ভূমিকা
আমার পেশাগত জীবন ছিল অন্য অর্থনীতিবিদদের চেয়ে আলাদা। ছয় দশকে আমি অনেক ধরনের পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছি। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ পেশাগত জীবনে দুটি বা তিনটি কাজের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা ছিল অনেকগুলো পেশাগত কাজের যৌথ সমন্বয়। পেশাগত জীবনে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছি এবং গবেষণা করেছি। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে শুধু গবেষণায় ব্রত রয়েছি। সর্বোচ্চ জাতীয় নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েছি। জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক সিভিল সার্ভেন্ট হয়েছি এবং শেষে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।
আমার পেশাগত জীবনের বিভিন্ন পর্যায় যথাক্রমে: অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক (রিডার) এবং তারপর অধ্যাপক (১৯৫৫-১৯৬৪); পাকিস্তান উন্নয়ন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠান (পিআইডিই), বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) পরিচালক (১৯৬৪-১৯৭১-৭২); বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান (১৯৭২-৭৫); ইতালির রোম শহরে অবস্থিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার অর্থনীতি ও সামাজিক নীতি বিভাগের সহকারী মহাপরিচালক (১৯৭৭-৮৭) এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ইফপ্রি) গবেষণা উপদেষ্টা/ইমেরিটাস ফেলো (১৯৮৭-বর্তমান)।
মুখ্য শব্দগুচ্ছ: শিক্ষকতা, গবেষণা, অর্থনীতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি, পাকিস্তান আমলে বৈষম্য, স্বাধীনতা-উত্তর নীতি প্রণয়ন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হার্ভার্ড থেকে অর্থনীতির ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন শেষে ১৯৫৫ সালের মধ্যভাগে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি। অর্থনীতি বিভাগকে তখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রথমত, যোগ্য শিক্ষকের প্রচণ্ড অভাব। কারণ বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ শিক্ষক, যাঁরা হিন্দু ছিলেন, তাঁরা ১৯৪৭ সাল এবং তার পরপরেই ভারতে চলে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, পুরোনো পাঠ্যসূচি যেখানে অর্থনীতিবিষয়ক সাম্প্রতিক জ্ঞানের শাখাগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
আমার প্রথম কাজ ছিল পাঠ্যসূচিকে আধুনিকায়ন করা। আমি সেটা ব্যাপক আকারেই করেছিলাম, বিশেষ করে অর্থনৈতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে (ব্যষ্টিক, সামষ্টিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য)। জ্যেষ্ঠ শিক্ষক না থাকায় বিএ সম্মান ও এমএ স্নাতকোত্তর উভয় শ্রেণিতেই প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা একটানা পড়াতে হতো। এর মধ্যেই আমাকে পাঠ্যসূচি আধুনিকায়নের কাজ করতে হয়েছিল। সে সময়ে পড়ানোর দায়িত্ব খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হতো এবং শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি ছোট ছোট দলে ছাত্রছাত্রীদের টিউটরিয়াল ক্লাসও নিতে হতো। ছাত্রছাত্রীদের কাছে একজন শিক্ষকের বিধিসম্মত নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে এই কাজকে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু আমরা যেটুকু জানি যে বর্তমান পরিস্থিতি তখনকার তুলনায় সুদূরপরাহত।
একইভাবে, গবেষণায় যুক্ত হওয়াটা তখনকার দিনে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হতো। বেশির ভাগ শিক্ষকই, বিশেষ করে তরুণ ও উচ্চ প্রশিক্ষিতরা, অল্পবিস্তর গবেষণাকে তাঁদের বাধ্যবাধকতা বলেই মনে করতেন। শিক্ষকদের এসব গবেষণা প্রকাশের একটা জায়গা ছিল পাকিস্তান অর্থনৈতিক জার্নাল (পাকিস্তান ইকোনমিক জার্নাল )। পাকিস্তান অর্থনীতি সমিতি এটা প্রকাশ করত। এর সম্পাদকীয় কার্যালয় ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ। পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্যেষ্ঠ ও সুপরিচিত শিক্ষকেরা এর সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
যদিও আমাদের বিভাগে বিদ্যমান বিদ্যায়তনিক পরিবেশে আমার আগ্রহ ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর, কিন্তু গবেষণার ধারণা ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা বা আন্তযোগাযোগ করার মতো সমমনা গ্রুপ না থাকায় আমি ভাবলাম জাতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে কাজ করব, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে। আমার কিছু সহকর্মী ছিলেন, যাঁরা গ্রামীণ অর্থনৈতিক জরিপ পরিচালনা করেছিলেন। সেসব জরিপে সংগৃহীত উপাত্ত নিয়ে আমি গবেষণা শুরু করার এবং পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামীণ অর্থনীতি-সম্পর্কিত নির্দিষ্ট অনুমানগুলোকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আসলে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ চাচ্ছিলাম। যথারীতি আমি জরিপে অংশ নিলাম এবং এটা করতে গিয়ে গ্রামের কৃষক-ব্যবসায়ী ইত্যাদির সাক্ষাত্কার নিলাম। এর ফলে দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত পরিচিতি ও জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়। গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল পাটের উত্পাদন ও বাজারজাতকরণ থেকে শুরু করে গ্রামীণ ঋণ ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান। যেসব প্রশ্ন গবেষণা করে দেখা হয়েছে, তার মধ্যে সাপ্লাই চেইনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিযোগিতা বা অন্যথা যা হতে পারে, তার মাত্রাসহ কাঁচা পাটের বাজারজাতকরণ চেইনের কাঠামো; ছদ্ম গ্রামীণ বেকারত্ব বা অনুন্নয়নের ধারণা বিশ্লেষণ; গ্রামীণ পরিবারগুলোর ঋণের উত্স এবং তার ব্যবহার। আমি জেনেছিলাম যে সাধারণভাবে যাদের উত্স মনে করা হয় সেই গ্রামীণ মহাজনেরা ঋণের প্রধান উত্স নয়, বরং বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য সম্পর্ক এবং নিজের সঞ্চয় ছিল প্রধান উত্স। আবার আমাকে বলা হয়েছিল, যখন ধান উত্পাদন বেশি লাভজনক ছিল, তখনো কৃষকেরা পাট উত্পাদন করছিলেন। কারণ পাটের বাজারমূল্যের ব্যাপক ওঠানামার ফলে একটি পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য যে পরিমাণ চাল দরকার ছিল, তা পাট বিক্রি করে চাল কেনার মাধ্যমে নিশ্চিত হতো না। অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদাহরণের মাধ্যমে এ ধরনের ধাঁধা ভালোভাবে বোঝা যাবে।
আমাদের গবেষণায় অর্থায়ন করার জন্য এখনকার মতো সে সময়ে কোনো বিদেশি দাতা যেমন বিদেশি ফাউন্ডেশন বা আন্তর্জাতিক সিভিল সমাজ বা থিংক ট্যাংক ছিল না। গবেষণার প্রকৃত ব্যয় যেমন জরিপের ব্যয় (গবেষণা সহায়তাকারী ও প্রকাশনা ইত্যাদি) অভ্যন্তরীণ উত্স থেকেই মেটাতে হতো। ঋণ ও গ্রামীণ বেকারত্ব বিষয়ে গবেষণায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থায়ন করত, যেমন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং পাট গবেষণার ক্ষেত্রে পাট মন্ত্রণালয়। এসব গবেষণা প্রকল্পের উদ্যোগ আমরাই নিয়েছিলাম, অর্থায়নকারীরা নয়। তারা আমাদের চিন্তাগুলো পছন্দ করেছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান সরকারের গবেষণা খরচে অর্থায়ন করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সামষ্টিক অর্থনৈতিক দিক নিয়ে করা আমার প্রথম গবেষণা পূর্ব পাকিস্তান অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনে করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন সম্ভাবনা ও সম্পদ প্রয়োজনীয়তার ওপর আলোকপাত করে এই গবেষণা অতিরিক্ত প্রধান সচিবের উদ্যোগে নেওয়া হয়েছিল। এটা পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে সম্পদ বরাদ্দ করা নিয়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে দর-কষাকষিতে পূর্ব পাকিস্তান সরকার অনেকবার ব্যবহার করেছিল।
১৯৫০-এর দশকের শেষ ভাগে এবং ১৯৬০-এর দশকের শুরুর দিকে পাকিস্তান সরকার আমাকে পূর্ব-পশ্চিম অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে বেশ কিছু কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়। আন্ত-অঞ্চল সম্পদ বরাদ্দের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে একজন একাডেমিকের জন্য এটা বেশ চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল কর ও কর-বহির্ভূত সম্পদ এবং বিদেশি সাহায্য থেকে পাকিস্তান সরকারের অর্জিত আয় পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে আয়বৈষম্য কমানোর উদ্দেশ্যে দুই অঞ্চলের মধ্যে বণ্টন করা। কমিশনে এই বিষয়ে বিস্তর বিতর্ক ছিল। প্রথমত, আয়বৈষম্য কীভাবে পরিমাপ করা হবে এবং দ্বিতীয়ত, আয়বৈষম্যের ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের প্রভাব কীভাবে পরিমাপ করা হবে। প্রথম বিষয়কে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত আলোচনা হয় এবং বলা হয় বৈষম্যের মাত্রা নির্ণয়ের জন্য কোন অঞ্চলের আয়কে ভিত্তি ধরা হবে? পূর্বের না পশ্চিমের? স্পষ্টতই, যেহেতু পশ্চিমের আয় বেশি ছিল তাই এটাকে ভিত্তি ধরলে পশ্চিমের তুলনায় পূর্বের আয়ের যে ঘাটতি তার শতাংশ কম আসবে। কিন্তু যদি পূর্বের আয়কে ভিত্তি ধরা হয় তাহলে পূর্বের চেয়ে পশ্চিমের আয় উদ্বৃত্ত বেশি আসবে। কমিশনে পশ্চিমের সদস্যরা প্রথম পদ্ধতিকে নিতে চাচ্ছিল, কারণ এতে করে জনগণের কাছে বৈষম্য কম বলে প্রমাণ করা যাবে। বিকল্প হিসেবে তারা চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে সমগ্র পাকিস্তানের আয়ের গড় উদ্বৃত্ত পরিমাণ দিয়ে বৈষম্য পরিমাপ করতে। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আয়ের উদ্বৃত্ত শতাংশ স্বাভাবিকের চেয়ে কম মনে হবে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে তিন ধরনের পদ্ধতিই কমিশনের প্রতিবেদনে দেওয়া হবে। বর্তমান সময়ে এই বিতর্ক অর্থনৈতিক যুক্তির বিচারে হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু এখানে রাজনীতিটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ পশ্চিমের সদস্যরা জনগণের কাছে বৈষম্যের পরিমাণ যতটুকু সম্ভব কম দেখাতে চাচ্ছিল।
দ্বিতীয়ত, অতিরিক্ত সম্পদ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সক্ষমতা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক ছিল। বিদেশি সাহায্য কাজে লাগানো বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা নিয়ে এই বিতর্ক এখনো রয়ে গেছে। তখন সিদ্ধান্ত হলো যে সম্পদ কাজে লাগানোর সক্ষমতা তার ব্যবহার থেকে আলাদা নয়। যদি সক্ষমতা কম থেকেও থাকে, তাহলে সেটা অতিরিক্ত সম্পদ দিয়ে বাড়ানো যাবে।
রাজনৈতিক অর্থনীতিতে অভিজ্ঞতা অর্জন ছাড়াও কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন কর ও কর-বহির্ভূত রাজস্ব সম্পর্কে বিস্তর মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলাম। করারোপণের প্রভাব ও ব্যাপ্তির প্রাক্কলনসহ করব্যবস্থার প্রশাসনিক সমস্যাগুলো নির্দেশের শর্তাদির (টিওআর) মধ্যেই ছিল। আবার, মূলধন ব্যয় ও বর্তমান ব্যয়ের সঙ্গে উন্নয়ন ব্যয় ও উন্নয়নবহির্ভূত ব্যয়ের বিভাজন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল। অভিন্ন সংজ্ঞার ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছাতে হতো যেন সেগুলো অভ্যন্তরীণ বাজেট ও বিদেশি সাহায্য বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়।
স্বাধীনতা-উত্তর পরিকল্পনা কমিশনে যখন আমি আর্থিক ব্যবস্থা ও বাজেট-প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছিলাম, তখন এই অভিজ্ঞতা খুবই কাজে লেগেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের এই সময়ে আমি পূর্ব পাকিস্তানের নির্ধারিত কিছু বৃহদাকার শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ায় যুক্ত ছিলাম। এ জন্য আমাকে সর্বনিম্ন মজুরির অর্থনীতির ওপর পড়াশোনা করতে হয়েছিল এবং কিছু উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নিতে হয়েছিল।
একই সময়ে খাদ্যশস্য ও এর বাইরে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যদ্রব্যসহ অনেক রকমের ভোগ্যপণ্যের জন্য ভোক্তা চাহিদা ক্রিয়ার বেশ কিছু হিসাব এবং বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা প্রক্ষেপণের জন্য সবচেয়ে সঠিক গুণাঙ্ক বাছাইয়ের মাপকাঠির ওপর আমার একটা গবেষণা ছিল। পূর্ব পাকিস্তান পরিসংখ্যান ব্যুরোর বেশ কয়েক বছর ধরে করা খানা আয়-ব্যয় জরিপের খুবই প্রগাঢ় বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে এটা করা হয়েছিল।
যেহেতু অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগে বিভিন্ন গবেষণা করা হচ্ছিল, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার জন্য একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করলাম। খুবই সীমিত আকারে স্থান ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধাসহ ওভারহেড সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে রাজি করানো গিয়েছিল। অধ্যাপক আতাউর রহমান ছিলেন বাণিজ্য বিভাগের প্রথম চেয়ারম্যান এবং আমি ছিলাম দ্বিতীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বা তিন বছর পড়ানোর পর অর্থনীতিবিষয়ক সাম্প্রতিক জ্ঞানের শাখাগুলোর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম। কারণ আমার মনে হয়েছিল, ঢাকায় থাকার কারণে আমি উন্নত দেশগুলোয় পড়ানো ও গবেষণার কেন্দ্র থেকে অনেক দূরে আছি, তাই সেকেলে হয়ে পড়ছিলাম।
সে সময়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে গাণিতিক ও পরিসংখ্যানগত পদ্ধতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অর্থনীতিতে রৈখিক প্রোগ্রামিং তখন ছিল সময়ের উন্মাদনা। ম্যাট্রিকস বীজগণিতের কোনো জ্ঞানই আমার ছিল না। পরিসংখ্যান বিভাগের আমার এক সহকর্মীকে অনুরোধ করেছিলাম, সে যেন আমাকে ম্যাট্রিকস বীজগণিত শেখায়। সাম্প্রতিক সংযোজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার আগ্রহের কারণে আমি নুফিল্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ (Nuffield Foundation Fellowship) পেয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমাই। প্রথমে যাই লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে। সেখানে ম্যাট্রিকস বীজগণিতের ওপর দখল নেওয়া এবং অর্থনীতিতে রৈখিক প্রোগ্রামিংয়ের ওপর প্রথম শ্রেণির রচয়িতা স্যামুয়েলসন, সলো ও ডর্ফম্যানের লেখা পড়ার চেষ্টা করি। তারপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়োগিক অর্থনীতি বিভাগের দিকে এগোই এবং অধ্যাপক রিচার্ড স্টোনের সংস্পর্শে এসে জাতীয় আয় হিসাবরক্ষণ বিষয়ে সাম্প্রতিক সংযোজন ও পরিশোধনের সঙ্গে নিজের পরিচিতি ঘটাই। রিচার্ড স্টোন ছিলেন তখনকার সময়ে জাতীয় আয় হিসাবরক্ষণ বিষয়ে নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত। লন্ডনে আমি শিক্ষকদের জন্য আয়োজিত লিওনেল রবিনসের উচ্চতর সেমিনারে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই। এটা অর্থনীতির শিক্ষকদের জন্য আয়োজন করা হতো। লিওনেল রবিনস ছিলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের দীর্ঘদিনের পরিচালক। অর্থনীতির প্রকৃতি ও তাত্পর্যের ওপর সুবিখ্যাত গ্রন্থেরও তিনি রচয়িতা। প্রতি দুই সপ্তাহে একজন শিক্ষককে অর্থনীতির সাম্প্রতিক সুপরিচিত অবদান নিয়ে একটা বিস্তারিত পর্যালোচনা করতে হতো এবং তার ফলাফল সেমিনারে উপস্থাপন করতে হতো। একই সময়ে অন্য দুজন শিক্ষককে সেই পর্যালোচনার মন্তব্যসহ প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হতো এবং একই বিষয়ে অন্যান্য গবেষণা বা নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ের ওপর সম্পাদিত গবেষণার প্রেক্ষাপটে এই পর্যালোচনার ফলাফলকে মিলিয়ে দেখতে হতো। সেমিনারের অন্য সদস্যদের অবাধ আলোচনার মাধ্যমে এটা করা হতো। আমার মনে হয় অর্থনীতিবিষয়ক সাম্প্রতিক জ্ঞানের শাখাগুলোর সঙ্গে শিক্ষকদের পরিচয় ঘটানোর জন্য এটা খুবই ব্যাপক ও কার্যকর পন্থা ছিল।
যুক্তরাজ্যে থাকার পর আমি নেদারল্যান্ডস ইকোনমিক ইনস্টিটিউটে (এনইআই) কয়েক মাস কাটাতে চলে যাই। জ্যান টিনবারজেনের গবেষণা সেমিনারে অর্থনৈতিক নীতিতত্ত্ব বিষয়ে সে সময়ে ব্যাপক আলোচনা হতো, যে বিষয়ে টিনবারজেন নেতৃস্থানীয় অবদান রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক। তিনি পরবর্তী সময়ে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। অর্থনৈতিক নীতির লক্ষ্য ও বাস্তবায়ন পন্থার মধ্যে সম্পর্কের সবগুলো দিক নিয়ে যে কয়জন অনাবাসিক ফেলো বাগিবতণ্ডা করেছিলেন, আমি ছিলাম তাঁদের মধ্যে একজন। নীতিনির্ধারণে যতগুলো লক্ষ্য থাকবে, ঠিক ততগুলোই বাস্তবায়ন পন্থা থাকতে হবে—এই তত্ত্ব তখন তুঙ্গে ছিল। দুটি লক্ষ্য অর্জন করতে একটি বাস্তবায়ন পন্থা ব্যবহার করাটা ছিল অদক্ষ এবং লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ পদ্ধতি। জ্যান টিনবারজেন এটা গাণিতিক সূত্রের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যেমন সমীকরণের কোনো ব্যবস্থার সমাধানের জন্য যতগুলো স্বাধীন চলক থাকবে, ততগুলোই সমীকরণ থাকতে হবে। যদি সমীকরণের চেয়ে চলক বেশি থাকে, তাহলে কিছু চলক পুনরাবৃত্তিমূলক হবে। আবার যদি চলকের চেয়ে সমীকরণ বেশি হয়, তাহলে কোনো সমাধানই আসবে না। এই ইনস্টিটিউটে থাকাকালেই আমি পাকিস্তান অর্থনীতির জন্য স্বল্পমেয়াদি ইকোনমেট্রিকের ওপর বই লেখা সম্পন্ন করি।
পাকিস্তান উন্নয়ন অর্থনীতি ইনস্টিটিউট (পিআইডিই)
দশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পর ১৯৬৪ সালের শেষের দিকে করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে (পিআইডিই) যোগ দিই। তখন পর্যন্ত এর পরিচালনার দায়িত্ব ছিল বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের হাতে। তাঁরা প্রধানত পাকিস্তান সরকারকে দেওয়া ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদানের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ছিলেন। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদানের শর্ত ছিল ইনস্টিটিউটের নেতৃত্ব কোনো পাকিস্তানিকে গ্রহণ করতে হবে। এই ইনস্টিটিউটের নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক এমন কোনো উচ্চ প্রশিক্ষিত পশ্চিম পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। কারণ এটা ছিল একটা আধা সরকারি ছোট গবেষণা ইনস্টিটিউট, যার প্রশাসন বা নীতিনির্ধারণে কোনো দৃশ্যমানতা ছিল না। যে কারণে একজন পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদকে বাছাই করা হলো, যিনি স্বনামধন্য মার্কিন অর্থনীতিবিদদের কাছেও সুপরিচিত ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে পিআইডিই আলাদা ছিল, কারণ এখানে কোনো পড়ানোর কাজ ছিল না, শুধুই গবেষণা। বাণিজ্য, বিদেশি বিনিয়োগ, সাহায্য ইত্যাদির মতো আমার আগ্রহের বিষয়ে গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত রসদ আমার আওতাধীন ছিল। আমার আগের বিদ্যায়তনিক পরিবেশের তুলনায় এখানকার পরিবেশ অনেক ভালো ছিল। এখানে নামীদামি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই-তিন বছরের জন্য আবাসিক অর্থনীতিবিদেরা থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার ফলে এবং আমাদের পারস্পরিক আগ্রহের বিষয়ে দৈনন্দিন আলোচনা ও বিতর্ক থেকে আমি লাভবান হতে পারতাম। এ ছাড়া সেখানে স্বল্পমেয়াদি অনাবাসিক পণ্ডিতেরা আসতেন। তার বাইরে, কিছু স্বনামধন্য বিদেশি অর্থনীতিবিদ যেমন জ্যান টিনবারজেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্টিন রবিনসন, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লয়েড রেইনল্ডস এবং অন্যদের সমন্বয়ে একটি বিদেশি উপদেষ্টা দল ছিল, যারা একটানা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত এসে থাকত এবং আমাদের গবেষণা কর্মসূচি ও প্রকাশনার ওপর পর্যালোচনা, মন্তব্য ও পরামর্শ দিত।
একই সময়ে করাচিতে নীতিনির্ধারণ-বিষয়ক একটি অতিরিক্ত বিদেশি গবেষক দল ছিল, যার মধ্যে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে সংযুক্ত হার্ভার্ড উপদেষ্টা দল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সাহায্য মিশনের বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ ছিলেন। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ননীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল।
আমার নতুন পেশাগত পরিবেশের এসব বৈশিষ্ট্যের ফলে আমি দেশের বাইরের উচ্চতর শিক্ষাকেন্দ্রে অর্থনৈতিক পেশায় নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছিলাম। সরকারের দেওয়া সম্পদ ছিল অবাধ এবং বিশেষত্ব ও পাকিস্তানের নীতিবিষয়ক অগ্রাধিকার অনুযায়ী গবেষণার বিষয় নির্বাচন করতেন গবেষকেরাই; যার জন্য দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রয়োজন ছিল। ফোর্ড ফাউন্ডেশন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কর্মসূচির মাধ্যমে বিদেশি উপদেষ্টা, লাইব্রেরি ও সরঞ্জামাদির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অনুদান দিয়েছিল। এ ছাড়া অনেক বৃত্তি দিয়েছিল, যার মাধ্যমে ইনস্টিটিউট ও দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদদের প্রশিক্ষিত করার জন্য দেশের বাইরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের বন্দোবস্ত করা যেত।
এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছিল পরিচালক ও তাঁর জ্যেষ্ঠ কর্মীদের হাতে। বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও সরকারের ঘোষিত নীতি ছিল, যদিও পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের প্রধানেরাই পরিচালনা পর্ষদের প্রধান ছিলেন, যেখানে অর্থসচিবদের মতো পাকিস্তান সরকারের অর্থনৈতিক মহারথীরা থাকতেন। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সরকারের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পরিচালকের পেশাগত সিদ্ধান্তে বোর্ডের হস্তক্ষেপ না করার নীতি আংশিক কার্যকর ছিল। এখনকার প্রেক্ষাপটে অবাস্তব মনে হলেও সাহায্যের শর্তের মাধ্যমে এমন অতুলনীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ায় সে সময়ের কিছু বিতর্কিত নীতি বিষয়েও আমরা গবেষণা করতে পেরেছিলাম, যা পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের ব্যাপারে সমালোচনামূলক ছিল। বাণিজ্য, সাহায্য, ও বিনিয়োগের মতো আগ্রহের প্রাথমিক বিষয়ে আমি গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি দেশে-বিদেশে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলাম। এসব নিবন্ধের বিষয় ছিল কারখানাজাত শিল্পের তুলনামূলক ব্যয় এবং তাদের প্রতিযোগিতা, রপ্তানি প্রণোদনার যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা এবং রপ্তানি সক্ষমতা, বিভিন্ন রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যয় ইত্যাদি। পাকিস্তানের উন্নয়নে বিদেশি সাহায্যের সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাবের বিশ্লেষণসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতার ওপর সাম্প্রতিক চিন্তাভাবনার মূল্যায়ন নিয়েও সে সময় আমি লিখেছি। সেই সময় লুইজের শ্রমের অসীম জোগান-তত্ত্ব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমবাজারে মজুরির সন্ধিক্ষণ ইত্যাদি বেশ আলোচিত হচ্ছিল। আমি এর সীমাবদ্ধতা ও নীতি-সংশ্লিষ্টতাসহ পুরো গবেষণাক্ষেত্রটির মূল্যায়ন করেছিলাম। আমার গবেষণার গুণগত মান এবং পরিমাণের দিক থেকে ইনস্টিটিউটের সময়কাল ছিল আমার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে উত্পাদনশীল সময়।
একই সময়ে পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর করা ইনস্টিটিউটের কিছু গবেষণার ফলাফল ছিল খুবই বিতর্কিত। প্রথমবারের মতো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের হিসাব আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয়। এর আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আয়ের সঠিক হিসাব সর্বসাধারণের জন্য সহজলভ্য ছিল না। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে আয়বৈষম্য রাজনৈতিকভাবে খুবই উত্তপ্ত বিষয় ছিল। কারণ পূর্ব পাকিস্তান সে সময় পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি বন্ধে এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ ও নীতি প্রণোদনার উল্লেখযোগ্য পুনর্বণ্টনের দাবি জানাচ্ছিল। একই সময়ে, কৃষি ও শিল্পের তুলনামূলক কর্মক্ষমতা বিষয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিয়ে ইনস্টিটিউট থেকে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরণমূলক বিষয়ে গবেষণা স্বাভাবিকভাবেই তারা ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু নামীদামি বিদেশি বিদ্যায়তনিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভালো সংযোগ থাকায় ইনস্টিটিউট সুরক্ষিত ছিল, যার ফলে আমাদের উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণা নিশ্চিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব এসব নিবন্ধ দ্বারা মোটেও ভীত ছিল না, কেননা এগুলো ছাপা হতো ইনস্টিটিউটের জার্নালের মতো বিদ্যায়তনিক জার্নালে, যা জনসাধারণের কাছে পৌঁছাত না। জনসাধারণ বা রাজনীতিবিদেরা এ ধরনের গবেষণা সম্পর্কে জানতেন না অথবা জানলেও তাঁরা সেগুলো পড়েননি। অধিকন্তু, এসব নিবন্ধ যদি কোনো কারণে রাজনৈতিক আলোচনায় জায়গা নেওয়ার মতো বিপর্যয়পূর্ণ অবস্থায় চলে যেত, তাহলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের ছিল। প্রকৃতপক্ষে, সময়ের আবর্তে এসব গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন সভায় আলোচনা হতো, যা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করার ফলে পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে পরিচিতি পেয়েছিল। আমাদের জীবনে এর কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বৈরী প্রভাব পড়েনি। আমার মনে হয়, ক্ষমতাসীন এলিটদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নিরাপত্তাহীনতা ছিল না, যার ফলে তারা আমাদের মতো একাডেমিকদের দমন করতে চায়নি—অন্তত যত দিন পর্যন্ত না আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গতিবেগ আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছি।
প্রথম বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন
১৯৭০ সালের শেষের দিকে পিআইডিইর প্রধান কার্যালয় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। আমি ১৯৬৯ সালের মার্চের পর থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম, এমনকি যখন আমি পিআইডিইর পরিচালক ছিলাম, তখনো। তত দিনে বিদ্যায়তনিক নিরপেক্ষতার রেখা অতিক্রম করে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে গিয়েছিলাম। ফলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বরতা শুরু হওয়ার পর থেকে ডিসেম্বরে স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত নির্বাসনে ছিলাম। ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সহকারী চেয়ারম্যান নিযুক্ত হই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে পরিকল্পনা কমিশনে নিযুক্তি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ ছিল, যেখানে আমার কাজ ছিল নীতিনির্ধারণ এবং রাজনীতিবিদদের পরামর্শ দেওয়া। এই কাজ দ্বিগুণ কঠিন ছিল, যেহেতু আমি একটি নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরিতে যুক্ত ছিলাম, যেমন পরিকল্পনা কমিশনকে সরকারের অংশ করা। আমরা প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম এবং ইনপুট-আউটপুট কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতির জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক নমুনা নির্মাণ করেছিলাম। সহকারী চেয়ারম্যান হিসেবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো এবং এর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সংশ্লিষ্ট প্রক্ষেপণ ও নীতি সুপারিশ বিষয়ে আমার তদারকির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় তার অনুসরণ ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদি পরামর্শ-প্রক্রিয়া। এই পরামর্শ-প্রক্রিয়া শুধু অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করলেই হতো না, বরং খাতভিত্তিক কর্মসূচি ও নীতি বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও করতে হতো। নির্দিষ্ট কর্মসূচি ও নীতি বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বিস্তর দর-কষাকষি ও আলোচনার ভার ছিল কমিশনের সদস্যদের ওপর।
পরবর্তী কাজে আমাকে প্রথমে যে শিক্ষাটা নিতে হয়েছে তা হলো, রাজনীতিবিদদের উপযোগী ভাষায় অর্থনৈতিক ও নীতি-সম্পর্কিত বিষয়গুলো ব্যাখ্যা ও আলোচনা করার কৌশল রপ্ত করা। এটা খুব কঠিন কাজ হলেও আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় নির্দিষ্ট নীতিনির্ধারণী বিষয়ে আলোচনা করার কাজে আমি ধীরে ধীরে উন্নতি করেছি। সব সময় প্রত্যেক মন্ত্রণালয় তাদের উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য আরও বেশি সম্পদ দাবি করত। তবে সব মন্ত্রণালয়ের সম্পদের দাবি একত্র করলে আয়ত্তগত সামষ্টিক সম্পদের যোগফলকে অতিক্রম করে যেত। কিন্তু তারা কর রাজস্ব বাড়াতে আগ্রহী ছিল না। মন্ত্রিপরিষদে দর-কষাকষির প্রক্রিয়া সব সময় সুখকর ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, আলোচনা ও দর-কষাকষি সাপেক্ষে সম্পদের বরাদ্দ বিষয়ে একমত হওয়ার পরিবর্তে বেশির ভাগ সময়ে মন্ত্রীরা তাঁদের দ্বান্দ্বিক দাবির ভিত্তিতে সম্পদ পুনর্বরাদ্দের দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়ে দিতেন। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের জন্য এটা সহজ রাস্তা ছিল, কারণ এর ফলে তাঁরা সহজেই তাঁদের নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপূর্ণ দাবিদাওয়া মোকাবিলায় বলির পাঁঠা খুঁজে বের করতে পারতেন।
আমার জন্য দ্বিতীয় শিক্ষা ছিল এটা বোঝা যে নীতিনির্ধারণীতে যেটা একজন অর্থনীতিবিদের জন্য যৌক্তিক ও অকপট পছন্দ বলে মনে হতো সেটা রাজনীতিবিদদের জন্য ততটা অকপট ছিল না। একজন অর্থনীতিবিদ যখন কোনো সমস্যার সমাধান দেন বা নীতি সুপারিশ করেন, তখন তিনি তাঁর নীতিবিধানের রাজনৈতিক সম্ভাব্যতা বিবেচনা করেন না। যাহোক, রাজনৈতিক সম্ভাব্যতা বিবেচনা না করে কোনো অর্থনীতিবিদ পরামর্শ দিলে প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সম্ভবত গ্রহণ করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ সারে ভর্তুকির কথা বলা যায়। কৃষকদের মধ্যে এই পদক্ষেপ খুবই জনপ্রিয় ছিল। ক্ষমতাসীন দল মধ্যস্বত্বভোগী কৃষকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল, যারা দীর্ঘ সময় ধরে সারে ভর্তুকি পেয়ে আসছিল। সরকার-নিয়ন্ত্রিত বিতরণব্যবস্থার বাইরে বিক্রির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সার বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং ভর্তুকি বেশির ভাগ সময়েই ক্ষুদ্র কৃষকের পরিবর্তে বড় কৃষকদের কাছে যেত। এটা প্রমাণিত হওয়ার পরও রাজনীতিবিদেরা এই নীতি চলমান রেখেছিলেন। অধিকন্তু, সার ভর্তুকির মতো স্বল্পব্যয়ের ইনপুট নীতির অনুপস্থিতিতে খাদ্য উত্পাদন লাভজনক রাখতে ভর্তুকি যখন চালু করা হয়, সে সময়ের চেয়ে খাদ্যমূল্য বেশি ছিল। একই সঙ্গে, সাপ্লাই চেইনের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই সরকারের মূল সমর্থক ছিলেন। ভর্তুকিতে এত বেশি বিনিয়োগ করার ফলে কৃষির অন্যান্য খাত যেমন সেচ বা সম্প্রসারণসেবায় বিনিয়োগ কমে গেছে, এ যুক্তি দেওয়ার পরও সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়েনি। তারা ভীত ছিল এই ভেবে যে ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে খাদ্যের জোগানে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ঝুঁকি নিতে তারা আগ্রহী ছিল না। তারা ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে চাচ্ছিল। যেমন ভর্তুকি এমন সময় কমানো, যখন অন্যান্য আধুনিক কৃষি উপাদান যেমন উচ্চফলনশীল বীজ, ক্ষুদ্র কৃষকসহ সব কৃষকের জন্য কৃষিঋণের ব্যবস্থাসহ সারের জোগান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।
আরও একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, যেমন খাদ্যে ভর্তুকি। এই ভর্তুকি সরকারি বিতরণব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের চারটি বড় শহরের কেন্দ্রে সবাইকে দেওয়া হতো, যেখানে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সব কর্মী, নিম্ন আয়ের সরকারি কর্মচারী এবং দেশের সব শিল্পশ্রমিক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ভর্তুকির সবচেয়ে বড় বোঝাটা ছিল শেষোক্ত দুই শ্রেণির জন্য, বিশেষ করে শিল্পশ্রমিকদের জন্য। তাঁরা ট্রেড ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভর্তুকি কমানোর কোনো উদ্যোগ নিলে ট্রেড ইউনিয়নগুলো যদি তা মেনে না নিত এবং সামষ্টিক ব্যবস্থা গ্রহণ করত, তাহলে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারত। ভর্তুকি-ব্যবস্থায় গলদ ছিল, কারণ ভর্তুকির খাদ্য অন্যদের কাছে বিক্রি করা হতো এবং সরকারি বিতরণব্যবস্থার খরচও বেশি ছিল। সুতরাং ভর্তুকির পরিবর্তে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বাড়ালে কার্যকারিতা বাড়ত। এর ফলে বিনা বাধায় শ্রমিকেরা তাঁদের প্রয়োজনীয় খাদ্য অধিকার নিশ্চিত করতে পারতেন। এতে খাদ্য বিতরণের খরচ এড়িয়ে সরকারের সম্পদ রক্ষা পেত এবং ভর্তুকির জন্য যারা যোগ্য নয়, তাদের কাছে খাদ্য বিক্রি বন্ধ হতো।
শিল্পশ্রমিকেরা কয়েকটি যুক্তিতে এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। প্রথমত, খাদ্যে ভর্তুকি বন্ধের বিপরীতে প্রকৃত মজুরি বাড়িয়ে সামঞ্জস্যতা আনার ক্ষতিপূরক পদ্ধতিটি তারা বুঝতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, সব শিল্প-মালিক যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না এবং এতে মালিকদের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে হতো। যদি অবাধ্য মালিকেরা তা বাস্তবায়ন না করেন, তাহলে তাঁদের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ বেধে যেতে পারত। তৃতীয়ত, তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না যে ভবিষ্যতে অন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় এলে এই ক্ষতিপূরকপদ্ধতি অনুসরণ করবে কি না এবং যদি করেও তাহলে সেটা প্রয়োজনীয় মাত্রায় করবে কি না। বেশ কয়েক বছর ধরে নির্দিষ্ট পরিমাণের রেশন খাদ্যব্যবস্থা চলে আসায় সংশ্লিষ্ট সবাই এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। যেহেতু এই প্রস্তাব শিল্পশ্রমিকেরা বাতিল করে দিয়েছিলেন এবং বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না, তাই নিম্ন আয়ের সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও তা আর প্রযোজ্য ছিল না। উপরিউক্ত দুটি উদাহরণে দেখা যায়, কীভাবে রাজনৈতিক অর্থনীতি বিবেচনা বা রাজনৈতিক বাস্তবায়নযোগ্যতার অভাবে পেশাগতভাবে সঠিক অর্থনৈতিক নীতি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
সামষ্টিক অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-তত্ত্ব ও নীতিতে বিশেষায়িত অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি ইনপুট-আউটপুট বিশ্লেষণনির্ভর সামষ্টিক অর্থনীতি মডেলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম, যা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ছাড়া সহকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় আমি অর্থনৈতিক নীতিপত্র প্রণয়ন করার ব্যাপারে সুপরিচিত ছিলাম। যা হোক, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে মন্ত্রিপরিষদ এবং উন্নয়ন কর্মসূচি, অর্থনৈতিক নীতি অথবা সম্পদ বরাদ্দ বিষয়ে প্রভাব রয়েছে, এমন বিভিন্ন কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যার ফলে আমাকে মন্ত্রিপরিষদের আলাপ-আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হতো, যেখানে বিভিন্ন খাতভিত্তিক বিষয়ে আলোচনা হতো। আলোচনার বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল কৃষি খাতে স্বল্প উত্তোলন সেচ, গভীর নলকূপ এবং অগভীর নলকূপের মধ্যে বাছাইকরণ অথবা সার এবং সেচ প্রকল্পে বিনিয়োগের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রক্ষা, অথবা গ্রামীণ ঋণ এবং ইনপুটের জোগানের মধ্যে সম্পদের বরাদ্দ প্রদান। বিভিন্ন ধরনের মাটির পরিপোষক ও রাসায়নিক অথবা কৃষি সম্প্রসারণ ব্যবস্থার সঙ্গে আমাকে পরিচিত হতে হয়েছিল। প্রথমবারের মতো আমাকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চতর শিক্ষা স্তরের মধ্যে আন্তসম্পর্কের সঙ্গে পরিচিত হতে হয়েছিল, যেখানে এক স্তরের আউটপুট অন্য স্তরের ইনপুট। যেমন প্রত্যেক নিম্নস্তরের আউটপুট তার ওপরের স্তরের জন্য ইনপুট। বিভিন্ন স্তরের ইনপুট ও আউটপুটের মধ্যে সম্পদ বরাদ্দের জন্য সঠিক অনুপাতের ভারসাম্য নির্ণয় করা আমার শিক্ষার অংশ ছিল। পরিবার পরিকল্পনা খাত ছিল আরেকটি উদাহরণ। পরিবারের নারী সদস্যদের কাজের চাপ বিষয়ে এবং নারীদের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ ফলাফল বের করে আনার আলোচনার কথা আমার মনে পড়ে। আমার এখনো সেই নীতির কথা মনে আছে যে কোনো সন্তানের জন্মের ঠিক আগে, জন্মের সময়ে বা জন্মের ঠিক পরে নারীরা পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক বার্তা গ্রহণের জন্য সবচেয়ে বেশি গ্রহণক্ষম থাকে। প্রথমবারের মতো আমি বুঝেছিলাম পুষ্টি একটি বহুমাত্রিক বিষয়, যেখানে শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি সবই আছে। পুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচি সমন্বয় ও একীভূত করার পদ্ধতি কী হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া ছিল আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রকৃতপক্ষে আমাদের পরামর্শে আমরা বলেছিলাম যে পরিকল্পনা কমিশনে পুষ্টি বিষয়ে বিভিন্ন খাতের সমন্বয়ের জন্য একটি আলাদা ইউনিট থাকা প্রয়োজন।
ওপরের উদাহরণগুলো থেকে দেখা যায়, পরিকল্পনা কমিশনে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের নীতি সমন্বয়কারী হিসেবে এবং মন্ত্রিপরিষদ ও বিভিন্ন কমিটির (সরাসরি পরিকল্পনা কমিশনের আওতাধীন না হলেও যেগুলোতে একজন অর্থনীতিবিদের ইনপুট প্রয়োজন ছিল) আলোচনায় একজন অংশগ্রহণকারী হিসেবে আমাকে অর্থনীতির গণ্ডির অনেক বাইরের অন্যান্য বিষয়েও বিচরণ করতে হতো। বিভিন্ন বিষয়ে স্বল্পজ্ঞান বা পরিচিতির মাধ্যমে আমি সব কাজের কাজিতে পরিণত হয়েছিলাম।
বিদেশি সাহায্য বিষয়ে দর-কষাকষি করা ছিল পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্ব। সাহায্যের পরিমাণ ও ধরন নিয়ে দর-কষাকষি করতে হতো। এটা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন ছিল। বিদেশি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত বিষয়ে কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক খাতের মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকর্তাদেরও দায়িত্ব ছিল। আমি সহযোগী নীতি এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ে যুক্ত ছিলাম। এটা ছিল বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কার্যক্ষেত্র। প্রকল্প সাহায্য ছাড়া অন্যান্য সাহায্য যেমন পণ্য সাহায্য এবং অন্যান্য কাঠামোগত সমন্বয়সাধন বা ব্যালান্স অব প্যামেন্ট ঋণে অনেক বেশি নীতি উপাদান ছিল। বিনিময় হারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দর-কষাকষির কথা আমার মনে পড়ে। বাহ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যহীনতা মেটানোর পদ্ধতি হিসেবে পুঁজি নিয়ন্ত্রণ বা বাণিজ্য ও বিনিময় নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে দাতারা সব সময়ই নারাজ ছিল। স্বাধীনতার এক বছর পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে দর-কষাকষি চলছিল, যা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ওপর বিশ্বব্যাংকের করা প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। আমরা বিনিময় হার সমন্বয়সাধনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সাধারণত একমত ছিলাম, কিন্তু মুদ্রা অবমূল্যায়নের মাত্রা ও এর সময় এবং ব্যালান্স অব প্যামেন্ট সাহায্যের নিশ্চয়তা ও এই সাহায্যের পরিমাণ বিষয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয়। খুবই শক্ত এই দর-কষাকষিতে আমরা ঐকান্তিকভাবে প্রস্তুতিপর্বের কাজ করেছিলাম এবং এই কাজে আমরা অবশ্যই ভালো পেশাদারত্বের পরিচয় দিয়েছিলাম। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আমরা বিনিময় হার সমন্বয়ের পরিপূরক হিসেবে আর্থিক ও রাজস্ব নীতির ভূমিকা তুলে ধরেছিলাম। বস্তুত আমরা রাজস্ব ও আর্থিক খাতে ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। যেমন দেশের ভেতরে মাত্রাধিক চাহিদা ও মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমিয়ে ব্যালান্স অব প্যামেন্টের ওপর চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে কর বাড়ানো এবং সরকারি ব্যয় কমিয়ে এনেছিলাম। মুদ্রা অবমূল্যায়নের প্রাক্কালে এ বিষয়ে আমাদের প্রচেষ্টার স্বীকৃতিস্বরূপ কিছু সম্পদপ্রবাহ বা আর্থিক সহায়তা দিতে আমরা দাতাদের অনুরোধ করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, যেহেতু মুদ্রা অবমূল্যায়নের আশু প্রভাব হবে আমদানিমূল্যের বৃদ্ধি, তাই কিছু সাহায্যের প্রবাহ থাকলে আমরা আমদানি বৃদ্ধি করে এ ধরনের প্রভাব ঠেকাতে পারব। অধিকন্তু, খাদ্য আমদানিমূল্য বৃদ্ধি এবং তার ফলে অভ্যন্তরীণ আমদানিমূল্য বৃদ্ধি বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। আমরা অবমূল্যায়ন করার আগে পরবর্তী ফসল উত্পাদন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কারণ প্রত্যাশিত ভালো ফসল উত্পাদিত হলে মুদ্রা অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিমূল্য উচ্চহারে বৃদ্ধি পেলেও তার প্রভাব ঠেকানো যাবে। ইতিমধ্যেই খাদ্য আমদানিমূল্য বাড়তে শুরু করেছিল এবং অভ্যন্তরীণ মূল্যে ঊর্ধ্বগামী চাপ ফেলছিল। এই পর্যায়ে অবমূল্যায়ন মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি করত। যেকোনো ধরনের সাহায্যের জন্য দাতারা অবমূল্যায়নকে পূর্বশর্ত বলে পীড়াপীড়ি করছিল এবং কোনো সাহায্যের প্রবাহ শুরু করার ক্ষেত্রে রাজস্ব ও আর্থিক পদক্ষেপকে তারা ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করছিল না। পরবর্তী ফসল উত্পাদন পর্যন্ত অবমূল্যায়ন না করার ব্যাপারটি আইএমএফ মেনে নিয়েছিল।
সৌভাগ্যক্রমে, আইএমএফের বিনিময় বিধিনিষেধ অধিদপ্তরের উপপরিচালক, যিনি বিনিময় হার সমন্বয় আলোচনার প্রধান এবং এশিয়া বিভাগের পরিচালক হার্ভার্ডে থাকাবস্থা থেকেই আমার পরিচিত ছিলেন। হার্ভার্ডে তাঁরা আমার সিনিয়র ছিলেন। আলোচনার জন্য উপপরিচালক ঢাকায় এসেছিলেন এবং বিশ্বব্যাংকও তাঁদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, তবে আইএমএফের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। মুদ্রা অবমূল্যায়ন করার সময়ের ব্যাপারটি মেনে নিলেও, অন্য দুটি বিষয়ে তারা অনড় ছিল। অবশ্য অবমূল্যায়নের মাত্রার ব্যাপারে অনড় থাকার তেমন একটা সুযোগ তাদের ছিল না।
আইএমএফের কর্মকর্তারা একমত হয়েছিলেন যে অবমূল্যায়নের মাত্রার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট গাণিতিক নমুনা ছিল না। বিনিময় হার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির চাহিদা-জোগান প্রতিক্রিয়ার আনুমানিক হিসাব এবং সহায়ক পদক্ষেপগুলোর সম্মিলিত চাহিদার প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে এর মাত্রা নির্ধারণ করা হতো। তিনি আমাদের প্রায়োগিক যুক্তি মেনে নিয়ে বললেন যে নির্দিষ্ট অবমূল্যায়নের মাত্রা প্রসঙ্গে চুক্তির বিষয়টি তাদের ‘বিবেচনা’ এবং আমদানি-রপ্তানি খাতের সাধারণ বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল। শক্তিশালী দাতা ও দরিদ্র গ্রহীতার মধ্যে অসম সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে দাতার এই বিবেচনার ওজন অনেক।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমাকে বললেন যে হয়তো হার্ভার্ডের সেমিনারে তিনি আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হতেন, কিন্তু ঠিক সেটাই তিনি আইএমএফের কর্মকর্তা হিসেবে করতে পারতেন না। তিনি একজন ভারতীয় হলেও আদি বসতি ছিল বাংলাদেশে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার আকুল আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। কিন্তু সেটা বিনিময় হার বিষয়ে কোনো আলোচনা করার জন্য নয়। তিনি শুধু প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলেন, যিনি দুরূহ প্রতিকূলতা পেরিয়ে একটি স্বাধীন জাতির নির্মাতা হয়েছিলেন। আমি তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাই। প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে যথারীতি মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন। তিনি পরে আমাকে বলেছিলেন যে এই মিটিংয়ের প্রতিবেদন যখন তিনি তাঁর ওয়াশিংটন কার্যালয়ে পাঠান, ঊর্ধ্বতনদের চোখে আইএমএফের কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর যোগ্যতা কয়েক ধাপ বেড়ে যায়।
যখন ১৯৭৪ সালের শেষে খাদ্য সাহায্যের প্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৭৫ সালের শুরুতে ফসল উত্পাদন ভালো হয়, তখন বাংলাদেশ মুদ্রা অবমূল্যায়ন ঘটায়, যাতে অবমূল্যায়ন-পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় থাকে। তবে অবমূল্যায়নের বাইরেও আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন আমদানি কর ও রপ্তানি প্রণোদনা চালু করতে হয়েছিল।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)
পরিকল্পনা কমিশনে থাকাকালীন আমি একটি দেশের পূর্ণাঙ্গ ও সার্বিক অর্থনৈতিক নীতি বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছি এবং সামাজিক ও অর্থনীতির বাইরেও অন্যান্য বিষয়ে ভাসা-ভাসা জ্ঞান লাভ করেছিলাম। এফএওর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভাগের সহকারী মহাপরিচালক হিসেবে আমাকে শুধু একটি খাত নিয়েই কাজ করতে হয়েছিল যেমন খাদ্য ও কৃষি খাত, তবে এর বিভিন্ন উপখাতের ওপর বিস্তর কাজ করতে হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল খাদ্য ও কৃষি খাতের আন্তর্জাতিক দিক এবং জাতীয় খাদ্য ও কৃষিনীতির আন্তর্দেশীয় তুলনা। এ ছাড়া আমাকে আন্তর্জাতিক ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিস্তর যৌথ আলোচনা ও সহযোগিতামূলক প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করতে হতো। অধিকন্তু, আমাকে রোম শহরে এফএওর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কাজ করতে হতো।
১৯৭০-এর দশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কৃষির আন্তর্জাতিক দিক বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণাত্মক ও ধারণাগত যে বিষয়টির মুখোমুখি হতে হয়েছে তা হলো বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তা। আমি বৈশ্বিক খাদ্য ও কৃষিনীতি-বিষয়ক বিশ্লেষণে এবং কৃষিনীতি বিষয়ে আন্তর্দেশীয় তুলনায় যুক্ত ছিলাম, যেমন আউটপুট ও ইনপুটের জন্য বাজারে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। এ ছাড়া আমি ও আমার সহকর্মীরা বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার ধারণা তৈরি করি, যেখানে খাদ্যনিরাপত্তার সব গুরুত্বপূর্ণ দিককে অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। এগুলো ছিল ক. ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য জোগানের নিশ্চয়তা; খ. খাদ্য জোগানের ক্ষেত্রে একটি বছরে সব মৌসুমে এবং আন্তমৌসুম ও আন্তবর্ষীয় আবহাওয়াকেন্দ্রিক বা নীতিকেন্দ্রিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বছরজুড়ে জোগানের স্থিতিশীলতা; এবং গ. স্বাস্থ্য ও পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় মৌলিক খাদ্যে সব মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিত করা। খাদ্যনিরাপত্তার ওপরের সবগুলো দিকেরই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিক ছিল।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার নীতি বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রথমত ছিল কৃষিতে পর্যাপ্ত বাহ্যিক সম্পদের প্রবাহ নিশ্চিত করা, যেমন উন্নয়ন সহায়তা ও বেসরকারি পুঁজি। দ্বিতীয়ত ছিল খাদ্য সাহায্য দেওয়া। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বাণিজ্যনীতি বিশ্লেষণও গুরুত্বপূর্ণ প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ বিশ্ব খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে খাদ্যে ঘাটতি আছে এমন দরিদ্র দেশগুলোর জন্য বিশ্ববাজারে খাদ্যের বাইরেও অন্যান্য রপ্তানির অভিগমন ও খাদ্যের নিশ্চিত সরবরাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এর সব বিষয়েই আমি ও আমার সহকর্মীরা উত্তর-দক্ষিণ বলয়ের দেশগুলোর ভেদাভেদের সম্মুখীন হয়েছিলাম, যেহেতু এই দুই গোত্রভুক্ত দেশগুলোর স্বার্থ এক ছিল না। এখানে বলা ভালো যে এফএওর জন্মলগ্ন থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে নিয়োগ পাওয়া আমিই একমাত্র অর্থনীতিবিদ। আমার ঠিক আগেরজন নিউজিল্যান্ডের ছিলেন। কিন্তু মহাপরিচালকের পদে উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশ থেকেই বছরের পর বছর নিয়োগ পেয়ে আসছিল। আমার সময়ে মহাপরিচালক ছিলেন উন্নয়নশীল দেশ লেবাননের। অন্যান্য কলাকৌশল বিভাগ যেমন কৃষি, প্রাণিসম্পদ, মত্স্য ইত্যাদির প্রধানের পদটিও উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে হাতবদল হতো। যেহেতু এফএওতে অর্থনৈতিক নীতির বিষয়টি এই বিভাগের দায়িত্ব ছিল, তাই পুরো সংস্থার এক-তৃতীয়াংশ বাজেট এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হতো। এই পরিবেশে, আমার আচরণ ও পারফরম্যান্স নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতো, বিশেষ করে উন্নত সদস্যদেশগুলো সেটা করত। সৌভাগ্যক্রমে যেহেতু আমার উচ্চতর শিক্ষা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে এবং উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশেই আমার গবেষণার অভিজ্ঞতা ছিল, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের দুর্গ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে, তাই এই দুই দেশ আমাকে সন্দেহাবসর (বেনিফিট অব ডাউট) দিত।
একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল কৃষি খাতে, বিদেশি সাহায্য দেখভাল করা। ১৯৭৩-৭৪ সালের বিশ্ব খাদ্যসংকটের পরপর এটা বোঝা যাচ্ছিল যে উন্নত দেশগুলো কৃষি খাতে সাহায্যের প্রবাহ বৃদ্ধি করবে। কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি সাহায্যের প্রবাহ বৃদ্ধি প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনীয় সম্পদপ্রবাহের মোটামুটি একটা গাইড হিসেবে সার্বিকভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ৫ শতাংশ বা তার বেশি হারে কৃষি আউটপুট বাড়াতে কী পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, এফএওতে আমাদের তা পরিমাপ করতে হয়েছিল। এটা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কৌশলের আওতায় বিবেচিত হয়েছিল, যেখানে সামষ্টিক বিদেশি সাহায্য হিসেবে উন্নত দেশগুলোকে তাদের জিডিপির শূন্য দশমিক শতাংশ দেওয়ার কথা বলা ছিল। এই লক্ষ্য এবং কৃষিতে বিদেশি সাহায্যের পরিমাপকৃত বাধ্যবাধকতা সহায়তার প্রকৃত বিধান বাস্তবায়িত হয়নি বললেই চলে। আমাদের সাময়িক প্রকাশনাগুলোয় তাদের প্রত্যাশিত পারফরম্যান্সের ঘাটতি তুলে ধরা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই উন্নত দেশগুলোর বদান্যতা যে প্রত্যাশা পূরণ করেনি, সেটা তারা শুনতে পছন্দ করছিল না। একদিকে আমাদের প্রাক্কলন আর অন্যদিকে গ্রহীতাদের বাড়তি সম্পদ কাজে লাগানোর সক্ষমতা বিষয়ে বিতর্ক চলমান ছিল।
অন্যদিকে, খাদ্যসহায়তা একধরনের ভিন্নধর্মী সমস্যার উদ্ভব ঘটায়। দাতা ও গ্রহীতা দেশগুলোর সমন্বয়ে খাদ্যসাহায্য ও নীতি বিষয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল ১. বিশ্ব খাদ্যসাহায্য কর্মসূচির মাধ্যমে বহুপক্ষীয় সাহায্য আনা এবং ২. দ্বিপক্ষীয় সাহায্যের প্রবাহ পরিদর্শন করা। এই জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণ এবং এ সম্পর্কিত দালিলীকরণ ছিল আমাদের বিভাগের দায়িত্ব। অভ্যন্তরীণ খাদ্য উত্পাদনের প্রণোদনার ওপর খাদ্যসাহায্যের নেতিবাচক প্রভাবের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অভ্যন্তরীণ খাদ্যমূল্য কমিয়ে দেওয়া। একটা চ্যালেঞ্জ ছিল গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো এমনভাবে প্রণয়ন করা যেন খাদ্যসাহায্যের মাধ্যমে অর্থায়ন হওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলো (যেমন মূলত গ্রামীণ অবকাঠামো প্রকল্পগুলো) এমনভাবে খাদ্যচাহিদা বৃদ্ধি করতে পারে, যেন তা খাদ্যসাহায্যের মাধ্যমে আসা জোগানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। অন্য কথায়, উন্নয়ন প্রকল্প ও এর ফলে খাদ্যচাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে যে আয় বৃদ্ধি পাবে তা খাদ্য জোগানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যা হোক, যুদ্ধ বা আবহাওয়াঘটিত কারণে শস্য বিপর্যয়ের ফলে খাদ্যঘাটতির মতো জরুরি অবস্থায় খাদ্যমূল্য বেড়ে গিয়ে ক্ষতিসাধন করেছিল। এ রকম অবস্থায় খাদ্য উত্পাদনে প্রণোদনা না দেওয়া কোনো প্রাসঙ্গিক বিষয় হওয়ার কথা নয়। এ ধরনের বিতর্কিত বিষয় সমাধান করার উদ্দেশ্যেই আমাদের বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনা ও গবেষণালব্ধ কেস স্টাডিগুলো প্রণয়ন করতে হতো এবং তা সম্পাদন করতে হতো। খাদ্য উদ্বৃত্ত আছে এমন উন্নত দেশগুলো খাদ্যঘাটতি আছে এমন দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য ডাম্পিংয়ের জন্য অভিযুক্ত হওয়ার শঙ্কায় ছিল এবং সে কারণে অভ্যন্তরীণ খাদ্য উত্পাদন নিরুত্সাহিত হচ্ছিল।
জরুরি অবস্থা ও উন্নয়ন খাদ্যসাহায্য বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফএ) প্রধানের সঙ্গে আমার নিবিড়ভাবে কাজ করতে হতো। ডব্লিউএফএর প্রধান নিশ্চিতভাবেই খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকা উন্নত দেশের নাগরিক ছিলেন। সাহায্যের নির্দেশের প্রসঙ্গে বলা যায়, দাতা দেশগুলোর প্রদত্ত খাদ্যসাহায্যের বরাদ্দের ব্যাপারে দরিদ্র খাদ্যঘাটতিসম্পন্ন দেশগুলোর অগ্রাধিকার ছিল না। মোট কথা, এটা সর্বজনবিদিত ছিল যে সাহায্যের প্রবাহ দাতা দেশগুলোর কৌশলগত ও রাজনৈতিক বিবেচনা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। সাহায্যপ্রবাহ প্রধানত খুব নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য বরাদ্দ হতো না। বিষয়টি ইঙ্গিত করায় দাতা দেশগুলোর কাছে আমি এবং আমার সহকর্মীরা খুব একটা জনপ্রিয় ছিলাম না। বাণিজ্য বিষয়ে উত্তর ও দক্ষিণ বলয়ের দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন আরও বেশি মারাত্মক ও বিতর্কিত ছিল, কারণ বিশ্ব খাদ্যরপ্তানি বাণিজ্যের অধিকতর প্রভাবসম্পন্ন দেশগুলো ছিল উত্তর বলয়ের উন্নত দেশগুলো। যেমন উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া ছিল রপ্তানিকারক এবং আমদানিকারক ছিল প্রধানত দরিদ্র দেশগুলো। অধিকন্তু, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর মূল্য সহায়তানীতি বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের কৃষিপণ্যের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ইইউ মূল্যসহায়তা ও খাদ্য মজুতনীতি অনুসরণ করছিল, যার ফলে পর্যাপ্ত ও স্থিতিশীল অভ্যন্তরীণ জোগান নিশ্চিত হয়েছিল বিশ্ববাজারের চেয়ে বেশি দামে। এ ছাড়া, কৃষি রপ্তানিতে রপ্তানি ভর্তুকিনীতি উন্নয়নশীল দেশগুলোর রপ্তানি নিরুত্সাহিত করছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র তুলার মতো কৃষিপণ্যে এমন নীতি বাস্তবায়ন করেছিল। এফএও এসব নীতি এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর এগুলোর প্রভাব বিশ্লেষণ করেছিল।
বিশ্ববাজারে খাদ্য জোগান ও মূল্যের অস্থিতিশীলতা ছিল। ফলে কিছুদিন পরপর বিশ্ববাজারে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব উন্নয়নশীল দেশেগুলোর দরিদ্র ও বিপন্ন জনগণের ওপর পড়েছিল। এফএওর ফোরামে আন্তর্জাতিক আলোচনায় দরিদ্র দেশগুলোকে স্থিতিশীল খাদ্য সরবরাহ দেওয়া ছিল অগ্রাধিকার বিষয়। বিশ্ব খাদ্য সরবরাহে ওঠানামার প্রভাবকে ভারসাম্যপূর্ণ করতে আমি আন্তর্জাতিক মজুতের জন্য প্রস্তাব প্রণয়নে যুক্ত ছিলাম। দুটি বিকল্প প্রস্তাব আলোচিত হয়েছিল; হয় আন্তর্জাতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মজুতের মালিক হবে এবং ব্যবস্থাপনা করবে অথবা আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বয় করা হবে কিন্তু মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা হবে জাতীয়। আবারও উত্তর-দক্ষিণ বা ধনী রপ্তানিকারক ও দরিদ্র আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। যেহেতু ধনী রপ্তানিকারক দেশগুলোই বেশির ভাগ মজুতের দায়িত্বে থাকবে, তাই শেষ পর্যন্ত এসব কোনো প্রস্তাবই গৃহীত হয়নি। একই রকম প্রস্তাব ২০০৭-০৮ সালের খাদ্যসংকটের সময়েও আলোচিত হয়েছিল এবং যথারীতি বাতিল হয়ে গেছে।
জাতিসংঘের অন্যান্য বিশেষায়িত সংস্থার মতোই এফএওর শাসনপদ্ধতি ছিল এমন যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, যেমন বাজেট ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে সব দেশের সমান ভোট থাকবে। এর মানে ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো কিন্তু বাজেটের অর্থায়ন করা হতো সদস্যদেশগুলোর মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে তাদের মূল্যায়নকৃত অবদানের ওপর ভিত্তি করে। অন্য কথায়, বাজেটের বেশির ভাগ যুক্তরাষ্ট্রকে বহন করতে হলেও পাপুয়া নিউগিনির ভোট যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমান ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বা ইইউ এটাকে অযৌক্তিক দাবি করে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হলো। অতএব তারা বাজেট যতটুকু সম্ভব কম রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখল। প্রতিবছর দুই ধরনের দেশগুলোর মতভেদের কারণে বাজেট অধিবেশন ছিল উত্তেজনাপূর্ণ ও বাজে অভিজ্ঞতাময়। এসব বিতর্কের মুখে আমরা যারা সচিবালয়ে ছিলাম, তাদের বেশ সূক্ষ্ম পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। এফএওর অর্থায়নে বিভিন্ন দেশে টেনিক্যাল সহায়তা প্রকল্পগুলোর বাজেট যত সম্ভব কম রাখার ব্যাপারে ধনী দেশগুলো প্রচুর চাপ দিত। তারা এসব সহায়তা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে দেওয়ার পক্ষে ছিল, যাতে গ্রহীতা ও কলাকৌশল সহায়তার ধরন বাছাই করার স্বাধীনতা তারা পায়। অধিকন্তু, দ্বিপক্ষীয় কলাকৌশল সহায়তার ফলে এফএওর নিয়োগপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের পরিবর্তে এসব দেশ কলাকৌশল সহায়তা প্রকল্পে তাদের নিজেদের নাগরিকদের চাকরির বন্দোবস্ত করেছিল।
খাদ্য ও কৃষি হালচাল নামে এফএওর বার্ষিক প্রধান প্রকাশনার দায়িত্ব ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি বিভাগের, যা অনেক দেশ, অঞ্চল ও সামগ্রিকভাবে সারা পৃথিবীর খাদ্য জোগান ও চাহিদার অবস্থা পর্যালোচনা করত। খাদ্যের জোগান ও চাহিদাকে প্রভাবিত করে এমন বিভিন্ন উপাদানের বিশ্লেষণ এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। একই সঙ্গে, নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলে আবর্তিত খাদ্যাবস্থা ও আসন্ন ঘাটতির হিসাব বিষয়ে মাসিক ও ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন করতে হতো। এফএও খাদ্য তথ্য ও পূর্বসতর্কতা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এসব প্রতিবেদন প্রকাশ করত, যার উদ্দেশ্য ছিল খাদ্যঘাটতির উদ্ভব হলে দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেন তা মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো ১০ বছরব্যাপী বিশ্ব খাদ্য ও কৃষির ওপর আমরা একটি প্রেক্ষিত গবেষণা হাতে নিই। সামষ্টিক অর্থনীতিবিদ, ইকোনমেট্রিশিয়ান এবং কৃষি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে খুবই উচ্চমানের দক্ষ একটি দল আমার সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই গবেষণা করেছিল। এ দলের সঙ্গে যোগাযোগ ও সরাসরি তত্ত্বাবধান করা ছিল আমার জন্য খুবই সন্তুষ্টিজনক বুদ্ধিবৃত্তিক একটি কাজ। এই প্রক্রিয়ায় আমি প্রক্ষেপণ কৌশল বিষয়েও অনেক কিছু শিখেছিলাম।
এফএওতে আমাকে যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে হতো তার মধ্যে ছিল কৃষির কলাকৌশল-সংক্রান্ত বিষয়। এর মধ্যে ছিল সেচ অর্থনীতি এবং বিভিন্ন ধরনের সার ও কীটনাশকের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য, গোত্রভিত্তিক ভূমি অধিকার এবং সমবায় কৃষিসহ বিকল্প মধ্যস্বত্বব্যবস্থার মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়, বিভিন্ন ধরনের সমবায় সমিতি, কৃষক সংগঠন এবং কৃষি শিক্ষা ও সম্প্রসারণব্যবস্থা ইত্যাদি। এ ছাড়া অপুষ্টি ও তা প্রতিরোধের নীতি বিষয়ে জটিল চ্যালেঞ্জ নিয়েও আমাকে ব্যাপকভাবে কাজ করতে হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য জরিপ নামে একটা সাময়িকী প্রকাশনার দায়িত্ব ছিল আমাদের বিভাগের। এই প্রকাশনায় আলাদা আলাদা দেশের, অঞ্চলের এবং সারা বিশ্বের অপুষ্টির মাত্রা হিসাব করা হতো। এর জন্য টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হতো, যারা একদিকে ব্যক্তির পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা এবং অন্যদিকে পুষ্টির জোগানের পরিমাপ করত। এ রকম কাজের ভিত্তিতে প্রত্যেক দেশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ পুষ্টি ও তার জোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধতা পরিমাপ করা হতো। আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘ শিশু অধিদপ্তরের (ইউনিসেফ) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতাম। সে সময়ে ক্যালরি ও প্রোটিনের ওপর জোর দেওয়া হতো। মাইক্রোনিউট্রেন্টের ধারণা ও পরিমাপের বিষয়গুলো তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় আমি কোডেক্স এলিমেন্টারিয়াস কমিশনের প্রধান হয়েছিলাম। এই কমিশন খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করত এবং জাতীয় সরকারগুলো কর্তৃক গৃহীত এবং খাদ্যবাণিজ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আলোচনায় ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা মান প্রস্তুত করেছিল। এগুলো বিভিন্ন দেশের কর্তৃক স্বাস্থ্যসম্মত নিয়মনীতির ভিত্তি হিসেবে কাজে লেগেছিল।
পরিকল্পনা কমিশনে থাকাকালীন আমি সব বিষয়েই ভাসা-ভাসা জ্ঞান অর্জন করেছিলাম, যেখানে অর্থনীতির বাইরে অন্যান্য বিষয়েও প্রাথমিক জ্ঞান ছিল। এফএওতে এসে অর্থনীতির বাইরের বিষয় এবং কৃষি খাত সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল বিষয়ে আমার সম্পৃক্ততা অনেক বেশি বেড়ে যায়।
জাতিসংঘ সংস্থাগুলোর সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে এফএওর কর্মসূচিগুলো সমন্বয়ের কাজটা আমাকে করতে হতো। এসব সমন্বয়ের মধ্যে ছিল আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে গ্রামীণ শ্রমবাজার ও গ্রামীণ অকৃষি খাতে কর্মসংস্থান বিষয়ে; জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের (ইউনেসকো) সঙ্গে গ্রামীণ শিক্ষা বিষয়ে এবং জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সম্মেলন (আঙ্কটাড) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে কৃষিপণ্যের বাণিজ্য বিষয়ে। যেসব কাজে একাধিক বিষয় ছিল সেখানে বিরোধ ও প্রতিযোগিতাও ছিল। প্রত্যেক সংস্থাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে তার প্রাধান্য ও ঊর্ধ্বতনতা জাহির করতে চাইত।
আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি)
রোম শহরে এফএওতে ১০ বছর কাজ করার পর আমি ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ইফপ্রি) যোগ দিই। এফএওর চাকরি থেকে এখানে যোগ দেওয়া একটা তাত্পর্যপূর্ণ রূপান্তর ছিল। এফএওর রোমে অবস্থিত কার্যালয়ে পাঁচটি বিভাগে ১৫০ বা তার কাছাকাছি সংখ্যক কর্মকর্তা এবং টেকনিক্যাল সহায়তা বিশেষজ্ঞ হিসেবে অন্যান্য দেশে আরও ১০০ বা তার কাছাকাছি কর্মকর্তা কাজ করতেন। এই সংস্থার একটি একক বৃহত্ বিভাগে প্রশাসনিক ও তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল আমাকে। উপরোল্লিখিত বহুলসংখ্যক বিষয়ে আলোচনা করার জন্য বিভিন্ন কমিটির মিটিংয়ে অনেক সময় ব্যয় করতে হতো।
ইফপ্রিতে আমার কোনো প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল না। পুরোটা সময়ই গবেষণা ও পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল। গবেষকদের আগ্রহের বিষয় এবং মহাপরিচালক, খাদ্য ও কৃষিনীতির বিশ্লেষক এবং নীতিনির্ধারকদের সমন্বয়ে গঠিত বোর্ডের অগ্রাধিকার বিষয়ে গবেষণার জন্য ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে ইনস্টিটিউটের যথেষ্ট সম্পদ ছিল। এমন একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থার মৌলিক নির্দেশ ছিল আন্তর্জাতিক নীতি বিষয়ে গবেষণা করা। এ ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয় নির্ধারণে রাজনৈতিক বিবেচনা এবং ফলাফল বা উপসংহার কী হবে তা ধতর্ব্য বিষয় ছিল না। এ ছাড়া একটি নির্দিষ্ট দেশের কেস স্টাডি বা নির্দিষ্ট নীতি বিষয়ে কয়েকটি বাছাইকৃত দেশের তুলনামূলক গবেষণা করাও প্রত্যাশিত ছিল। এসব কেস স্টাডি থেকে শিক্ষা নিয়ে তা অন্যান্য দেশের খাদ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কাজে লাগানোর জন্য সহজলভ্য করতে হতো। যে কারণে ইনস্টিটিউটের স্বাধীনতা ছিল। শুরুর দিকে এর বেশির ভাগ অর্থায়ন করত বেসরকারি ফাউন্ডেশনগুলো। এমনকি দাতা দেশগুলোর অনুদানও বহুলাংশে নির্দিষ্ট গবেষণার জন্য প্রদান করা হতো।
এফএওতে থাকাকালীন যেসব গবেষণার ব্যাপারে চিন্তা করেছিলাম কিন্তু অনেক বেশি দায়িত্ব থাকার ফলে করতে পারিনি, সেগুলো ইফপ্রিতে এসে আমি প্রকাশ করি। উল্লেখযোগ্য গবেষণার মধ্যে একটা গবেষণা ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর অকৃষি রপ্তানি নিয়ে। এই বিষয়টি তখন পর্যন্ত তেমন মনোযোগ পায়নি বা গবেষণা করা হয়নি, কারণ খাদ্যশস্য এবং বড় বড় কৃষির কাঁচামালই ছিল গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। এটা একটা বিস্তৃত গবেষণা ছিল, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোয় উদ্যানপালনসংক্রান্ত রপ্তানির নমুনা, গঠন ও পরিচালন এবং তাদের নির্ধারকগুলোয় আলোকপাত করে করা হয়েছিল। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ছিল গ্রামীণ অকৃষি খাত এবং অকৃষি খাতে ভবিষ্যত্ কেস স্টাডির জন্য একটি কাঠামো তৈরিসহ এ খাতের বিদ্যমান গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ফাঁকফোকরগুলোর বিশ্লেষণ; বেশ কিছু দেশে খাদ্যমূল্যের স্থিতিশীলতা আনতে উদ্দেশ্য, নীতি ও তাদের প্রভাবের মূল্যায়ন। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও আয় প্রবৃদ্ধির আলোকে খাদ্যের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য বিষয়ে একটি সম্ভাব্য গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছিলাম। বছরের পর বছর ধরে কৃষির উপখাতগুলোর গঠনের বিবর্তনসহ কৃষিতে বিদেশি সাহায্য নিয়েও আমি কাজ করেছিলাম। দাতারা যেভাবে সময়ে সময়ে সাহায্যের সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে তা কৌতূহলোদ্দীপক ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দাতা দেশগুলোর প্রশাসনিক বাজেটসহ যেসব আন্তর্জাতিক এনজিও উন্নত দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, উন্নত দেশে উন্নয়নশীল দেশের শরণার্থী বা অভিবাসীদের বন্দোবস্তে সহায়তা ও খাদ্যসহায়তা বিষয়ে কাজ করছিল তার সবই কৃষি খাতে সাহায্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল। অন্য কথায় বলতে গেলে সব সাহায্যই উন্নয়নশীল দেশে সম্পদপ্রবাহ ঘটায়নি। সময়ের পরিক্রমায় এসব এবং দাতা দেশগুলোর অন্যান্য ব্যয় সাহায্যপ্রবাহের উপাদান হিসেবে বাড়ছিল।
সাম্প্রতিক কালে, গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পদ ক্রমেই দাতাদের অগ্রাধিকার ও নীতিচাহিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে, যা বিশেষভাবে বলতে গেলে নির্দিষ্ট দেশগুলোয় দাতা সহায়তার প্রকল্প ও কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটা শুধু গবেষণা প্রকল্প বাছাই করার ক্ষেত্রে ইনস্টিটিউটের স্বাধীনতাই সীমিত করছে না, বরং যেসব দেশের ওপর গবেষণা করা হবে তাদের স্বাধীনতাও সীমিত হচ্ছে।
আমি ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি গবেষণা উপদেষ্টা ফেলো হিসেবে অবসর নিই এবং ইমেরিটাস ফেলো হিসেবে কাজ করা শুরু করি। এ সময়ে আমি উন্নয়নশীল দেশে শাসনপদ্ধতির সমস্যা এবং নীতিনির্ধারণের রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে বাড়তি নজর দিয়েছি। এর মধ্যে ছিল বাংলাদেশে শাসনপদ্ধতি ও উন্নয়ন ছাড়াও দুর্নীতির বিষয়ে একটা গবেষণা। শাসনপদ্ধতি ও উন্নয়নের মধ্যে আন্তসম্পর্কটি পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল। অন্যভাবে বললে ভালো শাসনপদ্ধতি উন্নয়নে সহায়তা করে। আবার বর্ধিত প্রবৃদ্ধি ভালো শাসনপদ্ধতির দিকে ধাবিত করে।
উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু কিছু খাত আছে, যেগুলো দুর্বল শাসনপদ্ধতির কারণে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। যেমন সামাজিক মূলধন ও আস্থার ভিত্তিতে তৈরি হওয়া অনানুষ্ঠানিক চুক্তি কার্যকর করার পদ্ধতি বেশ ভালোই কাজ করে। যখনই অর্থনৈতিক লেনদেন ও জোগান ধারা জটিল হতে থাকে, তখনই আনুষ্ঠানিক চুক্তি বলবত্করণপদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার, দুর্নীতির ফলে সরকারি অর্থ বেসরকারি হাতে চলে যাওয়ার ফলে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। তবে কিছু শর্ত পূরণ করা গেলে সম্পদ ব্যবহারের দক্ষতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। এটা ঘটে যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব কঠোরভাবে উন্নয়নমুখী হন এবং দক্ষ প্রকল্প বাস্তবায়নে দৃঢ় থাকেন এবং যদি এটা নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে কাকে ঘুষ দিতে হবে, কত ঘুষ দিতে হবে এবং ঘুষগ্রহীতা তার প্রতিশ্রুত কাজ সম্পাদন করে দেবে। এ ছাড়া এটাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে দুর্নীতির ফলে প্রকল্প বাছাই যেন আক্রান্ত না হয় এবং এখান থেকে সম্পদ বাজেভাবে বরাদ্দ না হয় বা প্রকল্প বা পারফরম্যান্সের মান নেতিবাচকভাবে আক্রান্ত না হয়। যা হোক, এগুলো খুবই কঠোর শর্ত এবং কদাচিত্ তা পূরণ হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যদিও-বা এই সবগুলো শর্ত পূরণও হয়, তবু আয় বণ্টনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়।
যখন আমি আমার দীর্ঘ পেশাগত জীবনের দিকে তাকাই কিছু এলোমেলো শিক্ষা আমার মনে আসে, যা এখন বলব। বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধিত্সা একটি সন্তুষ্টিজনক পেশাগত জীবনের ভিত্তি এবং গবেষণাকে উদ্দীপিত করে। একজন দক্ষ ও সফল শিক্ষককে তাঁর বিশেষায়িত বিষয়ে সাম্প্রতিক সংযোজন সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। তথ্য ও জ্ঞানের বিশ্বায়নের যুগে যদি কোনো শিক্ষক সেকেলে হয়ে পড়ে তাহলে খুব দ্রুতই তা ধরা পড়ে যায় এবং সেই শিক্ষক তাঁর সম্মান হারায়।
যেহেতু প্রতিনিয়ত নতুন কৌশল ও ধারণা তৈরি হয়, তাই পেশাগত জীবনে শিক্ষা গ্রহণ থেমে থাকে না।
যেখানে সমগোত্রীয় গোষ্ঠী থাকে যাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া, বিতর্ক ও আলোচনা করা যায়, সে ধরনের পরিবেশেই সবচেয়ে ভালো গবেষণা করা যায়। গণিত বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের চেয়ে সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে সত্য।
অনেক সময় কম শিক্ষিত মনে হয় এমন ব্যক্তির নির্বোধ বা খুব ভালোভাবে অবগত নয় বা স্পষ্ট নয়, এমন প্রশ্ন থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। তাই সেটাকে কখনোই খাটো করে দেখা ঠিক না। তবে এ জন্য নম্রতা প্রয়োজন এবং জ্ঞানীকে ভাবতে হয় এই প্রশ্নের পেছনে কী আছে।
অর্থনীতিতে কোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর নেই বা কোনো সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান নেই। উন্নয়ন অর্থনীতিতে আমরা কখনোই পুরোপুরি জানি না কোন উপাদানগুলো প্রবৃদ্ধি বাড়ায় এবং ধরে রাখে। আমরা বিশদ আকারে জানতে পারি কোন বিষয়গুলো প্রবৃদ্ধি বাড়ায়। রবার্ট সলো বলেছিলেন, কোন উপাদানগুলো প্রবৃদ্ধি বাড়ায়, সেগুলোর বেশির ভাগ আমরা সম্ভবত জানি কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে প্রণালিটা জানি না।
পরিমাণাত্মক (কোয়ানটিট্যাটিভ) অর্থনীতিতে একটি প্রশ্নের উত্তর অথবা কোনো অনুমানের সমর্থন নির্ভর করে কোন ধরনের উপাত্ত এবং কোন ধরনের বিশ্লেষণপদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে তার ওপর। এটা এখন স্বীকৃত যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপাত্তের মান ও পরিমাণ তাদের অর্থনীতির সন্তোষজনক বিশ্লেষণের জন্য যথেষ্ট নয় অথবা অনেক গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রশ্নের উত্তর দিতে যথেষ্ট নয়। সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সম্মেলনে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে জোর দেওয়া হয়েছে।
পরিমাণাত্মক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নীতি নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। টাইম সিরিজ ও ক্রস সেকশনের বিভিন্ন ধরনের উপাত্ত ব্যবহার এবং পরিমাপক কৌশল ব্যবহার করে বহুমাত্রিক পরিমাণাত্মক বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি অনুমানকে যাচাই করা প্রয়োজন। যদি সব ফলাফলই (বহুমাত্রিক বিশ্লেষণের) একই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় তাহলে নীতি সিদ্ধান্তে পৌঁছার একটি প্রাথমিক জায়গা তৈরি হবে। তবে তখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে হবে সাধারণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে।
অনুবাদ: খলিলউল্লাহ্