ, সেটা শেখাও ছিল কষ্টসাধ্য। ১৮৭০-এর দশকে এবং তারও পরে, আগের সময়ের বাংলায় সংস্কৃত ভাষার শব্দের ছড়াছড়ি অপসারণে দৃঢ় প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। নতুন সাহিত্যের অর্জনগুলো কিছু সময়ের জন্য তুলনামূলকভাবে একটি ছোট শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অন্যদিকে সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর আন্দোলন খুব দ্রুতই সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দিকে নজর দিতে শুরু করে।২২ এ আন্দোলনের ভাষা শিক্ষিত মানুষের শেখানো বুলি ছিল না। এ আন্দোলনের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য বিপজ্জনক ছিল এবং একই সঙ্গে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত একটি অংশের জন্যও হুমকির ছিল। অর্থাৎ, মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন, সেই শ্রেণির অতিরিক্ত দায়িত্ব ছিল এমন সব মানুষের চিন্তাভাবনাকে অস্বীকার করা, যাঁরা সমাজের চিন্তার পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। সুতরাং রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত আন্দোলন যেমন সুশৃঙ্খল ছিল, মুসলমানদের এই আন্দোলন তেমন সাজানো-গোছানো ছিল না। এসব চিন্তার মূল শিকড় পোঁতা ছিল নির্দিষ্ট একটা ঐতিহ্যের মধ্যে। এমনকি স্যার সৈয়দ আহমদ খান যিনি সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর মতবাদের সবচেয়ে দৃঢ় প্রতিপক্ষ ছিলেন, তিনিও কিন্তু মূলত ধর্মীয় চিন্তাধারার পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা করেছেন—যে ঐতিহ্যকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানরা ভয় পেত। সংখ্যালঘু এই মধ্যবিত্তকে তাই এমন এক সংশয়ের মুখোমুখি হতে হলো, যে সংশয় অন্য মধ্যবিত্তদের মোকাবিলা করতে হয়নি। মধ্যবিত্ত মুসলমানকে নিজের সমস্যা তাই নিজেরই সমাধান করতে হয়েছে এবং তার ওপরে আবার সহানুভূতিশীল নয় এমন শ্রোতাদের নিজের পক্ষেও টানতে হয়েছে। ১৮৭০-এর দশকে মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিভ্রান্তির মূল কারণ ছিল এটাই। একদিকে তাদের বাস্তব সমস্যার সমাধানের জন্য সংগ্রাম করতে হবে, অন্যদিকে আবার অন্যদের বোঝাতেও হবে।
উর্দু সাহিত্যের বিকাশ—বাংলার মতো—এমন ছিল যে গড়পড়তা শিক্ষিত হিন্দু এর অধ্যয়নে স্বস্তি বোধ করত না। দুর্ভাগ্যবশত, এটা স্বীকার করতেই হবে, উত্তর ভারতের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত (উর্দুর নানান ধরন) সাহিত্য একধরনের ভ্রান্ত ‘জাতীয়তাবাদী’ চেতনার হাতেই বরং বেশি নাকাল হয়েছে, অন্য কারণে ততটা নয়। এই চেতনাকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে আলাদা করা মুশকিলই ছিল। উত্তর ভারতের কিছু জায়গায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে এমন হিন্দু ছাত্র পাওয়া স্বাভাবিক যারা মনে করত অন্য ভাষাকে নিজের চিন্তা থেকে বের করে দেওয়াটা হিন্দির প্রতি তাদের কর্তব্য। অথচ তাদের পূর্বপুরুষেরা মাত্র এক বা দুই প্রজন্ম আগে এসব ভাষায় তুমুল পারদর্শী ছিলেন।২৩ মোদ্দা কথা হলো, উর্দু সাহিত্যের বিষয়টাই এমন যে মুসলমানদের কাছে এর আবেদন প্রায় একচেটিয়া। বাংলা ভাষায় আনন্দমঠ যে স্থান দখল করে আছে, উর্দু ভাষায় সেই জায়গা দখল করে আছে ১৮৭৯ সালে প্রকাশিত হালির একটি কবিতা। হালির মুসাদ্দাস ইসলামের উত্থান ও পতনের গল্প। স্নাতক পর্যায়ের একজন গড়পড়তা হিন্দু ছাত্র ইসলামের সম্বৃদ্ধি ও পতনের গল্প নিয়ে যে উৎসাহী হবে না এটাই স্বাভাবিক। তা সে স্যার সৈয়দ আহমদই হোন আর মোহাম্মদ আজাদ তাকাউল্লাহ বা নাজির আহমদই হোন, এঁরা ভারী গদ্যে যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, তা কেবল মুসলমানদের জন্যই প্রাসঙ্গিক। তাঁরা যে সমাজ পুনর্গঠন করতে চেয়েছেন, তা ছিল মুসলমান সমাজ। এ কারণেই কিন্তু হালির বিলাপ উর্দু সাহিত্যের স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের হিন্দু ছাত্রদের আগ্রহী করে তুলতে সফল হয়নি।
যে স্থায়ী ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে পরের কালের রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল; তাকে জানতে হলে প্রথমে অবশ্যই সে সময়ের টেকসই সাহিত্যচর্চার ভেতরে সন্ধান চালাতে হবে। কারণ, রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছে শিক্ষিত শ্রেণির মনের প্রতিফলন। এ শ্রেণির হাতে গড়া সাহিত্যে সেই মনের ছবি সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত আছে। এই সাহিত্যের চরিত্র ও বিষয়বস্তু, পক্ষপাত ও ঝোঁক, তাদের পছন্দের বিষয়বস্তু এবং যেসব উৎস থেকে লেখকেরা এসবের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন, তা রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোর অন্তর্নিহিত স্রোতের গতিপ্রকৃতি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। যে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের ওপর অধিকারের ভিত্তিতে শিক্ষিত ভারতীয়রা অশিক্ষিতসহ সমগ্র জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই ঐতিহ্য বড়ই সন্দেহজনক এক সম্পদ।
তথ্যসূত্র ও টীকা
১. ১৭৯২ সাল থেকে শুরু করে ১৮২২ সালের মধ্যে এ দেশের বহির্বাণিজ্যের চরিত্রে রীতিমতো একটা বিপ্লব ঘটে যায়, যার প্রভাব পড়ে সমাজের নানা শ্রেণির অগণিত মানুষের ওপর। ১৭৯২ সালে ভারতবর্ষ থেকে প্রায় ১.২ মিলিয়ন টুকরা কাপড় বহির্বিশ্বে রপ্তানি হয়েছিল, কিন্তু ১৮২২ সালে তা নেমে আসে মাত্র ১০০ খানিরও কমে। এর আগে, বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছিল মত্র ১৬ হাজার ৫০ রুপি সমমূল্যের পরিধেয় বস্ত্র। ১৮২২ সালে বিদেশ থেকে আমদানি করা বস্ত্রের মূল্য গিয়ে দাঁড়ায় ১১ মিলিয়ন রুপিরও বেশি। ১৭৯২ সালে এ দেশ থেকে নীল রপ্তানি করা হয় ৭ হাজার ২৬৬ মণ। ১৮২২ সালে তার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় এক লাখ মণে। সমাচার দর্পণ, ১৫ ডিসেম্বর ১৮২৭।
২. উচ্চশিক্ষার চাহিদা কতটা তীব্র ছিল, তা স্পষ্ট হয় আরও কিছুদিন পরে। ১৮৫৪ সালের এডুকেশন ডেসপ্যাচ আইনের আসল উদ্দেশ্য ছিল যাদের ওপর সরকার বরাবর নির্ভর করে এসেছে, তাদের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত মানুষের মধ্যে শিক্ষাকে আরও ব্যপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যম কী হবে, সে বিষয়ে একটা নীতিমালা তৈরি করা। ১৮৫৯ সালের বিধানেও কিন্তু এই একই বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। আর্থার পি হাওয়েল, আ নোট অন দ্য স্টেট অব এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া, ১৮৭৬-৭৭, পৃ ২।
[সম্পূর্ণ রেফারেন্সের জন্য দ্রষ্টব্য, আর্থার পি হাওয়েল, আ নোট অন দ্য স্টেট অব এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া প্রায়র টু ১৮৫৪, ১৮৭৬-৭৭। ক্যালকাটা: অফিস অব দ্য সুপারিনটেনডেন্ট অব গভর্নমেন্ট প্রিন্টিং, ১৮৭২, পৃ ২]
৩. ভারতবর্ষের রেলওয়ের বিকাশ সম্পর্কিত একটা গবেষণাপত্র থেকে (১৮৪৮), পৃ ৩-৬ [খুঁজে পাওয়া যায়নি]।
[স্যার উইলিয়াম প্যাট্রিক অ্যান্ড্রু, ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ অ্যান্ড দেয়ার প্রবাবল রেজাল্টজ উইথ ম্যাপস অ্যান্ড অ্যান অ্যাপেন্ডিক্স, কন্টেইনিং স্ট্যাটেস্টিকস অব ইন্টারনাল অ্যান্ড এক্সটারনাল কমার্স অব ইন্ডিয়া বাই অ্যান ওল্ড ইন্ডিয়ান পোস্টমাস্টার, লন্ডন: টি সি নিউবি, তৃতীয় সংস্করণ ১৮৪৮, পৃ ৮-৫১।
৪. এমনকি সেই সুদূর অতীতেও বস্তুগত পরিবর্তনের কারণে চিন্তার জগতে পরিবর্তন অচিন্তনীয় ছিল না। এক পত্রিকার সাংবাদিক লিখেছিলেন, ‘নতুন চীনা বাজারে কিছুদিন আগে এক দোকানদারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তিনি বিপ্লবী বা উদারপন্থীদের খুব একহাত নিলেন…নতুন প্রজন্ম যেসব নতুন রীতিনীতি এবং চিন্তাভাবনা আত্মস্থ করছে, সেগুলোর তুমুল সমালোচনা করলেন…অথচ এই লোকটা নিজেই কিন্তু সংরক্ষিত মাছ, মাংস, শ্যাম্পেন, বিয়ার, এসবের ব্যবসা করেন…এই লোকের দোকানের পেছনে যে মদের দোকানটি আছে, তার মালিক এক ব্রাহ্মণ, আরেকজন আছেন, যিনি এক প্রভিশনারের সিনিয়র সহকারী, যাঁকে গরুর মাংস হাত দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয় তা ঠিক আছে কি না। এরা কী করছে তা এরা ঠিকভাবে বোঝে তো?’ দ্য ইনকোয়ারার, ১৮ অক্টোবর ১৮৩১।
৫. লোকনাথ ঘোষের দুই খণ্ডের মডার্ন হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান চিফস, রাজাস, জামিনদারস, এটসেট্রা, [জে এন ঘোষ অ্যান্ড কোং, ক্যালকাটা: ১৮৭৯ ও ১৮৮১] হলো মূলত সেসব মানুষের স্মৃতিকথা যাদের পূর্বসূরিরা ‘জমিদার’ হয়েছিলেন কোম্পানিতে চাকরি করা কিংবা কোম্পানির চাকর হওয়ার সুবাদে।
৬. কলকাতা মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছিল ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে যখন প্রধানত মুসলিম আইনেই আদালত চলত এবং এর কাজ ছিল এই আইন সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এমন মানুষের জোগান দেওয়া।
এ সি সান্যাল, ‘ক্যালকাটা মাদ্রাসা’ বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট, জানুয়ারি-জুন, ১৯১৪, দ্রষ্টব্য।
আরও দ্রষ্টব্য চার্লস ল্যাশিংটন, দ্য হিস্টরি ডিজাইন অ্যান্ড প্রেজেন্ট স্টেট অব দ্য রিলিজিয়ন্স, বেনেভোলেন্ট ইনস্টিটিউশন্স ফাউন্ডেড বাই দ্য ব্রিটিশ ইন ক্যালকাটা অ্যান্ড ইটস ভিসিনিটি, [ক্যালকাটা: হিন্দুস্তানি প্রেস, ১৮২৪], অ্যাপেন্ডিক্স নো 7, XXXI-XXXIII
৭. কলকাতা মাদ্রাসার সিলেবাসের খুব দর্শনীয় বর্ণনা দিয়ে গেছেন স্যার ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার, ‘প্রায় নব্বই বছর ধরে (অর্থাৎ মাদ্রাসার সূচনাকাল থেকে) সেই জায়গার সবচেয়ে জনপ্রিয় পঠনের বিষয় ছিল বিধর্মীদের সঙ্গে যুদ্ধের ইতিহাস।’
[উইলিয়াম উইলসন হান্টার, ইন্ডিয়ান মুসলমান্স, লন্ডন, ট্রুবনার অ্যান্ড কোম্পানি, থার্ড এডিশন: ১৮৭৬, পৃ ২০৪]
৮. দ্য ক্যালকাটা রিভিউ, ভলিউম ২, জুলাই-ডিসেম্বর, ১৯৪৯, পৃ ২১৩-২৪৬।
৯. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অ্যাক্ট ১৮১৩–তে বলা আছে যে ‘…সাহিত্যের পুনর্জাগরণ ও উন্নতির লক্ষ্যে এবং স্থানীয় শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গকে উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে এবং ভারতবর্ষের ব্রিটিশ ভূখণ্ডের জনগণের বিজ্ঞান চর্চা প্রারম্ভের লক্ষ্যে এক লক্ষ রুপি সংরক্ষণ ও বিতরণ করিতে নির্দেশ দেওয়া হইল…’
[মিনিটস অব এভিডেন্স টেকেন বিফোর দ্য সিলেক্ট কমিটি অন দ্য অ্যাফেয়ার্স অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ভলিউম ১ পাবলিক, লন্ডন: প্রিন্টেড বাই দ্য হাউস অব কমন্স, ১৮৩২, পৃ ৪৮৬]
১০. ১৮১৩ সালের আইনটি ছিল ১৮১৩ সালে হাউস অব কমন্সে নেওয়া সরকারি সিদ্ধান্তেরই প্রতিধ্বনি। সিদ্ধান্তটি ছিল আইনের উল্লেখিত অধ্যায়টির তুলনায় আরও বিস্তারিত, যেখানে ইংরেজি শিক্ষা এবং ধর্মান্তরকরণের মধ্যকার সম্পর্কটিকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। সিদ্ধান্তে বলা হয়েছিল যে,
‘… ভারতবর্ষের ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত অংশের বসবাসরত জনগণের সুখ এবং স্বার্থের দিকে নজর রাখা এই দেশের দায়িত্ব এবং তাহারা যেন প্রয়োজনীয় শিক্ষা এবং ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতি লাভ করিতে পারে, সেই লক্ষ্যে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের তাগিদে যেই সকল নাগরিক স্ব–ইচ্ছায় ভারত গমন করিবেন তাহাদের যথোপযুক্ত আইনি সহায়তা দেওয়া হইবে …’
[‘রেজল্যুশন রেস্পেক্টিং দ্য অ্যাফেয়ার্স অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’, জুন ৩, ১৮১৩, প্যারা ১৩, দ্য পার্লামেন্টারি ডিবেটস ফ্রম দ্য ইয়ার 1803 টু দ্য প্রেজেন্ট টাইম, ভলিউম ২৬, লন্ডন: টিসি হ্যানসার্ড, ১৮১৩, পৃ ৫৬২]।
১১. ‘আ স্কেচ অব দ্য অরিজিন, রাইজ অ্যান্ড প্রোগ্রেস অব দ্য হিন্দু কলেজ’, দ্য ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অবজারভার, ভলিউম ১, [জুন-ডিসেম্বর, ক্যালকাটা: দ্য ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস, ১৮৩২, পৃ. ৬৯]
১২. ‘প্রসপেক্টাস অব দ্য হিন্দু কলেজ, ২৭ আগস্ট, ১৮১৬’, দ্য ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অবজারভার, ভলিউম ১, পৃ. ৭২।
১৩. স্যার উইলিয়াম ওয়েডেরবার্ন, ‘ফাদার অব দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’, অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম ১৮২৯-১৯১২, লন্ডন: আনউইন, ১৯১৩।
১৪. সমাচার দর্পণ, ১৮ আগস্ট ১৮৯০। [আরও দেখুন ডব্লিউডব্লিউ হান্টার, ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃ. ৫১-৫৯]
১৫. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, পৃ. ২২৭-২৮৯।
১৬. ১৮১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা স্কুল বুক অ্যান্ড সোসাইটির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ভারতে ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী হওয়ার সূচনা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তা কোম্পানির পক্ষ থেকে ছিল না। চার্লস লাশিংটন, দ্য হিস্ট্রি, ডিজাইন অ্যান্ড প্রেজেন্ট স্টেট অব রিলিজিয়াস, বেনেভোলেন্ট অ্যান্ড চ্যারিটেবল ইনস্টিটিউশন ফাউন্ডেড বাই দ্য ব্রিটিশ ইন ক্যালকাটা অ্যান্ড ইটস ভিসিনিটি, কলকাতা: হিন্দুস্তানি প্রেস, ১৮২৪, পৃ. ১৫৬-১৮৪।
১৭. কেরি লিখেছেন ‘কলেজের পণ্ডিত হারু প্রসাদ পুরুষ পরীক্ষা নামে একটি সংস্কৃত রচনাকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। যদি এটি ১০০ কপি অগ্রিম ক্রয়ের স্বাভাবিক প্রণোদনা পায় তবে এটা তিনি ছাপাতে চান…’ (হোম মিসেলেনিয়াস নং ৫৬৩, পৃ. ৩৯২)। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সংবাদপত্রে সেকালের কথা, পৃ. ৩৯২ এ উদ্ধৃত।
১৮. মার্শম্যান সম্পাদিত পত্রিকার জন্য পণ্ডিতরা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে পণ্ডিতরা শ্রীরামপুরে ছিল না বলে এর প্রকাশনা স্থগিত করতে হয়েছিল। সমাচার দর্পণ, ২৬ অক্টোবর ১৮৩৩।
১৯. সমাচার দর্পণ, ১৩ ডিসেম্বর ১৮৩১।
২০. ‘জেনারেল ক্যারেকটারিস্টিকস অব দ্য নেটিভ নিউজপেপার’, দ্য ক্যালকাটা ক্রিশ্চিয়ান অবজারজার, ভলিউম ১, ১৮৩২, পৃ. ২১২।
২১. দ্য রিফর্মার, ১৮ নভেম্বর ১৮৩১।
২২. ‘এর সূচনা হয় সৈয়দ আহমদ এবং তাঁর দুই বিদ্বান প্রশিক্ষক শাহ আবদুল আজিজ ও আবদুল কাদিরের ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে। নতুন মতবাদগুলো বিতর্কের ধোঁয়া জাগিয়েছে। এগুলো সবই উর্দুতে লেখা হয়েছে, সাধারণ মানুষ জন্য সহজ সরল ভাষায়...সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর নেতৃত্বাধীন আন্দোলন ভেঙে পড়লে, বিখ্যাত মুসলিম নেতা স্যার সৈয়দ আহমদের শিক্ষা, সামাজিক, ধর্মীয়, নৈতিক, রাজনৈতিক ও আধা-রাজনৈতিক সংস্কার ও কর্মকাণ্ডে তার চিন্তাচেতনার চূড়ান্ত পরিণতি পাওয়া যায়।’ রাম বাবু সাক্সেনা। আ হিস্ট্রি অব উর্দু লিটারেচার, [এলাহাবাদ: রাম নারায়ণ লাল, ১৯২৭, পৃ. ২৬৫-২৬৬]।
২৩. স্যার টি বি সাপরু, ‘ফোরওয়ার্ড’, পৃ. iii, আ হিস্ট্রি অব উর্দু লিটারেচার, রাম বাবু সাক্সেনা।